বিচিত্র পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে রাজনৈতিক মিছিলে ভিড় বাড়ান বাউলরা

Shantiniketan Baul: বেসুরে ওই চমক লাগানো গুটিকয় জনপ্রিয় গান পালা করে গেয়েই চলেছে। নতুন কোনও গান নেই। প্রাচীন গান তো এদের মুখে নৈব নৈব চ!

শুধুমাত্র সমালোচনার জন্য নয়, এমনকী বিরোধিতার জন্যও নয়, সর্বক্ষেত্রে ত্রুটি দেখানোর কারণেও নয়; ধারাবাহিকভাবে শান্তিনিকেতন নিয়ে যা লিখছি তা একপ্রকার তুলনামূলক আলোচনা। কী ছিল আর আজ কোন অবস্থায় আছে এইটুকুই জানাতে চাই। সেই সমস্ত, যা গত সাড়ে চার দশক ধরে দেখে চলেছি। সঙ্গে রেখেছি বইয়ের পাতা থেকে সামান্য কিছু উদাহরণ। অর্থাৎ কিছু পুরনো কথা যা আসলে শান্তিনিকেতনকে নির্দিষ্ট করেছিল এক অন্য বা অনন্য ক্ষেত্র হিসেবে। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও বিদ্যাচর্চার স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছিল। শেষতক তা আজ এক ভয়াবহ পরিণতির কবলে পড়ে, আদতে সামগ্রিকভাবেই পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে সংস্কৃতি, পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি, পাল্টে যাচ্ছে এখানকার মানুষের আচার-আচরণ। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কেউ জানে না। কারও কোনও দায় নেই। প্রশাসনের ঔদাসীন্য আর বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের একরোখা পরিকল্পনাহীন কর্মকাণ্ডই যে এই অবস্থার জন্য মূল দায়ী তা আর নতুন করে লেখার প্রয়োজন পড়ে না। তবু তো একথা বারবার লিখতেই হবে।

রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই যে শান্তিনিকেতন ক্রমে বাউলদের শ্রীক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সে কথা আগেই লিখেছি। এখানে আবারও বাউল নিয়ে লিখব। কেননা অনেক কথাই বাদ পড়ে গেছে। ওই যে লিখেছি, তুলনামূলক আলোচনা করব। কী ছিল আর কী হলো! নবনী দাস বাউলের শান্তিনিকেতনে আসার যে সূত্রপাত ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে, সেই থেকেই ক্রমে বাউলচর্চার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে ওঠে বোলপুর। ইতিহাস বলছে রবীন্দ্রনাথ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জয়দেবের মেলা দেখতে ছাত্রছাত্রীদের কেন্দুলি গ্রামে নিয়ে যেতে। কথামতো বছরের পর বছর সেই কাজ করেছিলেন আচার্যমশাই। সে সময় যাতায়াতের তেমন সুবিধা ছিল না। গরুর গাড়ি ভাড়া করে ছাত্রছাত্রীদের শান্তিনিকেতন থেকে কেন্দুলি নিয়ে যেতেন ক্ষিতিমোহন সেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন যে, এতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা বরিষ্ঠ আশাবাদের সঞ্চার হবে।

আরও পড়ুন-মদ, মাংস এবং … হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে

আসলে আমাদের কম বয়সে বাউল আর জয়দেবের মেলার মাঝে ঝুলে ছিল সেই শান্তিনিকেতন তথা বোলপুর। তখন মেলায় যেতাম ট্রেনে চেপে বোলপুরের পথে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে চার মাথার মোড়ে সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন মহামায়া হোটেলে চাট্টি ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে ওর সামনে থেকেই মেলার বাস ধরতাম। বাসের ভেতরে কখনও চাপিনি। আমরা যেতাম বাসের ছাদে চড়ে। বয়স্করা সাবধান করতেন। কেননা পুরো রাস্তাতেই দু'পাশের প্রকাণ্ড সব গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে। সেইসব ডাল বাঁচিয়ে যেতে হতো। তারপরেও কত যে দুর্ঘটনার কথা শুনেছি! তা যাইহোক, তিন রাত-তিন দিন মেলাখেলায় কাটিয়ে আবার বাসের মাথায় চেপে বোলপুর। ফেরাটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতো। কেননা ফেরার সময় বাসের মাথায় চড়ে আসতেন কোনও না কোনও বাউল। তার মানেই ফেরার পথেও গান।

