রবিঠাকুরের গানের সুর বদলে দিয়েছে শান্তিনিকেতনের মুরুব্বিরা
Rabindra Sangeet: যেই রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট উঠে গেল তখন আর কোনও কিছুর বাকি থাকল না। শুধু পদ নয়, গানের সুর বদলে গেল।
শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কোনওকালেই আমার তেমন বৌদ্ধিক যোগাযোগ ছিল না। অত্যন্ত কম বয়সে বাবার হাত ধরে প্রথম যাওয়া। অনেকটাই ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মতো। সারাদিন বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস ঘুরে পরের দিন ফিরে আসা। ততদিনে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে সামান্য বোঝাপড়া হয়েছে। মা রবীন্দ্রসঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন। নিয়মিত গান গাইতেন আর আমি সঙ্গত করতাম। তাছাড়া বাড়িতে রবীন্দ্রচর্চা ছিল বড়দের মধ্যে। সেই থেকে ওই বয়সে যতটুকু জানা যায় আর কী! কিন্তু প্রথমবারের শান্তিনিকেতন যাওয়া আমার কিশোরমনে বেশ ছাপ ফেলেছিল। গাছের তলায় ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠন, খেলাধূলা, নাচগান আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছিল। এমন মুক্ত পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের এর আগে কখনও দেখিনি। ভাবতেও পারিনি। চারদিকে নানা ছবি আর ভাস্কর্য। বাবা এক এক করে আমায় বুঝিয়েছিলেন কোনটা কার এবং তার তাৎপর্য। মানে ওই বয়সে যেমন করে বললে বুঝতে সুবিধা হয়, তেমন করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের যাওয়া সত্তর দশকের শেষ ভাগে। গেছিলাম কবি দীপক মজুমদারের সঙ্গে। সেই শুরু হলো। তারপর দীপকদার সঙ্গে যে কত-শতবার গেছি তার আর হিসাব থাকেনি। তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন বিশ্বনাগরিক। প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও গদ্যে তাঁর পারদর্শিতা ছিল অসামান্য। সারা পৃথিবীর নানা নাট্য পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, অভিনয় করেছেন, নির্দেশকও ছিলেন। দারুণ কথা বলতেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যারাথন টকার। আর উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। হাজারও রবীন্দ্রগান ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। তা এই দীপকদার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ছিল নাড়ির যোগ। সেখানকার নতুন-পুরনো সমস্ত আশ্রমিকদের সঙ্গে ছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক। দীপকদার মামা ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। সেই সূত্রে আমরাও তাঁকে মামা বলেই ডাকতাম। ফলে শান্তিনিকেতন গেলেই মামার বাড়িতে একবার যাওয়া হতোই। আর সেখানে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, গান আর গান নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক।
আরও পড়ুন- বাবুদের শান্তিনিকেতন আসলে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ
মামা পুরনো দিনের মানুষ এবং রাশভারী। নিজের কথা থেকে সরতে চাইতেন না অর্থাৎ যা বলছেন তাই ঠিক। এদিকে দীপকদা ছিলেন তর্কবাজ। নিজের কথা থেকে কিছুতেই সরবেন না তিনিও। এই এরকম একটা বিতর্ক দিয়েই শুরু করা যাক। এক সন্ধ্যাবেলায় আমরা অনেকেই বসে আছি। দীপকদাকে মামা শান্তিদেব ঘোষ একটা গান ধরতে বললেন। দীপক মজুমদার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উদাত্ত গলায় শুরু করলেন,
"সে আমার গোপন কথা শুনে যা ও সখী!
ভেবে না পাই বলব কী॥
প্রাণ আমার বাঁশি শোনে নীল গগনে,
গান হয়ে যায় নিজের মনে যাহাই বকি॥"
গানটি শেষ করার পরেই শুরু হলো বাকবিতণ্ডা। মামা বললেন পদে ভুল আছে। দীপকদা প্রশ্ন করাতে শান্তিদেব বললেন, "প্রাণ যে আমার বাঁশি শোনে" হবে। দীপকদা বললেন আলবাৎ না। পরবর্তীকালে 'যে' শব্দটি বিশ্বভারতী ঢুকিয়েছে স্বরলিপিতে। মামা বললেন, "হ্যাঁ প্রয়োজন ছিল। গানের গায়কিতে ওটা থাকলে গাইতে সুবিধা হয়।" দীপকদা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, "এ তো খোদার ওপর খোদকারি। মূল গান থেকে সরে এসে কেন রবীন্দ্রনাথের লেখার ওপর শব্দ যোগ করা হবে?" এরপর এক কথা দু-কথায় চলে এল সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। এখানে সৌম্যেন্দ্রনাথের দু'টি উক্তি লিখে রাখি, তাহলেই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গানের কী দশা ক্রমশ হয়েছে তা বোঝা যাবে এবং সেই বিশুদ্ধ তর্কবিতর্কের মর্মার্থও খানিকটা টের পাওয়া যাবে।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
