কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড সেলাম ঠুকত যাঁকে! মস্তানদের অভিভাবক ফ্যাতন গোস্বামী
Mastans of Kolkata: পরপর গুলি চলল ফটিকের চওড়া বুক লক্ষ্য করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন দাদু। তখন তাঁর আশি বছর বয়স।
গ্রাহামস রোডে ঢুকে রাস্তাটা যেভাবে এঁকেবেঁকে গেছে সেভাবেই যেতে হবে। তারপরই চোখ আটকাবে ডানদিকের একটি প্রসাদোপম বাড়িতে। আজ এই ২০২৪-এ ওই রাস্তাজুড়ে নানা উঁচু ঘরবাড়ি, ঘনবসতি গড়ে উঠলেও ১৯৬৭-৬৮ সালে এই বিরাট বাড়িটা একাই এই অঞ্চলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকত। বাড়ির মালিক পাজামা আর কলারওয়ালা ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়াতেন। ভদ্রলোক যে ঠিক কী কাজ করেন, এলাকার সাধারণ লোকজন সেভাবে জানত না কিন্তু ওই সময়ে ওইরকম একটা দালানকোঠা তোলা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। ব্যবসা, উদ্যোগ, ব্যস্ততা- কিছুই ভদ্রলোকের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ছিল না। তারপরও চোখ ধাঁধানো এই দালানকোঠা!
পাড়ার লোক এটুকু জানত, বাড়ির মালিকের নাম অবনী মোহন গোস্বামী। আদি নিবাস পাবনায়। দেশ ছেড়ে এসে বিরাটিতে ছিলেন। বর্তমানে টালিগঞ্জ ইন্দ্রপুরী স্টুডিও লাগোয়া এই গ্রাহামস রোডে বাড়ি বানিয়ে এসেছেন। অবনী মোহনের ডাক নাম ফ্যাতন। এটুকুই!
ভদ্রলোকের তেমন কোনও অহংকার ছিল না। পাড়ার পুজোয় দান-ধ্যান, ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে সুসম্পর্ক- সবেতেই সহজ সাবলীল। চোখে পড়ার মতো বা সন্দেহ করার মতো কিছু না। শুধু সকাল-সন্ধেয় কারা যেন আসে। গাড়ি এসে থামে বাড়ির গেটে। তার মধ্যে পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের গাড়িও আছে। কিন্তু এসব নিয়েও পাড়ার লোকের তেমন কিছু এসে যেত না। শুধু একদিনের একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা তাদের অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করল।
আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?
কুঁদঘাটের ডন ননী দত্ত এলেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। এই নামটা সেই সময় বড় নাম। অপরাধ জগতের বেতাজ বাদশা বলা চলে ননী দত্তকে। ননীর গুরু ইনু মিত্তির। ইনুর গুরু ভানু বোস, ভানুর গুরু গোপাল পাঁঠা। তাই ননী দত্ত কোনও যে-সে রুস্তম ছিলেন না। বাংলা তথা কলকাতার সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের অংশ ছিলেন ননী। বিরাট নেটওয়ার্ক।
এহেন ননী এসে হাজির গ্রাহামস রোডে। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই আসতেন এই বিশাল বাড়িটায়। এই ঘটনার পরই এলাকার মানুষ ভাবতে বসল, তাদের ফ্যাতন মামা লোক তো মোটেই সহজ নয়! তবে ফ্যাতনকে বোঝার ক্ষমতা আশপাশের মানুষের থাকতে পারেই না। ফ্যাতন এক গভীর এপিসোড।
একটা সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবাই যোদ্ধা হয় না। কেউ ছক করে। প্ল্যান বানায়। কেউ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়। কেউ আবার আড়ালে থেকে গোটা বিষয়টা তদারকি করে। তেমনই সমস্যায় ফেঁসে গেলে আইনি পরামর্শ দেওয়া, এলাকা ছাড়া হলে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় দেওয়া, প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য একজন লোক তো চাই। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেই বিশ্বস্ত অভিভাবকের নামই ফ্যাতন গোস্বামী। গ্রাহামস রোডের সাধারণ মানুষ তাঁর নাগাল পাবে কীভাবে? এখানেই তিনি এক গভীর চরিত্র। মস্তানদের আশ্রয়দাতা, পরামর্শদাতা, সর্বোপরি প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়কারী।
