লক্ষ লক্ষ ইহুদির প্রাণ কাড়তে হিটলারের হাতিয়ার ছিল এই বিষাক্ত গ্যাস, আসলে কী এই মারণাস্ত্র?
ব্যবহারকারীর পাল্লায় পড়ে উপযোগী আবিষ্কারও একদিন বিভীষিকায় পরিণত হয়। আর দোষ হয় প্রযুক্তির, দোষ হয় বিজ্ঞানের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা অভিনবত্ব দেখিয়েছিল মানুষ খুনের পদ্ধতিতে। কীভাবে প্রচুর মানুষ একসঙ্গে কম খরচায় কম সময়ে খুন করা যায়, এই নিয়ে তারা রীতিমতো গবেষণা করেছিল। মোটামুটি ১৯৪১ সাল থেকেই পোল্যান্ডে আউশউইৎজ বা মাহ্ডানেকের মতো নাৎসি কন্সেনট্রশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় একটি বিশেষ গ্যাস ব্যবহার করে। গ্যাসচেম্বার গড়ে ওঠার নেপথ্যে এই রাসায়নিকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিকলন বি নামে এই হাইড্রো সায়ানাইডটি পরিচিত ছিল।
তবে জানলে আশ্চর্য হবেন, মানুষ খুন করার জন্য এই গ্যাস কিন্তু তৈরি হয়নি। হয়েছিল মামুলি সংক্রমণরোধী কীটনাশক হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে জিকলন বি মূলত জাহাজ, ব্যারাক, জামাকাপড়, গুদাম, কারখানা ইত্যাদিতে সংক্রমণ-রোধকারী রাসায়নিক হিসেবে ব্যবহৃত হত। কেলাসাকারে উৎপাদনের সময় এর রং হত জামিরার মতো। কিন্তু বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তীব্র বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হত এই কেলাস। তাই এয়ারটাইট ধাতব ক্যানে করে এই জিকলন বি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হত। কীভাবে এই সহজ সাধারণ কীটনাশক বদলে গেল প্রাণঘাতী গ্যাসে? আসুন সেই গল্প জেনে নেওয়া যাক।
১৯৪১-এ নাৎসিরা ইহুদি গণহত্যার পরিকল্পনা ছকে ফেলছে। কোন পদ্ধতিতে আরও দ্রুত হত্যা করা যায়, সে উপায় খুঁজতে তারা ব্যস্ত। আইনস্যাৎজগ্রুপেন বা ভ্রাম্যমান হত্যাকারী পল্টন তখন নাৎসি সেনার পিছন পিছন যেত। নাৎসি-অধ্যুষিত এলাকায় বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের এক জায়গায় জড়ো করে গুলি করে মেরে ফেলত তারা। বাবি ইয়ার এমনই এক গণহত্যার সাক্ষী। কিন্তু ক্রমাগত এই গুলি করে গণহত্যা নাৎসিদের কাছে অচিরেই অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ মনে হল। প্রচুর গুলি খরচ, সময়ও কম লাগে না, তার ওপর যারা গুলি করে, তাদের মনের ওপর চাপ পড়ে খুব। ইয়ুথেনেশিয়া প্রোগ্রামে গ্যাস ভ্যানের ব্যবস্থা করল তারা। পোল্যান্ডের কেল্মনো দেথ ক্যাম্পেও এই ধরনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। ভ্যানের পিছনে ইহুদিদের ভরে গাড়ি স্টার্ট দেওয়া হত। এবং গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস পাইপে করে ছেড়ে দেওয়া হত সেই ভ্যানেরই ভেতরে। কিছু স্থায়ী গ্যাসচেম্বারও নির্মাণ করা হয়। যেখানে গাড়ির নল লাগিয়ে কার্বন মনোক্সাইড ভরে দেওয়া হত। এইভাবে মানুষ মারতে প্রায় ঘণ্টাখানেকের ওপরে সময় লাগত। কিন্তু এতখানি গণহত্যার খাতে এতখানি সময় দিতেও নারাজ নাৎসিরা। আউশউইৎসের কমান্ডার রুডলফ্ হস এবং অ্যাডলফ আইখম্যান নামে একজন জার্মান অফিসার– এই দু'জন গণহত্যার সহজ উপায় খুঁজছিলেন। দু'জনেই ইহুদি ও অন্যান্য বন্দি নিধনের দায়িত্বে ছিলেন। কাজ সহজ করার উপায় হিসেবে হঠাৎ তাঁদের মাথায় আসে, জিকলন বি ব্যবহার করে দেখলে কেমন হয়?