তা মেলা থেকে ফেরা কি আর অত সহজ? বিশেষ করে যদি সঙ্গে থাকেন গৌর ক্ষ্যাপা! যে ক'জনই থাকি, তিনি প্রত্যেককেই পাকড়ে নিয়ে যাবেন নিচু বাঁধগোড়ায় তাঁর ছোট্ট টালির চালের আশ্রমে। সেখানে অন্নসেবা হবে। তারপর গল্পগুজবে সন্ধ্যা নেমে আসবে। বক্তা থাকবেন মূলত গৌর। এরপর গান শুরু হবে। চলবে মধ্যরাত পর্যন্ত। সেখানে ক্ষ্যাপা একাই একশো। কখনও সখনও যে অন্য গায়করা থাকতেন না তা অবশ্য নয়। তবে গৌরই মাতিয়ে দিতেন। এইভাবে কখন যে দু-চারদিন জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে খসে পড়ত তার হিসেব রাখিনি। মাঝেমধ্যেই দল বেঁধে যেতাম শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে। সেখানে তখন পবন দাস আর মিমলু বাসা ভাড়া করে থাকতেন। সেটাও হয়ে উঠেছিল বাউল আশ্রম। জয়দেবের মেলার পর বাউলদের শান্তিনিকেতনের নানা বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকত গানের আসরের জন্য। আমরাও শ্রোতা বা বাউল ভক্ত হিসেবে দল বেঁধে যেতাম গান শুনতে।

আরও পড়ুন- পর্যটনের বহর প্রবল! তবু ভালো হাসপাতাল, রাস্তা নেই সাধের শান্তিনিকেতনে

সেই সময় বোলপুর অঞ্চলে অনেক বাউলেরই বসবাস ছিল। বিশেষ করে আমরা মাঝেমধ্যেই চলে যেতাম বিশ্বনাথ দাস বাউলের বাড়ি। সেখানে গানবাজনা আর আড্ডা চলত রাতবিরেতে। বিশ্বনাথদা ছিলেন অত্যন্ত প্রাচীন বাউল পরিবারের ছেলে। তাঁর ছিল চমৎকার গান ও সুচারু নাচের ভঙ্গি। এখানে জানিয়ে রাখি, এই বিশ্বনাথদাকেই আমরা প্রথম চলচ্চিত্রে প্রকৃত বাউল হিসেবে দেখি 'ডাক হরকরা' ছবিতে। বছর খানেক আগে বিশ্বনাথ দাস দেহ রেখেছেন। তাঁর দুই ছেলে আনন্দ আর নিতুও চমৎকার গান করে। তবে শুধু বিশ্বনাথদাই নয়, শুঁড়িপাড়ায় তাঁর বাড়ি থেকে দশ পা হাঁটলেই দেবদাস বাউলের বাড়ি। দেবদাসও একজন খুব ভালো শিক্ষক। সেটা তাঁর দুই ছেলে ও শিষ্য কার্তিকের গান শুনলে বোঝা যায়। এছাড়াও তখন ছিল নানা বাউল গায়কে জমজমাট বোলপুর।

