জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে এবার গণইস্তফা সিনিয়রদের, কী হতে চলেছে নবান্নের পরবর্তী পদক্ষেপ?
RG Kar Doctor's Protest: ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নবান্নে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যসচিব। যে বৈঠকে থাকতে পারেন স্বাস্থ্যসচিবও।
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে এবং সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোগত অব্যবস্থার প্রতিবাদে ফের নতুন করে আন্দোলনে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ধর্মতলায় আমরণ অনশন করছেন ৭ জুনিয়র ডাক্তারদের। যা নিয়ে এমনিতেই চাপে নবান্ন। এবার গোদের উপর যেন বিষফোঁড়া হয়ে উঠল নয়া সমস্যা। জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনকে সংহতি জানিয়েই এবার ইস্তফা দিলেন আরজি করের ৫০ জনেরও বেশি সিনিয়র ডাক্তার। সিনিয়র ডাক্তারদের এ হেন গণইস্তফায় স্বাভাবিক ভাবেই বেশ অস্বস্তিতে নবান্ন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় উৎসবে ফেরার বার্তা দিয়ে আন্দোলন থামানোর বার্তা দিয়েছিলেন ক'দিন আগেই। তার ফল হয় আরও ভয়াবহ। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে জোয়ার লাগে নতুন করে। এর আগে প্রথমে লালবাজার, পরে স্বাস্থ্যভবনের সামনে লাগাতার ধর্না দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক হয় নবান্নের। কিন্তু তাদের দাবিদাওয়া পুরোপুরি পূরণে ব্যর্থ হয় সরকার। বন্য়া পরিস্থিতিতে কাজে ফিরলেও ফের নতুন করে আন্দোলনের পথে নেমেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এবার আর শুধু ধর্না নয়, আমরণ অনশনে বসেন আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা। তবে তা নিয়েও বিশেষ মাথাব্যথা দেখায়নি সরকার।
এই আবহে হঠাৎ করেই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গণ ইস্তফার পথ ধরলেন আরজি করের ৫০ জন সিনিয়র ডাক্তার। শুধু আরজি কর, একই পথে হাঁটার হুমকি দিয়ে রেখেছেন কলকাতা মেডিক্য়ালের সিনিয়র ডাক্তারেরা। জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জুনিয়রদের দাবি পূরণ না হলে গণইস্তফা দেবেন তাঁরাও।
আরও পড়ুন: জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনের ৩৬ ঘণ্টা পার! উৎসবমুখী মানুষের কিছু আসে-যায়?
মঙ্গলবার দুপুরে নাটকীয় সেই গণ ইস্তফার পরে কার্যত অভূতপূর্ব ছবি দেখা যায় আরজি কর হাসপাতালে। গণ-ইস্তফার কাগজে সই করে বেরোনো সিনিয়র ডাক্তারদের সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গার্ড অব অনার পর্যন্ত দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এই প্রথম নয়, এর আগেও আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে তাদের পাশে থেকেছেন সিনিয়ররা। এমনকী রাস্তায় পর্যন্ত নামেন তাঁরা। করেন প্রতীকী অনশনও। তবে এবার সিনিয়র চিকিৎসকেরা যা করেছেন, তার প্রভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।
ইস্তফা দিয়েই আরজি কর থেকে ধর্মতলার অনশন মঞ্চে চলে যান কোনও কোনও সিনিয়র ডাক্তার। এক মহিলা চিকিৎসক বলেন, ‘‘জুনিয়রেরা যে দাবিতে অনশন করছেন, তা সকলের দাবি। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবাও এর সঙ্গে যুক্ত। একেবারে শেষ ধাপের আন্দোলন চলছে। কিন্তু সরকার কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। ফলে আমরা ইস্তফা দিচ্ছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘জুনিয়র ডাক্তারেরা যে ১০ দফা দাবির কথা বলছেন, সেগুলি আমাদেরও দাবি। আমরাও মনে করি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রশ্নে জুনিয়রদের দাবি ১০০ শতাংশ সঠিক।’’কলকাতা মেডিক্যালের সিনিয়র ডাক্তারেরা বলেন, “জুনিয়র ডাক্তারেরা বিচারের জন্য লড়াই করছেন। তাঁরা কর্মবিরতি থেকে ফিরে এসেছেন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তাঁরা রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছেন। কিন্তু অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন।” জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিদাওয়ার সঙ্গে তাঁরা সম্পূর্ণ সহমত, সে কথাও জানিয়েছেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টি সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করারও অনুরোধ করেন তাঁরা। বুধবারের মধ্যে সরকার জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনার জন্য না ডাকলে, গণইস্তফারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কলকাতা মেডিক্যালের সিনিয়র ডাক্তারেরা।
