ইজরায়েলি বোমা কেড়েছে সদ্যোজাত দুই সন্তান, স্ত্রী! শূন্যতা আগলে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ‘একা’ যুবক

Gaza-Israel War: দুই সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীর দেহাংশ নিয়ে যখন শেষকৃত্য করতে পৌঁছলেন, জানাজা করার আগে ইমাম বললেন, "খোদা যেন তোমাদের জন্নতে গিয়ে মিলিয়ে দেন।" সত্যি কি ওঁদের সঙ্গে দেখা হবে আর কুমসানের?

মৃত্যুপুরী গাজা। ইজরায়েলি আগ্রাসনে গোটা শহরটাই একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবু তো তার পরেও মাটির বুকে ফোটে ফুল। জন্মায় সবুজ পাতার মতো শিশু। আর সেই সদ্য প্রাণ, স্বপ্ন সবকিছুকে ধ্বংস করে দিয়ে যায় একনিমেষে ইজরায়েলি সেনার হানা একেকটা রকেট, গুলি, বোমা। গাজায় বসবাস করা প্রতিটি ফিলিস্তিনি জানেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ জুড়ে এখন শুধুই অন্ধকার, তার পরেও আলো খোঁজেন তাঁরা।

যেমন পেয়েছিলেন মহম্মদ আবু আল কুমসান। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে কুমসানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পেশায় ফার্মাসিস্ট জুমানার। বিয়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে 'টুগেদার ফরএভার' স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই একসঙ্গে চলার পথ যে এত সীমিত, এত কম, তা কি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিলেন কুমসান। জুলাই থেকে অক্টোবর, এই কয়েকটি মাস তাঁদের জন্য ছিল স্বপ্নের মতো। তার পরেই ইজরায়েলে ঢুকে হামলা চালাল হামাস। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল ইজরায়েল। সেই তখন থেকেই খারাপ সময় শুরু হল গাজায় বসবাসকারী মানুষদের।

খবরটা শোনার পর সেন্ট্রাল গাজার আল আকসা হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মহম্মদ আবু আল কুমসান। মাত্র কয়েকদিনই হয়েছে জুমানা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যমজ সন্তান হয়েছে তাঁদের। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। আদর করে একজনের নাম রেখেছেন আইজল, ছেলেটির নাম আসের। এত অন্ধকারের মধ্যেও পুতুলের মতো দু'টি সন্তানের মুখ যেন জীবনে বাঁচার নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল কুমসানদের।

আরও পড়ুন: নিরাপদ আল-জালা রাতারাতি যুদ্ধক্ষেত্র! ইজরায়েলের হুমকি পেয়ে খান ইউনিস ছাড়ছেন হাজার হাজার গাজাবাসী

স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা জানার পরেই তাঁর নিরাপত্তার কথা ভেবে দেইর আল-বালাহের একটি অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে এসেছিলেন জুমানাকে। ভেবেছিলেন, এই জায়গাটা অন্তত সুরক্ষিত ইজরায়েলি সেনার হাত থেকে। ভুলেই গিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গাজায় সুরক্ষিত বলে কিছু নেই আর। গোটা শহরটাকেই শ্মশানে পরিণত করেছে ইজরায়েলি সেনা।

সেই গত অক্টোবর থেকে গাজায় হামলার পরে হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। গুঁড়িয়ে দিয়েছে একের পর এক হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মস্থান। এমনকী শরণার্থী শিবিরগুলিকেও ছাড়েনি ইজরায়েলি সেনা। গুঁড়িয়ে দিচ্ছে নাগরিকদের বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু। যেমনটা হয়েছে কুমসানের সঙ্গে। সদ্যোজাত দু'টি শিশুর জন্মের শংসাপত্র সংগ্রহ করতে দেইর আল-বালাহের ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অল্পক্ষণের জন্য বেরিয়েছিলেন কুমসান। ঘরের ভিতরেই ছিলেন স্ত্রী ও দুটি সন্তান। কিছু দূর যেতে না যেতেই ফোন পান, ইজরায়েলি বোমা এসে আঘাত করেছে তাঁদের ওই অ্যাপার্টমেন্ট। আর মুহূর্তেই শেষ সব।

সেই হামলায় মারা যায় স্ত্রী জুমানা ও সদ্য জন্মানো দুটি যমজ শিশুরও। কুমসানের মনে পড়ে যায়, যেদিন আইজল আর আসের হয়, ডাক্তারদের কাছে কীভাবে পীড়াপীড়ি করেছিলেন, তাঁদের একঝলক দেখতে দেওয়ার জন্য। সেদিন বেরোনোর সময় একবারও কি ভেবেছিলেন, আর কোনও দিন দেখাই হবে সদ্যোজাত সন্তান দু'টির সঙ্গে, দেখা হবে না প্রিয়তম স্ত্রীর সঙ্গে আর।

আল আকসা হাসপাতালে তখন অজস্র স্বজনহারা মানুষের ভিড়। যার মধ্যে কুমসানও একজন। মাথা ঠিক রাখতে পারেননি কুমসান। সঙ্গ দেয়নি শরীরও। কাঁদতে কাঁদতে সংজ্ঞা হারান তিনি। দুই সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীর দেহাংশ নিয়ে যখন শেষকৃত্য করতে পৌঁছলেন, জানাজা করার আগে ইমাম বললেন, "খোদা যেন তোমাদের জন্নতে গিয়ে মিলিয়ে দেন।" সত্যি কি স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে আর এ জীবনে বা জীবনের পরে দেখা হবে কুমসানের! হাঁটু মুড়ে চোখের জলে ভেসে এ কথাই কি ভাবছিলেন হতভাগ্য এই বাবা-স্বামী।