আরও পড়ুন: লাখো মানুষের চোখ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে, পরিবেশের জন্য এই মুদ্রা ঠিক কতটা খারাপ
১৯৪১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। ক্লান্ত, কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়া ৬০০ জন সোভিয়েত ও ২৫০ জন পোলিশ বন্দিদের জোর করে ‘ডেথ ব্লক’-এ ঢোকানো হয়। প্রথম আউশউইৎসের ১১ নম্বর ব্লকের বেসমেন্টটাকেই বলা হত ‘ডেথ ব্লক’। সেখানেই ৮৫০ জন বন্দির ওপরে প্রথম পরীক্ষা করা হয় জিকলন বি। কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায় অতগুলি মানুষ। আউশউইৎসের এক নম্বর ক্রিমেটোরিয়ামে যে বড় লাশকাটা ঘর ছিল, পূর্বোক্ত ঘটনার দিনকতকের মধ্যেই দেখা গেল, তাকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রথম প্রথম এই গ্যাসচেম্বারের ব্যাপারটা কাউকে জানানো হয়নি। ৯০০ জন বন্দি সোভিয়েত সেনাকে সংক্রমণরোধী চিকিৎসার নামে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এইবারে ছাদের একটি ছিদ্র থেকে জিকলন বি-র চাঙড় ফেলা হয় ঘরটির মধ্যে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্রপথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফের কয়েক মিনিটে মারা যায় ৯০০ জন। নিজেদের আবিষ্কার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয় নাৎসিরা। গণহত্যার একটি অতি কার্যকর, অতি সস্তা, অতি দ্রুত উপায় তারা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়েছিল।
বার্কেনেও-এ আউশউইৎজ ২ তৈরি হওয়ার পর আউশউইৎস বিশ্বে মানবনিধনের বৃহত্তম ক্ষেত্র হয়ে উঠল। গোটা তৃতীয় রাইখে এই মাপের নৃশংসতা তেমন দেখা যায় না। নাৎসি বা সহি আর্যরা এই অবাঞ্ছিত ‘অপর’ চোখে যাদের দেখত, সেই ইহুদি ও অন্যান্য ‘অপর’-দের ক্যাম্পে আনা হত ট্রেনে করে। ক্যাম্পে ঝাড়াইবাছাই হত, কে কর্মক্ষম আর কে অক্ষম। অক্ষমদের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসচেম্বারে নিক্ষেপ করত নাৎসিরা। তখনও অবধি বন্দিদের গ্যাস চেম্বারের কথা জানানো হয়নি। বলা হত, স্নানের জন্য জামাকাপড় খুলে রাখতে হবে। তারপর একটি সাজানো বাথরুমে তাদের নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে শাওয়ার পর্যন্ত লাগানো। বন্দিদের ঢুকিয়ে একটা বড় মোটা দরজা সিল করে দেওয়া হত। গ্যাসমুখোশ পরে নাগালের বাইরে ছাতের ছিদ্রপথে কয়েকজন সেই জিকলন বি চেম্বারে ঢালত। সঙ্গে সঙ্গে জিকলন ই বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হত। বন্দিরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তখন ভয়ে ছোটাছুটি করত, দরজা ধাক্কা দিত, দেওয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করত। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে সবাই মারা যেত। কখনও হয়তো মিনিট কুড়ি সময় লাগত। সবাই মরে গিয়েছে টের পাওয়ার পর সেই বিষাক্ত বাতাস পাম্প করে বের করে দেওয়া হত। তাতে মিনিট পনেরো সময় লাগত। এরপরে দরজা খুলে বন্দিদের একটি স্পেশাল ইউনিটকে ভেতরে ঢোকানো হত। এই ‘সোন্ডারকোমান্ডো’-রা একটি আঁকশি দিয়ে লাশগুলো টেনেটুনে আলাদা করত, নাড়াচাড়া করত। আংটি, দাঁতের সোনা ইত্যাদি খুলে ফেলা হত। তারপরে চুল্লিতে লাশগুলো জ্বালিয়ে দিত নাৎসিরা। আর এই যাবতীয় হত্যকাণ্ড সংঘটিত হত এমন এক গ্যাসের দ্বারা, যা নিরীহ কীটনাশক হিসেবেই ব্যবহার হয়ে এসেছে চিরটাকাল। শুধু মাত্র ব্যবহারের কারণে সেই গ্যাস এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠল যে, চিরকাল ঘেন্নার সঙ্গে সেই নাম উচ্চারণ করা হল। ব্যবহারকারীর পাল্লায় পড়ে উপযোগী আবিষ্কারও একদিন বিভীষিকায় পরিণত হয় এভাবেই। আর দোষ হয় প্রযুক্তির, দোষ হয় বিজ্ঞানের।