আলো থেকে অস্ত্র তৈরি থেকে খতরনাক মার্শাল আর্ট, অশোকের গোপন সংঘের পরিচয় আজও অজানা

এই সোসাইটি নাকি আজও গোপনে তার কাজ করে চলেছে। কিন্তু কে বা কারা সেই কাজ করছেন, রহস্যের কুয়াশাঘেরা পথটুকু হেঁটে আসা যাক।

ইংরেজদেরও অনেক আগে ভারতে পা পড়েছিল ভিনদেশীদের। গ্রিক, আফগান, আরব, মোঘল কেউ বাদ যায়নি। কেউ ভারতের রূপ-রস-গন্ধে মদির হয়ে মিশে গিয়েছে। কেউ আবার গুপ্তজ্ঞান, সম্পদ সংগ্রহ করে ফিরে গিয়েছে নিজের দেশে।  চাণক্য, কৌটিল্য, মহাবীর, বুদ্ধ যে দেশের সন্তান, সে দেশের জ্ঞানের কদর তো বিশ্বজুড়ে থাকবেই। কিন্তু খোদ ভারতেই এমন কিছু জ্ঞানের চর্চা হয়েছে যার রহস্য অমীমাংসিত। বিশ্বের পশ্চিমী দেশে ইলুমিনাটি বা গোপন সংঘের কথা শোনা গেলেও ভারতেও যে গোপন সংঘ বা সিক্রেট সোসাইটি গড়ে উঠতে পারে তা যেন বিস্ময়কর ! ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে ভারতে একটি সিক্রেট সোসাইটি গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট অশোক। আর আশ্চর্যের কথা এই সোসাইটি নাকি আজও গোপনে তার কাজ করে চলেছে। কিন্তু কে বা কারা সেই কাজ করছেন, রহস্যের কুয়াশাঘেরা পথটুকু হেঁটে আসা যাক।

গোপন সংঘের উৎপত্তি

খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪ সালে মৌর্য সম্রাট অশোকের জন্ম। বিন্দুসার এবং ধর্মার সন্তান এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রপৌত্র ছিলেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশে সম্রাট অশোক যেমন বীরত্বের প্রতীক ঠিক তেমনি তাঁকে জড়িয়ে ছিল নানা রহস্যও। প্রথম জীবনে তিনি বৈদিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তৃতীয় মৌর্য সম্রাট হিসেবে তিনি ২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেছেন। মৌর্য আমলে ভারতের অসাধারণ সমৃদ্ধি হয়েছিল। শোনা যায়, সম্রাট হয়ে সিংহাসনে বসার পর ২৬১-২৬৩ খ্রিস্টপূর্বে তিনি কলিঙ্গ দখলে উদ্যোগী হন। যেখানে তার পূর্বপুরুষেরা কখনোই জয়ী হতে পারেননি। সেই কলিঙ্গেই দয়া নদীর ধারে হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সম্রাট অশোকের সেনারা প্রায় ১ লাখ কলিঙ্গ যোদ্ধা এবং দেড় লাখ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, যুদ্ধে জিতেও অশোকের মনে শান্তি ছিল না। বরং যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ দেখে মুষড়ে পড়েন তিনি। এরপর তিনি শপথ নেন, তিনি আর কোনোদিন যুদ্ধ করবেন না। এরপর বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হলেন সম্রাট অশোক। সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্য ছিল সুবিশাল। তিনি অনুভব করেছিলেন জ্ঞানই হল আসল শক্তি। যুদ্ধ করে আর যাই হোক মানসিক শান্তি আসে না । তার নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল অফুরন্ত। সেই জ্ঞানই তিনি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। ইতিহাসবিদ পাওয়েল এবং বার্জিয়ের তাঁদের গবেষণাগ্রন্থে লিখেছেন-

"বিদ্রোহী আর রক্তপিপাসু মানুষদের তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে জয় করতে হবে। ঈশ্বর মানুষের মহৎ কাজে খুশি হয়। জীবিত সকল প্রাণীর শান্তিতে, আনন্দে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই সকল কথাই তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রচার করতেন”।