"এই নিদারুণ অবস্থা সৃষ্টি করার জন্যে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কম দায়ী নয়। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের যে সব স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে এক সময়, পরবর্তীকালে এই একই গানের অন্য সুরের স্বরলিপি স্বরলিপির বইয়ের নতুন সংস্করণে ছাপা হয়ে বের হচ্ছে। বিশ্বভারতীর সংগীত বিভাগের কর্তৃপক্ষের অমার্জনীয় অপরাধের ফলে এটা ঘটেছে। এদের প্রত্যেকেই নিজেকে রবীন্দ্রনাথের গানগুলির একমাত্র অধিকারী প্রমাণ করবার জন্য ও নিজের প্রাধান্য জাহির করার জন্যে ব্যস্ত।"
ভাবা যায় কী মারাত্মক অভিযোগ? তিনি আরও লিখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দশ বছর পার হতে না হতেই এইসব শুরু হয়ে গেছিল। কেবল "গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ" গানটির সুর যে এই শান্তিনিকেতনের মুরুব্বিরা কতবার পরিবর্তন করেছে তার হিসেব কে রেখেছে! এও তো বিশ্বভারতীর প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের গর্হিত অপরাধ। এরপর যেই রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট উঠে গেল তখন আর কোনও কিছুর বাকি থাকল না। শুধু পদ নয়, গানের সুর বদলে গেল। সে গানের আর ভাব রইল না, তার মূল গঠনতন্ত্রেরই সর্বনাশ হয়ে গেল। গায়কির পরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কৃত গান কী করে পাল্টে দেব? যদিও তারপরেও এমন অহরহ হয়ে চলেছে ব্যান্ডের জগঝম্প বাজনার দৌলতে। মুম্বই, চেন্নাই আর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হাত ধরে।
আবার ফিরে যাই শান্তিনিকেতনের বর্তমান গানে। রবীন্দ্রগানের অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে কালে কালে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে তিরিশ কী চল্লিশ বছর আগেও গান ছিল। গান ছিল গাছের তলায়, বাড়িতে বাড়িতে। উৎসবে-পার্বণে। কত যে গান শুনেছি! গান শুনেছি নতুন সব ছাত্রছাত্রীদের কাছে, শিক্ষকদের কাছে আর পুরনো আশ্রমিকদের কণ্ঠে। সে গানও কালের ধাক্কায় সরে গেল। এর একটা কারণ সম্ভবত বিশ্বভারতীর পঠনপাঠনের মধ্যেই নিয়োজিত। আরও অনেকানেক কারণও থাকতে পারে। সে তো আর আমার জানার কথা নয়। আমি দূর থেকে দেখেছি আর মাঝে মাঝে কাছে গেছি অন্তরঙ্গ হওয়ার আশায়। এখানে সেইসব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। তাতে যদি শান্তিনিকেতন মায় বিশ্বভারতীর একটা খণ্ডিত রূপ ও রূপান্তর টের পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- ক্রমে জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন
এখন সর্বত্রই চলছে মোফোন দেখে দেখে গান। শান্তিনিকেতনও আর ব্যতিক্রম রইল না। কেউ বাড়িতে এলে ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগই মোফোনের সাহায্য নিচ্ছে গান শোনাতে। মনে পড়ে গেল সুচিত্রা মিত্রের একটি কথা। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একটি ঘণ্টাখানেকের ছবি তৈরি করছিলাম। তো সুচিত্রাদির সঙ্গে কথা বলতে গেছি। তিনি বললেন,
"আমার তো কখনও বই দেখে গান করতে হয় না। আসলে এই গানগুলো তো আমারই গান। দেখো, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হলে প্রথম তাঁর বাণীকে উপলব্ধি করতে হবে। হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তা না হলে ও গান হবে না। প্রতিটি গানের মর্মার্থ ও ভাবের চলন প্রথমে বুঝতে হবে। তবে না তুমি সেই গানের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে! শুধু স্বরলিপি মুখস্থ করলে যেমন হবে না, তেমন গান মুখস্থ করে গাইলেও হবে না।"
আসলে এই কথাগুলো লিখছি এই কারণে যে, আজ আর এই কথা বলার মানুষজন নিতান্তই কম। এখানে তবু একটা রেকর্ড অত্যন্ত থেকে যাক।
সেই আশির দশকের মাঝামাঝি অম্লান দত্ত বিশ্বভারতীর উপাচার্য। একবার শঙ্খ ঘোষ এলেন বিশ্বভারতীরতে। একথা সেকথায় অম্লানবাবু শঙ্খবাবুকে জিজ্ঞেস করেন, "সন্ধ্যাবেলায় আজ কী করছেন?" শঙ্খবাবু বলেন, "তেমন কিছু নয়। শান্তিনিকেতনে এসেছি গান শুনতে।" অম্লানবাবু বলেন, সে কী মশাই কলকাতা ছেড়ে এখানে এসেছেন গান শুনতে? বরং কলকাতার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পীদের গান শুনুন। এখানে গান কই?" এই গল্পটি আমার শঙ্খবাবুর কাছে শোনা। এরপর শান্তিনিকেতনের গান কোন পর্যায় পৌঁছল তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছি। আপাতত এইটুকুই থাক। সামনের পর্বে আবার নতুন কোনও বিষয় নিয়ে লিখব।