ফ্যাতন গোস্বামীর বাড়িতে ছিলেন হাতেগোনা জনা কয়েক লোক। নিজের সন্তান ছিল না। একজনকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু টানা বারান্দাওয়ালা এই বাড়িতে ঘর ছিল অসংখ্য। কার জন্য, কাদের জন্য এত ঘর? ফ্যাতনের বাড়ির নীচতলায় কেউ কেউ এসে দীর্ঘদিন থাকত। ফ্যাতন বলতেন ভাড়াটিয়া কিন্তু যে কেউ বুঝত, এসব অন্য জগতের মানুষ।
ধীরে ধীরে ফ্যাতনের কর্মকাণ্ড বুঝে নিতে পেরেছিল এলাকাবাসী। ততদিনে গ্রাহামস রোডের ফ্যাতনের বাড়িতে পায়ের ধুলো পড়েছে প্রবাদপ্রতিম গোপাল পাঁঠার। এসেছেন কলকাতার পয়লা নম্বর ডন ভানু বোস। আরও অনেকে। আশপাশের বাহুবলীরা তো নিত্য অতিথি। যেমন নিখিল বসুরায়, ননী দত্ত, ননীর শিষ্য বোম— কত নাম।
আরও পড়ুন- মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! বাঘাযতীনের মস্তান কানা অজিত আজও কিংবদন্তি
ফ্যাতন গোস্বামীর বাড়িতে প্রায় শুরুর দিন থেকেই আশ্রয় নেন ইনু মিত্তির। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট আমলে ইনুর বেলঘড়িয়ায় বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সিপিআইএমের বাহুবলী ননী সাহা। ননীর তাণ্ডবে এলাকা ছাড়া হন ইনু। সেই সময়েই টালিগঞ্জে ফ্যাতন গোস্বামীর এই বাড়িতে শেল্টার নেন ইনু। পরে শ্রীকলোনির ভেতরেও এক বাড়িতে ছিলেন।
একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। পাবনা থেকে এসে বেলঘড়িয়ায় বাড়ি করেছিলেন ফ্যাতন। ওই বাংলো বাড়িটাতেই ইনু-ভানু সহ রাজ্যের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবার অবাধ যাতায়াত ছিল। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরই ননীর তাণ্ডবে ইনু যখন ঘর ছাড়েন, ফ্যাতনও সেই বছরেই টালিগঞ্জ গ্রাহামস রোডে থিতু হন। ফ্যাতনের এই বাড়ি তৈরিতে কি ইনুর ইন্ধন এবং অর্থ সাহায্য ছিল? আজ এই নিয়ে নিশ্চিত বলা খুব মুশকিল তবে তথ্য বলছে, ইনুর সঙ্গেই একই সময়ে বেলঘড়িয়া ছেড়েছিলেন ফ্যাতন গোস্বামী।
এই বাড়িতেই ইনু মিত্তির থাকতেন দিনের পর দিন। কলকাতার সেরা মস্তান ভানু বোসের এক ভাই থাকত বাড়ির একতলায়। ফ্যাতন গোস্বামীর একটা খুঁটি ছিল কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে। অমল ভট্টাচার্য। এই এসবি-র অফিসার প্রায় সন্ধেয় আসতেন ফ্যাতনের আতিথেয়তায় সাড়া দিয়ে। আজকের গ্রাহামস রোড আর পাঁচটা পাড়ার মতোই। ইন্দ্রপুরী স্টুডিও কার্যত মরে গেছে। কিন্তু ১৯৬৭-৬৮ সালে ওই চত্বর গমগম করছে। স্বর্ণযুগের তারকারা আসছেন ইন্দ্রপুরীতে শ্যুটিংয়ে। পাশেই টালিগঞ্জ রেস কোর্সের মাঠ। সেখানে কলকাতার নামী মস্তানদের ঘোড়া মাঠে খাটছে। এমনকী বম্বের কোনও কোনও অভিনেতার ঘোড়াও দৌড়চ্ছে রেসের মাঠে। টালিগঞ্জের রেসের মাঠের বুকি রোবো খান ক্রমে এলাকায় শক্তি বাড়াচ্ছে। বাংলা কংগ্রেস, বামপন্থী দলগুলোর হয়ে মস্তানির মাঠ কাঁপাচ্ছে রোবো খান। এহেন সময় টালিগঞ্জে ফ্যাতনের বাড়ি বেশ আধুনিক জায়গায়। খ্যাতি এবং বিড়ম্বনা দুই নিয়েই জমজমাট।