সেই শনিবার থেকেই আমরণ অনশন চলছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট’-এর সাত জন প্রতিনিধির। রয়েছে তাঁদের নির্দিষ্ট দশ দফা দাবি। প্রথমে ছ’জন অনশনে বসেছিলেন। পরে আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতোও যোগ দেন আমরণ অনশন কর্মসূচিতে। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিদাওয়াগুলিকে শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময়ে রোগীর চাপ সামাল দিয়েছেন তাঁরাই। প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় কাজ করেছেন। সিনিয়রদের পরামর্শেই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে আন্দোলনের অন্য পন্থা খুঁজতে আলোচনা করেছেন জুনিয়রেরা। ইতিমধ্যেই অনশনের জেরে শারীরিক অবস্থার অবণতি হয়েছে তাঁদের। সেই নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ব গোটা রাজ্য।
ধর্মতলায় অনশনকারীদের পাশেও প্রতীকী অনশনে বসতে দেখা গিয়েছে সিনিয়র ডাক্তারদের। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন সিনিয়র চিকিৎসক কেউ ১২ ঘণ্টা, কেউ ২৪ ঘণ্টার প্রতীকী অনশনে শামিল হয়েছেন। মঙ্গলেও তার অন্যথা হয়নি। এরই মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে সংহতির বার্তা দিতে গণইস্তফার হুঙ্কার আরজি করের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সিনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। চিকিৎসক মহলের খবর, এসএসকেএম এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেও প্রায় একই ধরনের পরিকল্পনা নিতে চলেছেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। এর ফলে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেই তৈরি হতে পারে ভয়ঙ্কর অচলাবস্থা। সেই উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে ক্রমশই।
আরও পড়ুন: ৫৮ দিন পর আরজি কর কাণ্ডে প্রথম চার্জশিট সিবিআইয়ের! কী রয়েছে ২১৩ পাতার সেই চার্জশিটে?
এই পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও। এতদিন জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি নবান্ন। তবে সিনিয়র ডাক্তারদের গণইস্তফা সামনে আসতেই চাপে সরকার। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নবান্নে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যসচিব। যে বৈঠকে থাকতে পারেন স্বাস্থ্যসচিবও। এর আগে সোমবারই অবশ্য রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ আমরণ অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের উদ্দেশে অনুরোধ করেছিলেন অনশন তুলে নেওয়ার জন্য। আগামী ১০ তারিখের মধ্যে রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির ৯০ শতাংশ উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হয়ে যাবে বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। যদিও কোনও মাসের কথা তিনি উল্লেখ করেননি। সে ক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির হার নিয়ে মুখ্যসচিব যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে মনে করা হচ্ছে, আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। তবে চিড়ে ভিজল না মুখ্যসচিবের এই আশ্বাসে। বরং তার ঠিক পরের দিনই নবান্নের ঘুম উড়িয়ে সামনে এল সিনিয়র ডাক্তারদের তরফে গণইস্তফার বার্তা। পুজোর মধ্যে চিকিৎসকদের এ হেন সিদ্ধান্তে যে ভেঙে পড়তে পারে গোটা রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামো, তেমন উদ্বেগ ঘুরছে আকাশে-বাতাসে। আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে এর আগেও একাধিক বৈঠক হয়েছে নবান্নে। নবান্নের এক আধিকারিক জানালেন, মঙ্গলবারও বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। তবে কী ধরনের বৈঠক, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। মনে করা হচ্ছে, পুজোর মুখে নতুন করে এই যে অচলাবস্থা তৈরি হল, তা থেকে মুক্তির পথ বার করতেই মঙ্গলবার ফের জরুরি বৈঠক ডাকল প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিস্থিতিতে শুধু বৈঠক করেই ক্ষান্ত দেবে স্বাস্থ্যসচিব। নাকি শেষ পর্যন্ত রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নতিস্বীকার করতে হবে। বাড়ছে উদ্বেগ।