বলা হয়ে থাকে, সম্রাট অশোক যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তাই তিনি চাইতেন মানুষ যেন তার বুদ্ধিমত্তাকে খারাপ কাজে ব্যবহার না করে। তার শাসনকালেও বিজ্ঞানের চর্চা গোপনে করা হত। এই গোপনীয়তার অভ্যাস আজ অবধি চলে আসছে। কিন্তু অশোক যেই মহৎ কাজের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন তা তার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। সেই কারণে সমাজের মধ্যে থেকে তিনি মোট ৯ জন গুণী ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন এক গোপন সংঘ। এই সংঘের উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে খারাপ কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখা যায় এবং অন্যের ক্ষতি না করে একসাথে বসবাস করা যায়। নিজের উপর পুরো সাম্রাজ্যের দায়িত্ব থাকায় এই ৯ গুণী ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব দেন এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং নিরাপত্তার খাতিরে আজও কেউ এই ৯ জন ব্যক্তির পরিচয় জানেন না। এইভাবেই গড়ে উঠেছিল সম্রাট অশোকের অজানা নবরত্ন সংঘ।

প্রকৃতি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, যে শাখায় যতটা জ্ঞান আহরণ করা যায় তার সবটুকু নেওয়া শুরু করলেন এই ৯ ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ যদি এই জ্ঞানের কথা জেনে ফেলে তাহলে তা ধ্বংসের কারণ হবে মনে করে এই জ্ঞান বাইরে প্রচারও করতেন না তারা। তথ্য, তত্ত্ব, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ ছিল তাঁদের। তাদের ওপরে দায়িত্ব ছিল যে - যে বিষয়ে পারদর্শী তার সেই বিষয়ের ওপর বই লেখার। তবে এখানে একটা ব্যাপার ছিল। যদি কেউ তার বইটি শেষ করতে না পারে তাহলে পরবর্তী উত্তরসূরির কাছে চলে যাবে সেই দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা আর বাড়ানো হত না। ৯ সংখ্যাটি ছিল ধ্রুব। রোগ, শোক বা মৃত্যুবরণ কিংবা কেউ স্বেচ্ছায় চলে যেতে চাইলে তাকে কেউ বাধা দিত না। কিন্তু শপথ করতে হত যে এই কথা যেন বাইরে কেউ না জানে।

ইতিহাস ঘেঁটে এই ৯ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তারা কে ছিলেন, তাদের নাম কি, কোথায় থাকতেন সেই ব্যাপারেও কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। সম্রাট অশোক এই ৯ ব্যক্তিকে যে ভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করার আদেশ দেন সেই মতো এই গুণী ব্যক্তিরা পৃথিবীর ভিন্ন জায়গা থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করতেন। শুধু তাই নয় এইসব জ্ঞান যাতে ভুল লোকের হাতে না পড়ে সেদিকেও থাকত কড়া নিরাপত্তা। ভাবতেও অবাক লাগে এই গোপনীয়তার নিশ্চয়তা কেবল অশোকের আমলে নয় আজকের যুগেও প্রবাহমান।

কিন্তু কী ছিল সেই ৯ টি বিষয় –

১. মনোবিদ্যা – বলা হয় ৯ টি বিদ্যার মধ্যে এটি ছিল সবথেকে ভয়ঙ্কর। সাধারণ চিন্তা ভাবনা থেকে শুরু করে মানুষের স্বভাব চরিত্র পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল এই বিদ্যায় ছিল। যে নাকি এই বিদ্যার অধিকারী হবে সে নাকি সারা দুনিয়া শাসন করবে।

২. শারীরবিদ্যা – সাধারণত এই বিদ্যায় প্রাণী বা উদ্ভিদের জীবনধারা নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু প্রাচীন এই বিদ্যার ধারা ছিল অন্য। এখানে জীব শাস্ত্রের গোপন দিক অতি সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী কালে এই শাস্ত্রের কিছু জ্ঞান লোক সমাজে বেরিয়ে যায়। এর মধ্যে ‘টাচ অফ ডেথ’ ছিল অন্যতম। অনেকে সন্দেহ করেন মার্শাল আর্টের এই গুপ্ত ঘায়েল পদ্ধতি দ্বারাই ব্রুস লি কে মারা হয়েছিল। এটি মার্শাল আর্টের এমন এক ধরণের মারার স্টাইল যেখানে নিউরোনে আঘাত করা হয় সরাসরি। প্রতিপক্ষকে একবারে না মেরে ধীর লয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয় এই পদ্ধতিতে। অথচ মারার পরে কোনও রকম ক্লু পাওয়া যাবে না, এই কায়দার ব্যবহারে।

