ভারতকে অন্য দেশের থেকে মহান মহিলা ধার করতে হয়: নিবেদিতাকে লিখেছিলেন স্বামীজি
Swami Vivekananda Letter: "ভারত এখনও মহান মহিলা তৈরি করতে পারে না, তাকে অন্য জাতির কাছ থেকে তাদের ধার করতে হবেই," নিবেদিতাকে বলেছিলেন বিবেকানন্দ
আলমোড়া,
২৯শে জুলাই, ১৮৯৭
আমার প্রিয় মিস নোবেল,
স্টার্ডির কাছ থেকে একটি চিঠি গতকাল আমার কাছে পৌঁছেছে, চিঠিতে জানিতে পারি যে আপনি ভারতে আসতে এবং নিজের চোখে জিনিসগুলি দেখতে বদ্ধপরিকর। আমি গতকাল এর উত্তর দিয়েছিলাম কিন্তু আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে মিস মুলারের কাছ থেকে আমি যা যা জানতে পেরেছি তাতে আরেকটু বিশদে এবং সরাসরি বলার প্রয়োজন।
আমি আপনাকে খোলাখুলি বলতে চাই যে, আমি এখন নিশ্চিত যে ভারতে কাজের ক্ষেত্রে আপনার এক দুর্দান্ত ভবিষ্যত রয়েছে। একজন পুরুষ নয়, একজন মহিলারই প্রয়োজন ছিল - একজন সত্যিকারের সিংহী - ভারতীয়দের জন্য, বিশেষত মহিলাদের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজন ছিল।
ভারত এখনও মহান মহিলা তৈরি করতে পারে না, তাকে অন্য জাতির কাছ থেকে তাদের ধার করতে হবেই। আপনার শিক্ষা, আন্তরিকতা, বিশুদ্ধতা, অপরিসীম ভালবাসা, সংকল্প এবং সর্বোপরি, সেল্টিক রক্ত আপনাকে সেই কাঙ্খিত মহিলা হিসাবে তৈরি করেছে।
তবুও অসুবিধা অনেক। আপনি এখানকার যে দুর্দশা, কুসংস্কার এবং দাসত্ব তার কোনও ধারণা তৈরি করতে পারবেন না। আপনি জাতপাত এবং বিচ্ছিন্নতার অদ্ভুত ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকা অর্ধনগ্ন নর-নারীর মধ্যে থাকবেন। এরা হয় ভয়ে বা ঘৃণায় সাদা চামড়ার থেকে দূরে থাকেন। অন্যদিকে, সাদা চামড়ারা আপনাকে 'পাগল' হিসাবেই দেখবে এবং আপনার প্রতিটি গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখা হবে।
তারপর জলবায়ুও ভয়ঙ্কর গরম; আমাদের শীত বেশিরভাগ জায়গায় আপনাদের ওখানকার গ্রীষ্মের মতো এবং দক্ষিণে তো সর্বদাই গরম। ইউরোপিয় স্বচ্ছন্দ্ শহরগুলির মতো নয় এই জায়গা। এত কিছুর পরেও যদি আপনি সাহস করে কাজে উদ্যোগী হন, তাহলে আপনাকে স্বাগত, শতবার স্বাগত জানাই। আমার ক্ষেত্রে, আমি এখানে বা অন্য কোথাওই কিচ্ছুটি নই, তবে আমার যে সামান্য প্রভাবটুকু আছে তা আপনার সেবায় নিবেদিত হবে।
ডুব দেওয়ার আগে আপনাকে অবশ্যই ভালভাবে চিন্তা করতে হবে; এবং কাজের পরে, যদি আপনি এতে ব্যর্থ হন বা বিরক্ত হন, আমার পক্ষ থেকে আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনি ভারতের জন্য কাজ করুন বা না করুন, আপনি বেদান্ত ত্যাগ করুন বা তাতে থাকুন না কেন আমি আপনার পাশে থাকব। "হাতির শুঁড় বেরিয়ে আসে, কিন্তু ফিরে যায় না"; তাই একজন প্রকৃত মানুষের কথাও কখনই প্রত্যাহার করা হবে না। আমি আপনা প্রতিশ্রুতি দিলাম। তবে আবারও, আমি আপনাকে সতর্ক করতে চাই। আপনাকে অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মিস মুলার বা অন্য কারও ছাতার তলায় থাকবেন না। মিস মুলার অবশ্যই তাঁর মতো করে একজন ভাল মহিলা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছোট থেকেই তাঁর মাথায় একটা বিষয় গেঁথে গেছে যে তিনি জন্মসূত্রেই একজন নেতা এবং অর্থ ছাড়া পৃথিবীকে পরিবর্তন করার অন্য কোনও যোগ্যতার প্রয়োজন নেই বলেই তিনি ভাবেন! এই ধারণাটি বারবার সামনে আসছে এবং আপনি কয়েকদিনের মধ্যে তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মতানৈক্যে পড়বেন। তিনি এখন নিজের জন্য এবং আপনার জন্য এবং অন্যান্য ইউরোপিয় বা আমেরিকান বন্ধুদের জন্য কলকাতায় একটি বাড়ি নিতে চান। এটি খুব সদয় এবং ভাল সিদ্ধান্ত, কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা দু'টি কারণে কখনই সম্পন্ন হবে না - তাঁর হিংসাত্মক মেজাজ এবং অবাধ্য আচরণ এবং ভয়ঙ্কর উদ্বেলিত মন। অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব দূরত্বে থেকেই ভালো। যে ব্যক্তি নিজের পায়ে দাঁড়ায় তাঁর সঙ্গে সবকিছু ঠিকঠাক হয়।
মিসেস সেভিয়ার একজন অসাধারণ ভদ্রমহিলা—এত ভালো, এত দয়ালু! সেভিয়াররাই হল একমাত্র ইংরেজ যারা নেটিভদের ঘৃণা করে না , স্টার্ডিও বাদ পড়েন না। মিস্টার এবং মিসেস সেভিয়ারই একমাত্র ব্যক্তি যারা কেবল আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেই আসেননি, কিন্তু তাদের এখনও কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। আপনি যখন আসবেন, আপনি তাদের আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারেন এবং এটি তাদের এবং আপনার জন্য সত্যিই উপকারের হবে। কিন্তু সব শেষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন।
আমি শুনলাম, আমেরিকা থেকে আমার দুই বন্ধু, বোস্টনের মিসেস ওলে বুল এবং মিস ম্যাকলিওড, এই শরতে ভারত সফরে আসছেন। মিস ম্যাকলিওডের সঙ্গে তো আপনি ইতিমধ্যে লন্ডনেই পরিচিত হয়েছেন, প্যারিসের পোশাক পরা তরুণী আমেরিকান মহিলা; মিসেস ওলে বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং আমেরিকাতে আমার একজন সদয় বন্ধু। আমি পরামর্শ দিতে পারি যে, আপনার এই দলে যোগদান যাত্রার ক্লান্তি দূর করতে পারে। ওরাও ইউরোপ থেকেই আসছে।
আমি অনেক পরে স্টার্ডির থেকে চিঠি পেয়ে খুশিই হলাম কিন্তু খুবই কঠিন এবং শীতল বার্তা। মনে হচ্ছে লন্ডনের কাজ নিয়ে তিনি হতাশ।
চিরন্তন প্রেমের সহিত,
আপনার সেবায়,
বিবেকানন্দ