আজও বাউল আছে। কিন্তু ওই যে বলেছি, সুর-তালের মন্দা। কেউ যে নেই, সে কথা বলব না। তবে অধিকাংশের গান শুনলেই বোঝা যায় যে চর্চার মারাত্মক অভাব। সুর-তালের যেমন সামঞ্জস্য নেই তেমনই কণ্ঠস্বর অধিকাংশেরই বেপথু হয়েছে। এমন গান সোনাঝুরির হাটে গেলেই শোনা যায়। বেসুরে ওই চমক লাগানো গুটিকয় জনপ্রিয় গান পালা করে গেয়েই চলেছে। নতুন কোনও গান নেই। প্রাচীন গান তো এদের মুখে নৈব নৈব চ! তবে তাতে কী! কোলকেত্তার বাবুকুল তাতেই আহ্লাদিত! তাদের সুরতালের প্রয়োজন হয় না। একটা বেতালা কিছু বাজলেই হলো। তাতেই তারা নেচে কুঁদে সারা। জানি না, এভাবেই ক্রমে বাউল সুর নির্বাসনে যাবে কিনা। কেননা বাউল গানের কোনও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যা কিনা সরকার করতেই পারত। একটা বাউল আকাদেমি খুলে রেখেছে, তার যে কী কাজ তা তারা নিজেরাই জানে না। এসব বলছি খুব কাছ থেকে দেখে, ভেতরে থেকে জেনে। অথচ এই বাউল আকাদেমির প্রধান কার্যালয় বীরভূম জেলারই কেন্দুলিতে। সেখানে প্রকাণ্ড এক বাড়ি তুলেছে আকাদেমি। ওই পর্যন্তই।

আরও পড়ুন-বাউল কম, শান্তিনিকেতন দাপাচ্ছে বাবুর বাড়ির ‘ফাউল’-রা

অন্যদিকে সরকার লক্ষাধিক বাউলের তালিকা করে হাজার টাকা করে প্রতি মাসে ভাতা দেয়। যাদের মধ্যে আছেন রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, চায়ের দোকানদার, মুদির দোকানের কারবারি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরে এই ভাতা পাওয়া আজ আর তত কঠিন কাজ নয়। এই বিচিত্র বাউলদের দেখা যায় সরকারি রাজনৈতিক দলের মিছিলের অগ্রভাগে। বাউল পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে নেমে পড়েন এরা। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি, এদের সিংহভাগই বাউল নন। গান তো অনেক দূরের কথা। এরাই আবার জয় শ্রী রাম বলতে বলতে বিরোধীপক্ষের মিছিল মিটিংয়েও যোগ দেন। বোলপুরে এক বাউলের বাড়িতে তো মধ্যাহ্নভোজ খেতে হাজির হয়ে যান খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তা হয় দলের নির্দিষ্ট কর্মসূচি মেনে। তা নিয়েও চলে দু'দলের রাজনৈতিক তরজা। শান্তিনিকেতনের কতিপয় বাউলের মধ্যে যথার্থ এই বাউল গায়কের তখন যে কী অবস্থা, সে কথা লিখে বোঝানো যাবে না।

শান্তিনিকেতন, বোলপুরে এমন বেশকিছু ভেকধারী বাউলের (থুড়ি ফাউলের) তথাকথিত আশ্রম আছে যেখানে কালীপুজো, শিবপুজো হয় সকাল-সন্ধ্যা। আর আখড়াধারী সনাতনী হিন্দু তত্ত্ব আওড়ায় সম্পূর্ণ ভুল জেনে, ভুল বুঝে। সেখানেও শান্তিনিকেতনের কচিকাঁচাদের ভিড়।আসলে সেখানে গান নেই, নেশা আছে। বাউলের চর্চা নেই, মূর্খামি প্রকট হয়ে আছে। এদের কথা শুনলে মনে হয় নির্দিষ্ট কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাদের সুরে কথা বলছে। আসলে খুব তাড়াতাড়িই রাজনৈতিক দলগুলো এই ঐতিহ্য-আশ্রিত বাউল গান আর ভাবধারার খোলনলচে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিল, যা আসল বাউল তত্ত্ব থেকে হাজার যোজন দূর। লোভ এখানে একমাত্র ধ্রুবকের কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। শান্তিনিকেতনে না থাকলে হয়তো এতটা বুঝে উঠতে পারতাম না। কী আর করা যাবে! এভাবেই চলুক তাহাদের শান্তিনিকেতন।

More Articles