বিশ্বের কাছে এখনও অধরাই থেকে গিয়েছেন নজরুল
Kazi Nazrul Islam: শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষায় 'লাঙল'-এর প্রস্তাবনায় যে কথাগুলি লিখলেন নজরুল তাকে কীভাবে সরিয়ে রাখা সম্ভব হল?
মফসসলের স্কুলের একটা সুবিধে ছিল, পড়ার সঙ্গে অনেকটা ছিল 'টড়া'! বারোমাসে তেরোর থেকে অনেক বেশি পার্বণ আর তার উদযাপন। সেখানেই প্রথম সুর আর ছন্দের সমবেত প্রয়াসে কামালপাশা-র সঙ্গে পরিচয়। বিশ্ব ইতিহাস কিছুই জানা নেই, তবু শুধু মাথা নয় শরীরের ভিতরে কেমন যেন এক চঞ্চলতা আর উত্তেজনা। যেন আমরাও ক্ষেপে উঠছি। যেন সেই আপাত শান্ত গ্রামবাংলার ছোটছোট জনপদে আমরাও এক একজন পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! আমাদেরও মনের মধ্যে একটা হই-হই-রই-রই ব্যপার! শারীরশিক্ষার ক্লাসেও ঘুরে-ফিরে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ছিল তুর্কি যুবকের জোশ! কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্র-নজরুল শুনতে শুনতে কানে যা থেকে গেল বিশেষত নজরুল, তা অনেকটাই সেই মধ্যপ্রাচ্যের সুরের মায়া। পড়ার বইয়ের কিছু কবিতা আর তিরিশ-চল্লিশের কবি প্রাবন্ধিকদের শহুরে আভিজাত্য আর বিদেশি সাহিত্য প্রীতি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা কেমন করে যেন তৈরি করে দিল গ্রহণ আর বর্জনের নতুন এক মাপকাঠি। নজরুল আমার বোধের জগৎ থেকে সরে গেলেন বেশ কিছুটা।
জীবন এক আশ্চর্য খতিয়ান। মাঝপথে ছেড়ে গেলে আনপথে তার সঙ্গ জুটে যায় অনেক ক্ষেত্রেই। হিসেব-নিকেশ শুরু হয় তখন নতুন করে। আমারও নজরুলের সঙ্গে বোঝাপড়া শুরু হলো এক্কেবারে নতুনতর এক বাঁকে। নজরুলের জন্মের মফসসল চুরুলিয়ার ধার ঘেঁষে ততদিনে তৈরি হয়েছে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তর উপনিবেশের ভাবনায় নজরুলকে নিয়ে নতুন করে গবেষণা অর্থাৎ ফিরে দেখার কার্যক্রমে জুড়ে যাওয়াও তেমনই একটা আনপথ আমার জীবনে। শুরু হলো পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত সাত খণ্ডের নজরুল রচনাসংগ্রহ একেবারে আগাপাশতলা খুঁটিয়ে পড়ে ফেলা। বুদ্ধদেব বসুদের সমস্ত মশকরার গল্প ক্রমশ ফিকে হতে হতে মাথার মধ্যে নতুন এক বোধের জন্ম শুধু নয় বিস্তার শুরু হয়ে গেল এত অল্পদিনে যে তখন একেবারে হুলুস্থুলু ব্যাপার! সারাক্ষণ নতুন এক নজরুল ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরাকে চিনিয়ে দিতে যে শুরু করলেন তা আজও অব্যাহত। রাজনীতি, সমাজনীতির কৌশলগুলিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ইতিহাসকে নতুন করে বুঝতে শুরু করা গেল যেন।
আরও পড়ুন: এই বিভক্ত ভারতে নজরুলের দর্শন চর্চার খুব প্রয়োজন
মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে থেকে যে নজরুল ডিসেম্বরের সমস্ত শীতার্ততাকে নস্যাৎ করে এক রাতের জ্বরের ঘোরে পেনসিলে লেখেন 'বিদ্রোহী'-র মতো কবিতা, তাকে কীভাবে সরিয়ে রাখা সম্ভব হলো বাঙালি বুদ্ধিমত্তার মানচিত্র থেকে ভেবে ভেবে অকুল পাথারে তখন । আসলে আমরা যারা বিদ্যাচর্চা করার চেষ্টা করি, তারা বড্ড বেশি তত্ত্বকথায় বিশ্বাসী হয়ে উঠি পদে পদে। তাই মহাজনদের নির্দেশকেই মনে হয় শেষ সত্য। অথচ নিজে নিজে কিছুটা পথ যদি হাঁটা সম্ভব হয় কোনও তাগিদে, তখন শচীশের মতোই অবস্থা হয় আমাদের! ঘরের চার দেওয়ালের চাপমুক্ত হয়ে মানুষ বোধহয় নিজের বোধ আর বিশ্বাসকে নতুন করে দেখার একটা শক্তি পেয়ে যান। আমার নজরুল তাই আমাকে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়িয়ে নেন তাঁর লেখা গদ্য রচনা। সেগুলি কখনও সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, কখনও বক্তৃতা, কখনও চিঠিপত্র, কখনও ভাষণ আর কখনও তা ইস্তাহারও বটে! গল্প, উপন্যাসও।
শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষায় 'লাঙল'-এর প্রস্তাবনায় যে কথাগুলি লিখলেন নজরুল তাকে কীভাবে সরিয়ে রাখা সম্ভব হল বিগত এতগুলি বছরের মানববিদ্যাচর্চায় কিংবা সরাসরি মানব উন্নয়নের কার্যক্রমে, তা ভেবে অবাক লাগে। ভিতরে ভিতরে মানসিক চাপ তৈরি হয়। একা একা এইসব অনুভূতি নিয়ে বসে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। ঠিক হয় নতুন করে গবেষণা শুরু করতেই হবে। তারজন্য প্রথমত বৃহত্তর মানুষের কাছে মূলের ভাবনা-চিন্তার এই প্রস্থানকে পৌঁছে দেওয়া আশু প্রয়োজন। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে ততদিনে নজরুলের লেখালিখির সংকলন হাতের কাছে তিন-চার সেট। অথচ সে খবর গ্রন্থাগারের আর সংগ্রহশালায় শোভা বৃদ্ধি করে কিংবা করে না মাত্র! মাথার মধ্যে পোকা কিলবিল! নোবেল পেয়ে যে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাঁকেও খুঁজে নিতে হয়েছিল তার রচনার বৈশ্বিক যোগাযোগের ভাষায় অনুবাদের পথকে। তাই প্রথমে নজরুলের অতি পরিচিত কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা'র ইংরিজি আর নেপালি অনুবাদের কাজ শুরু হলেও মনে হয়েছিল নজরুলের গদ্য অনুবাদ হওয়া জরুরি। দক্ষিণ-এশিয় প্রাদেশিক একটি ভাষার আগল মুক্ত করে নজরুলের ভাবনার পরিসরকে বিস্তৃত করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মনে হয়েছিল পৃথিবী জুড়ে মানুষের পরিচয়কে সাম্প্রদায়িক, জাতি-কেন্দ্রিক, শ্রেণি-নির্ভর, লিঙ্গভিত্তিক তকমায় এঁটে ক্রমশ যে বেঁটে আর খাঁটো করে রাখার চক্রান্ত চলছে দেশে দেশে, সে দেশ উন্নত বা অবনত-যাই হোক না কেন; তাকে রুখে দিতে যে সমস্ত প্রয়াসের কথা জানা যায়, শোনা যায়, তা সবই যে বিশ্বের উত্তরার্ধের অবদানমাত্র নয় নয়, তা প্রমাণের দায় বর্তায় আমাদের ওপরও!
যে সমস্ত বৈশ্বিক সম্মান বিশিষ্ট চিন্তকদের পৃথিবীর তাবৎ মানুষের কাছে কিছুটা হলেও পৌঁছে দিতে পারে, তা নজরুল পাননি এখনও। কিন্তু তাঁর ভাবনার রসদ বর্তমান পৃথিবীর অসুখের কতখানি শুশ্রুষা হতে পারে তা হাতে হাতে প্রমাণের জন্য কিছু কাজের পাগলামি পেয়ে বসে কাজের পাগলামি পেয়ে বসে। সেই পথে হেঁটে ঠিক করা হয় কবি আর সঙ্গীতজ্ঞ পরিচিত নজরুলের প্রায় অপরিচিত সত্তাকে গুরুত্ব দিতেই শুরু কিছুটা অন্যধারার কাজ। সাংবাদিক নজরুলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর সমাজনীতির গভীরতর বিশ্লেষণী মনোভঙ্গি যে আজও কতটা প্রয়োজনীয় তা প্রমাণ করল তরুণ সাংবাদিক অর্ক দেবের গবেষণা ও অনুবাদকর্ম। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা থেকে ২০২৩-এ ব্লুমস্বেরি থেকে প্রকাশিত হল 'কাজী নজরুল ইসলাম'স জার্নালিজম: আ ক্রিটিক'। প্রখ্যাত অধ্যাপক ও অনুবাদক রাধা চক্রবর্তী অনুবাদে ও সম্পাদনায় পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস ২০২৪-এর পয়লা জানুয়ারি প্রকাশ করেছে 'সিলেক্টেড এসেজ: কাজী নজরুল ইসলাম'। এরপর মে, ২০২৪-এ ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সোয়ান প্রকাশ করেছে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম এবং কৌস্তভ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় নজরুলের ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ 'দ্য কালেকটেড্ শর্ট স্টোরিজ অফ কাজী নজরুল ইসলাম।