সেদিনের সেই হামলায় অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল গাজার দেইর আল-বালাহে। তার মধ্যে যেমন ছিল কুমসানের স্ত্রী ও সন্তান, তেমনই ছিল আরও শিশু। আর এটাই গাজার বাস্তব এই মুহূর্তে। ইজরায়েলের ছোড়া একের পর এক বোমা-গুলি-হামলায় অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, হয়েই চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ইজরায়েলের অক্লান্ত বোমাবর্ষণে সাম্প্রতিক কালে অন্তত ১১৫টি শিশু জন্মেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতাকে এক অলৌকিক ঘটনা বলে বর্ণনা করে দু'দিন আগেই সোশ্য়াল মিডিয়ায় একটি পোস্ট দিয়েছিলেন জুমানা। অলৌকিকই বটে। এত মৃত্যু, এত ধ্বংসের মধ্যেও যে পাথরে ফুল ফোটে, তা তো অবাক কাণ্ড বটেই। কিন্তু ইজরায়েলি আগ্রাসন এসে বারবার এসে কেড়ে নেয় সেই সব ফোঁটা কুঁড়ি। মৃত্যুর, স্বজন হারানোর কালো ছায়া এসে ঢেকে দেয় কুমসানদের।

৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। তার পর থেকে অক্লান্ত ভাবে গাজায় হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। হামাসকে না শেষ করে বিশ্রাম নেবেন না হুমকি দিয়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তবে হামাস জঙ্গি কতজন খতম হয়েছে বলা কঠিন, শেষ হয়ে গিয়েছেন গাজার অসংখ্য সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যেই গাজায় মৃত্যু ছুয়েছে চল্লিশ হাজারের কোটা। আর তার মধ্যে ১৬ হাজারই শিশু। জখম এক লক্ষের কাছাকাছি। প্রথম থেকেই এ যুদ্ধের নিশানা যেন নিরীহ শিশুরাই। প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সময় ধরে চলা যুদ্ধ জন্ম দিয়েছে দুর্ভীক্ষের। নেই ন্য়ূনতম চিকিৎসার সুবিধাটুকুও। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-র হিসেব বলছে, প্রায় ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষ গৃহহীন গাজায়। দুর্ভীক্ষ ও অসুস্থতার ঝুঁকিতে রয়েছেন অন্তত ২২ লক্ষ মানুষ। এখনও পর্যন্ত এ যুদ্ধে গাজায় ১৭ হাজারেরও শিশু পরিবারবিচ্ছিন্ন।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এখনও যাঁরা গাজায় বেঁচে রয়েছেন কোনও মতে, তাঁদের কাছে ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই। গাজার শিশু বিশেষজ্ঞ লোবনা আল আজাইজার জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি এমন গাজার মেয়েরা বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের চুল কেটে ফেলতে। কারণ তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত শ্যাম্পু, সাবান এমনকী চিরুনি পর্যন্ত নেই। নেই ঋতুস্রাবের সময়কার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রটুকুও। দশ মাস ধরে চলতে থাকা যুদ্ধে ভেঙে পড়েছে শহরের বর্জ্য নিষ্কাশন পরিকাঠামো। নোংরা, আবর্জনা, পুতিগন্ধময় জায়গায় গাদাগাদি করে রয়েছেন মানুষ। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগ দানা বাঁধছে তাঁদের শরীরে।

আরও পড়ুন:পৃথিবী আবার শান্ত হবে! গাজায় যুদ্ধবিধ্বস্ত কিশোরীদের স্বপ্ন দেখায় বক্সিং

ইজরায়েলের হামলা ভেঙে দিয়েছে একের পর এক হাসপাতাল, ভেঙে পড়েছে শহরের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোরা। তবু চিকিৎসকেরা নিজের মতো করে চেষ্টা করছেন যেটুকু করা যায়। কেউ তাবুতেই ক্লিনিক বানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করছেন, কেউ বা হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাচ্ছেন দুঃস্থদের কাছে। বোমায় আঘাত পাওয়া মানুষের চিকিৎসায় সাধারণ জ্বালাপোড়ার ওষুধটুকু পর্যন্ত এখন অমিল গাজায়। এদিকে মিশর থেকে আসা সাহায্যকেও গাজার কাছে পৌঁছতে দিচ্ছে না ইজরায়েলি সেনা। তবু আশায় বুক করে বাঁচছেন, বেঁচে রয়েছেন বাসিন্দারা। একদিন ঝড় থেমে যাওয়ার আশায়, বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্নকে বুকে নিয়ে মৃত্যুর উপত্যকায় জেগে রয়েছেন এত এত রাত্রি, দিন। আর কুমসানরা, যাঁদের থেকে যুদ্ধ ছিনিয়ে নিয়েছে সবটুকু, তাঁরা প্রতীক্ষা করছেন সেই জন্নতের, যেখানে গিয়ে ফের জুমানা আর সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আর কোনও বোমা, গুলি, যুদ্ধের লাল চোখ তাঁদের আলাদা করতে পারবে না তার পর।

 

More Articles