মাত্রাছাড়া দূষণ, গত তিন দশকে তিলে তিলে যে ভাবে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠল দিল্লি
Delhi Pollution: বায়ু দূষণের জেরে ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছে রাজধানী। ফলে প্রচুর বিমান বাতিল করা হচ্ছে। দিল্লিগামী ট্রেনও দেরিতে চলছে।
গত কয়েকদিন ধরেই ভয়াবহ দূষণে বিপর্যস্ত দিল্লি। রাজধানীতে এই ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। প্রতিবার শীত পড়তে না পড়তেই দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে দিল্লি জুড়ে। কার্যত বিষাক্ত গ্যাসচেম্বারে পরিণত হয় রাজধানী দিল্লি। গত কয়েকদিনে সেই দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দৈনন্দিন জীবনযাপনেও জারি করা হয়েছে বিধিনিষেধ। বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমাগত খারাপ হওয়ার কারণে সরকারি অফিসগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন সময়সূচি করে দেওয়া হয়েছে, নির্মাণ কাজে নিষেধাজ্ঞা এবং গাড়ি চলাচলের নিয়মেও আনা হয়েছে কড়াকড়ি। প্রাইমারি স্কুলগুলিতে পাঠদানের প্রক্রিয়া চলছে অনলাইনে। দূষণের কারণে দিল্লির রাস্তাঘাটে দৃশ্যমানতা কমেছে। গোটা শহরই যেন কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে। যার জেরে বেড়েছে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা। কেন প্রতিবার শীত এলেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ে দিল্লি?
শীত এলেই কেন দূষণ?
শীতকালের ঠান্ডা আবহাওয়া ও বাতাস দূষিত কণাগুলিকে বায়ুমন্ডলেই রেখে দেয়, এতে দূষণ বেড়ে যায়। তাছাড়া দিল্লির আশপাশে প্রচুর কারখানা রয়েছে যেখানে নির্মাণ কাজ চলে, ফলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকটাই। দিল্লির আশেপাশের রাজ্য যেমন পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা প্রায়শই এ সময়টায় ফসলের গোড়া পুড়িয়ে থাকেন, যা ধোঁয়া তৈরি করে। এ সব কারণে প্রতিবছর শীত পড়তে না পড়তেই দিল্লিতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এই সময় দিওয়ালি উপলক্ষে আতসবাজি পোড়ানোর জেরেও দূষণ ভয়াবহ রূপ নেয়। এ বছর ১২ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত একটি সমীক্ষা করেছিল সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট। সেইসমীক্ষার তথ্য বলছে, দিল্লির দূষণের জন্য গাড়ির ধোঁয়া দায়ী ৫১.৫ শতাংশ, শহরটির পার্শ্ববর্তী এলাকা দায়ী ৩৪.৯৭ শতাংশ এবং ফসলের গোড়া পোড়ানোর ধোঁয়া দায়ী ৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন: গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড
কবে থেকে দিল্লির দূষণের বাড়বাড়ন্ত?
তিন দশক আগে থেকেই দিল্লিতে বায়ুদূষণের সমস্যা ছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট দূষণ নিয়ে দিল্লির সরকারকে সতর্ক করেছে। তবে তথ্য বলছে, এর আগেও সুপ্রিম কোর্ট-কে দিল্লির দূষণ নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ডাউন টু আর্থের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল থেকেই রাজধানী দিল্লিতে দূষণের মাত্রা বাড়ে। এর পর ১৯৮৬ সালের পরিবেশ আইন এবং ১৯৮১ সালের দূষণ প্রতিরোধ আইন কার্যকর করা হয়। ১৯৯৬ সালেই সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট 'স্লো মার্ডার' নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সে সময়ে স্বতপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা জারি করে দিল্লি সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল, বায়ু দূষণ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার। তখনই শীর্ষ আদালত শিল্প-কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৯০ সালে শীর্ষ আদালত দূষণ কমাতে দিল্লি সরকারকে দিয়ে একটি মাস্টার প্ল্যানও তৈরি করিয়েছিল।
১৯৯০ সালের মাস্টার প্ল্যানে কী ছিল?
- নির্দেশ ছিল, দূষণ তৈরি করে এমন সকল শিল্প-কারখানা ৩ বছরের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। ১৯৯৭ সালের মধ্যেই এই কারখানাগুলির কাজ অন্য এলাকায় করতে হবে।
- শহরের সমস্ত বাণিজ্যিক যানবাহনগুলিকে সিএনজি-তে রূপান্তরিত করার নির্দেশ ছিল। যে সব নতুন চার চাকার গাড়ি তৈরি হচ্ছে তাতে ক্যাটালিক কনভার্টার (গাড়ির দূষিত গ্যাস তুলনায় কম ক্ষতিকর গ্যাস হয়ে নিঃসৃত হয়) লাগানোর কথা বলা ছিল।
- পেট্রোল ও ডিজেলে সালফার কনটেন্ট কমানোর কথা বলা হয়েছিল।
- গণপরিবহণ বাড়াতে বাসের সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
মাস্টার প্ল্যান মেনে কতটা কাজ হয়েছে?