অলক্ষ্যে আরও একজন ছিলেন ফ্যাতনের খুঁটি। রুনু গুহ নিয়োগী। অনুমান করা যেতেই পারে, এইসব হাই প্রোফাইল যোগাযোগগুলিকে কাজে লাগাতেন ফ্যাতন এবং অবশ্যই মোটা অঙ্কের সাম্মানিক সহ। স্থানীয় প্রবীণ মানুষদের মতে, বিভিন্ন জায়গায় ডাক পড়ত ফ্যাতন গোঁসাইয়ের। নানা জটিল ঝামেলার মীমাংসার জন্য।
আরও পড়ুন- বিস্ফোরণে উড়েছিল ডান হাত! এক হাতে এলাকা কাঁপিয়েও খুন হন মস্তান দেবা দত্ত
পরের দিকে টালিগঞ্জে কংগ্রেস সংগঠনের জন্য সক্রিয়ভাবে সাহায্যও করতেন ফ্যাতন গোস্বামী। আসলে বাহাত্তর সালের নির্বাচনের আগে বিধানসভা ভিত্তিক কংগ্রেসকে মজবুত করতে বাহুবলী সমন্বয়ের কাজে বিশেষ সক্রিয় ছিলেন ফ্যাতন। সেই কারণে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে 'প্রোটেকশন' দিতে বাড়ির নীচে পুলিশ ক্যাম্প বসত। কোথাও তাঁকে নিজেকে নামতে দেখা যায়নি। যদিও মস্তানকুলের খোঁজখবর রাখা কারও কারও মতে নিজের টিম ছিল ফ্যতানের। তবে সমন্বয়ক হিসেবেই কাজ করতে দেখা গেছে তাঁকে। আর ব্লু প্রিন্ট সাজাতেন অবশ্যই। সিআইডি কর্তাদের সঙ্গেও ওঠাবসা ছিল ফ্যাতনের। প্রয়োজনে কেউ বাড়াবাড়ি করলে সিআইডি লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখতেন, করেওছেন এই কাজ বহুবার। তবে প্ল্যানিংয়ে ফ্যাতন ছিলেন সেরা।
অন্যদিকে, নীল নকশা সাজানোর পাশাপাশি অ্যাকশনেও নামতেন ফটিকবাবু। গ্রাহামস রোডেরই বাসিন্দা ফটিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ফ্যাতনের মতোই কলকাতার মস্তানদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় ফটিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সেই সূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল এই লাইনের আদি গুরু গোপাল পাঁঠার সঙ্গে। ফটিকও মস্তানদের পরামর্শদাতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড এই মানুষটিকে কোডনামে চিনত 'দাদু' বলে।
তবে ফ্যাতন গোস্বামীর নাম ও বিস্তার নিশ্চয়ই অনেক বেশি ছিল। একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল। ফ্যাতন গোস্বামীর কোনও নিজস্ব বাহিনী ছিল না, থাকলেও এ নিয়ে খুব তৎপরতা দেখা যেত না। ফটিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী ছিল। নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে বাহিনী চালাতেন এই প্রৌঢ়।
বাম রাজনীতির সঙ্গে মিলিট্যান্ট ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সেসময় জড়িয়ে ছিল। ট্রেড ইউনিয়ন দমাতে বহু কারখানা মালিক ফটিকের গ্যাং ভাড়া করত। দক্ষিণ কলকাতার শিশুমঙ্গল হাসপাতালের বিপরীতে ইস্টবেঙ্গল বেকারি বলে একটা রুটির কারখানা ছিল। সেখানে প্রতিদিন ছিল বাম ইউনিয়নের দাপট। ব্যবসা প্রায় লাটে ওঠার জোগাড়। এমন সময় কারখানার মালিকপক্ষ যোগাযোগ করে মস্তানদের 'দাদু' ফটিকের সঙ্গে। বাহিনী নিয়ে প্রতিরাতে পাহারা দিতেব ফটিক বাঁড়ুজ্জ্যে। একদিন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভর দিয়ে পান খেতে রাস্তায় বের হলেন। আর এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিল আততায়ীরা। সুযোগ হাতের মুঠোয়। পরপর গুলি চলল ফটিকের চওড়া বুক লক্ষ্য করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন দাদু। তখন তাঁর আশি বছর বয়স। ফ্যাতন ছিলেন রসেবশে থাকা মানুষ। একদিন পরিণত বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যুই হয় তাঁর। ফ্যাতন গোঁসাই আর ফটিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কলকাতার মস্তানকুল হারিয়েছিল অভিভাবকদের ছায়া।