এসব খতিয়ান শুধু পেশ করার জন্যই পেশ করা নয়। দক্ষিণ-এশিয় একজন তথাকথিত সাব-অলটার্ন মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রস্থানভূমিটি আড়ে-দৈর্ঘ্যে কতটা যে জুড়ে আছে জমিন আর আসমানকে তা নতুন করে দেখা আজকের পৃথিবীতে বড় বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারতবাসী হিসেবে সাতাত্তর বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা উপনিবেশের চাপ। কিন্তু সূর্যের মতোই আজও দিনান্তে পশ্চিমমুখীমাত্র হয়ে থাকা নিয়তিকে ধীরে ধীরে বদলে ফেলার রোখ যে আমাদের পেয়ে বসেছে, তাতে চিন্তক নজরুল একটি জোরালো নাম। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কিংবা সরাসরি পাঠক না হয়েও বিচিত্র জীবনযাপন যে অভিজ্ঞতায় শিক্ষিত করেছিল ওঁকে, তা এই ভূমিজ হয়েও বৈশ্বিক, তা প্রমাণিত হচ্ছে ক্রমশ। ওয়ার্ল্ড নজরুল কংগ্রেসের আয়োজনে সুদূর স্পেন দেশের মাদ্রিদ থেকে আইতোর সোলানা তাঁর রবাবে বাজিয়ে শোনান যখন নজরুলের সুর আর তার তুলনায় স্পেনের কোন একটি অঞ্চলের নিজস্ব সংঙ্গীতের ধারাটির মিল ধরে দেন অনায়াসে, তখন আমরা শুধু নই, মুগ্ধ হন বিশ্ববাসী। ইরানের নিক্নাজ্ মিরগালানী তাঁর বিশেষ তারযন্ত্র তাম্বুরে বাজিয়ে শোনান নজরুলের কম্পোজিশনের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য! লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তিনি তখন। নজরুল কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সুর, স্বর আর ভাবনার রূপকে ধরে রাখেন তাঁর সঙ্গীতের পরতে পরতে নিক্লাজ বাজিয়ে শোনান, ব্যাখ্যা করে নোটেশনের আশ্চর্য মিলগুলিকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা শহর আসানসোলে বসে যখন আমরা এই কাজগুলি করছিলাম তখন সত্যিই আমরা জুড়ে যাচ্ছিলাম পৃথিবীর কতগুলি দেশের কত মানুষের ভাবনার জগতে তা আজ গুণে গুণে বলাও সম্ভব নয়। এই জুড়ে যাওয়াটা কালের নিরিখে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা টের পাই প্রতিদিন। আমেরিকার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস আন্দোলনের ইস্তেহারে নজরুল হয়ে ওঠেন ভাষিক প্রতিবাদের অন্যতম মুখ।
আরও পড়ুন:নজরুলকে এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমরা: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল
প্রাজ্ঞ অধ্যাপকের কঠিন বর্ম কতটা খসল তা হয়ত রাধা চক্রবর্তীর কাজের নিরিখে কিছুটা হলেও হালে পানি দিতে পেরেছে। খোদ রাজধানীতেও শুরু হয়েছে এ নিয়ে আলোচনা কিংবা তর্জা। কৌস্তভ কিংবা অর্ক-র কাজ ভরসা তৈরি করছে নতুন প্রজন্মের জন্য। আমার মতো নাছোড় স্বপ্নদেখিয়ে ভাবছে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। ক্লান্ত হওয়ার উপায় নেই। থামা বলে কিছু নেই। সমস্ত প্রতিবাদে, ভালোবাসায়, গ্রহণে, বর্জনে নজরুল কীভাবে কীভাবে যেন বড় বেশি মানবিক হয়ে ওঠেন প্রতিদিনের যাপনে। কথা আর চর্যার ফারাক মুছে দিতে সাহায্য করে ওঁর জীবন। ভালোয়-মন্দে যে একজন মানুষ নজরুল তাঁকে আভিবাদন জানাতে প্রাণ চায় প্রতিদিন।