মাস্টার প্ল্যান অনেকটাই কার্যকর হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য তার পরেও রাজধানী দিল্লিতে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা কমেনি। প্রতিবছরই এই সময় দিল্লির দূষণের মাত্রা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে যায়। পিআইবি-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গড় একিউআই সবচেয়ে বেশি ছিল অক্টোবর থেকে জানুয়ারির, এই সময়টায়। রাজধানী দিল্লির বাতাসে ক্ষুদ্র কণা PM 2.5-এর মাত্রা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপত্তা নির্দেশনায় যত মাত্রায় থাকার কথা উল্লেখ করেছে, তার চাইতেও বেশি। সোমবার দিল্লিতে PM 2.5 (মাইক্রোস্কোপিক দূষক) সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পৌঁছেছিল। দুপুর ১২টা নাগাদ প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে এই দূষক ৮২০ মাইক্রোগ্রামে পর্যন্ত পৌঁছেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দূষকের যে মাত্রা নির্ধারণ করেছিল তার থেকে যা ছিল প্রায় ১৬৪ গুণ বেশি।
ক্ষতির খতিয়ান
মঙ্গলবার সকালে দিল্লির একিউআই ছিল ৫০০-র বেশি। ২০২১ সালে একিউআই-এর মাত্রা ৪০০-র কাছাকাছি পৌঁছেছিল। বায়ুর গুণগত মানের সূচক বা একিউআই অনুসারে, বাতাসে এই কণার মাত্রা শূন্য থেকে ৫০ হলে তাকে 'ভালো' এবং যদি ৫১ থেকে ১০০ হয়, তাহলে তা 'সন্তোষজনক' বলে ধরে নেওয়া হয়। এই ক্ষুদ্র কণা মানব শরীরে গেলে ফুসফুসের গুরুতর সমস্যা হতে পারে। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।
বাড়ছে পথ দুর্ঘটনা
বায়ু দূষণের জেরে ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছে রাজধানী। ফলে প্রচুর বিমান বাতিল করা হচ্ছে। দিল্লিগামী ট্রেনও দেরিতে চলছে। শহরের হাইওয়েগুলিতে ভোরের দিকে এবং রাতে কুয়াশায় দৃশ্যমানতা কমে যাচ্ছে। যার জেরে সামান্য দূরে থাকা জিনিসও স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা হচ্ছে। নয়ডা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এলাকাগুলিতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ বাইক আরোহীর মৃত্যু হয়েছে এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন। একইভাবে বুলন্দশহর ও মৈনপুরীতে ট্রাকের ধাক্কায় ২ বাইক আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। ধোঁয়াশার জেরে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় রাস্তা ভালো করে দেখতে পারেননি চালক, যার জেরেই এই দুর্ঘটনা। অন্য আরেকটি ঘটনায় ১২ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। একটি খারাপ ট্রাক ইস্টার্ন পেরিফেরিয়াল এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিল, ধোঁয়াশায় দেখতে না পেয়ে বাসটি গিয়ে ট্রাকটিকে ধাক্কা মারে। ধোঁয়াশার কারণেই ফিরোজাবাদে ৬টি গাড়ি ধাক্কা খায়। আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতেও গাড়ি ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: ভারতে এক বছরে ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে! যেসব ভয়াবহ সত্য প্রকাশ রিপোর্টে
শুধু রাজধানী দিল্লিতেই যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা নয়। দূষণের তালিকায় নাম রয়েছে আরও বেশ কিছু রাজ্যের। বলে রাখা ভাল, আন্তজার্তিক সংস্থাগুলি বায়ুদূষণের তালিকা বের করলে প্রায় প্রতিবারই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাম থাকে। WHO যে মাত্রার দূষণকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে, ভারতের বেশ কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা তার থেকে অনেক বেশি। ২০১৮ সালে গ্রিনপিসের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২২টিই ভারতের। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট-এর তথ্য বলছে, ভারতে প্রায় ১০ লক্ষের বেশি মানুষ মারা যান বায়ু দূষণের কারণে। ভারতের ছোট থেকে বড় যে কোনও শহরেই সারা বছর ধরে যে পরিমাণ বহুতল নির্মাণের কাজ চলে, তাতেও বায়ু দূষণ অনেকটাই বেড়ে যায়। বায়ুদূষণ থেকে নিস্তার পেতে তাই এখন কড়া পদক্ষেপ করা একান্তই জরুরি। গণপরিবহণ বাড়ানো, বহুতল নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ-সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য যে যে নীতি নির্ধারণ করা এই পরিস্থিতিতে জরুরি, তা আদৌ সরকার করবে কি না সেটাই এখন দেখার।