৩. অনুজীববিদ্যা – প্রাচীন কালে এই বিদ্যা অত্যাধুনিক পর্যায়ে ছিল। কিছু বছর হল আমরা বায়োটেকনোলজি সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। কিন্তু সম্রাট অশোকের এই ৯ ব্যক্তি সেই সময়ে দাঁড়িয়েও বায়োটেকনোলজির ব্যবহার শিখে ফেলেছেন। রূপকথার মতো শোনালেও বলা হয়, অশোকের এই ৯ গুণবান ব্যক্তি গঙ্গার জলকে এমনভাবে শুদ্ধ করেছিল যা কিনা মানুষকে যে কোনও মারণ ব্যাধি থেকে বাঁচাতে পারে।

৪. রসায়ন – ধারণা করা হয় এই ৯ জ্ঞানী ব্যক্তি পরশমণির সন্ধান পেয়েছিলেন। যা কিনা যে কোনও ধাতব পদার্থকে সোনায় রূপান্তরিত করতে পারে। ইতিহাসবিদের কথায়, ভারতে কোনও সোনার খনি নেই তাহলে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় এত সোনা এল কোথা থেকে।

৫. যোগাযোগ বিদ্যা – এই বিদ্যার দ্বারা বিশ্বের বহু দূর জগতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যেত।

৬. মহাকর্ষ – এই বিদ্যায় ‘ভিমানা’ বলে এক উড়োজাহাজের উল্লেখ ছিল যাকে ইতিহাসবিদ গণ প্রাচীন ভারতের ইউ এফ ও বলে অভিহিত করেন। কিংবদন্তি আছে, অশোকের এই ৯ গুণী ব্যক্তির মধ্যে একজন নাকি ভিনগ্রহের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।

৭. কসমোলজি – এই বিদ্যা আজকের দিনে টাইম ট্র্যাভেল বলে পরিচিত। কীভাবে এই মহাবিশ্ব তৈরি হল, কে এই বিশ্ব পরিচালনা করছে তা লিখিত আছে।

৮. আলোকবিদ্যা – আলোকে কীভাবে অস্ত্রে পরিণত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়াও আলোর সঙ্গে গতির সমন্বয় করে পদার্থবিদ্যার ভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে।

৯. সমাজবিদ্যা – শেষ বিদ্যা সমাজ নিয়ে। একটি সমাজ কীভাবে চলে,  কী ভাবে ধীরে ধীরে অবক্ষয় রচিত হ  আসবে সেসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।


এ তো গেল সম্রাট অশোকের অজানা নবরত্নের কথা। তবে এই সংঘ আসলে ছিল না তা একটি মিথ সেই নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, কলেরা জীবাণুর প্রতিষেধক আবিষ্কারের পেছনে এই সংঘের অবদান আছে। “The nine unknown men” ইতিহাসের বহু চর্চিত বিষয়। অনেকে আবার এটাও বলেন যে, এটা নির্দিষ্ট ৯ জন মানুষের দল নয়। কালের নিয়মে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি এই সংঘে যোগ দিয়েছেন। তবে সংখ্যা সবসময়ে ৯ থাকত। এই ধরনের রহস্য়ঘন বিষয় নিয়ে বহুরকম দাবির পাহাড় জমতে থাকে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত মানুষ যেমন – আইজ্যাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, এবং এ পি জে আব্দুল কালামও নাকি এই গোপন সংঘের সদস্য ছিলেন। সত্য়াসত্য় বিচার করার পথ বন্ধ। শুধু রহস্যটুকুই ছোঁয়া যাবে। রহস্যটুকু থাক।

More Articles