৬ মাসেই ফের তোলপাড় বাংলাদেশ! ভাষণে ঠিক কী বলেছেন শেখ হাসিনা?
Sheikh Hasina Speech: বাংলাদেশের হাসিনাবিরোধী জনতা মনে করছে, ক্ষমতা হারিয়েও হাসিনা বদলাননি একটুও। স্বৈরাচারী, অত্যাচারী শাসক হাসিনা এখনও দেশের মানুষের উপরেই দায় চাপাচ্ছেন।
তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তাঁরই দেশের জনতার হাতে। তিনি নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আশ্রয় খুঁজেছেন বিভিন্ন দেশে। মেলেনি। পালিয়ে এসে ভারতে রয়ে গিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দীর্ঘ ৬ মাস পর, অবশেষ এক দীর্ঘ ভাষণ দিলেন শেখ হাসিনা। একদিকে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন তিনি, আর ওই একই সময়ে ঢাকায় তার বাবা শেখ মুজিবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে সরাসরি বক্তব্য রাখছিলেন শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবের ভূমিকা থেকে শুরু করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ইতিহাস এবং বর্তমান বাংলাদেশ— সমস্তটা নিয়েই কথা বলেছেন তিনি। বাংলাদেশের হাসিনাবিরোধী জনতা মনে করছে, ক্ষমতা হারিয়েও হাসিনা বদলাননি একটুও। স্বৈরাচারী, অত্যাচারী শাসক হাসিনা এখনও দেশের মানুষের উপরেই দায় চাপাচ্ছেন। ধানমন্ডির বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছে, আসলে ফ্যাসিস্ট শাসকের এই অবস্থাই হয়। কেন হাসিনার বক্তব্য এত উত্তেজিত করল বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে?
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় ৫০ মিনিটের দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন হাসিনা। বলেন, অগাস্ট মাস শোকের মাস। আর সেই মাসেই সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য চক্রান্ত হয়েছে আবার। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, পুলিশ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। রক্তের খেলায়, ধ্বংসের খেলায় বাংলাদেশ ক্ষতবিক্ষত। হাসিনা আরও বলেছেন, “বাংলাদেশকে নিয়ে ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ছিল, উন্নয়নের বিস্ময় ছিল। সেই বাংলাদেশকে চরম ভাবে ধ্বংস করে জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের দেশ হিসাবে পরিণত করা হয়েছে। এটিই হল সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়।”
আরও পড়ুন- নতুন করে হিংসা বাংলাদেশে! মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল কারা?
স্মৃতিচারণা করে হাসিনা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর টালমাটাল বাংলাদেশে মানুষ শান্ত হয়ে যখন নতুন জীবন শুরু করছিল, তা আবার বিক্ষিপ্ত করে দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মুজিব। মাত্র ৩ বছর ৭ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের উন্নতি ঘটাচ্ছিলেন তিনি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। তখনও এই বাড়িটিতে লুঠপাট চালিয়েছিল পাক-বাহিনী কিন্তু আগুন দিয়ে পোড়ায়নি বা ভাঙেনি। হাসিনা বলেন, “আমার মা অনেক কষ্ট করে এই বাড়িটির প্রতিটি ইট নিজের হাতে গেঁথেছিলেন।” বাংলাদেশের সেই দীর্ঘ ইতিহাসকেই মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ তাঁর। হাসিনার মতে, যাঁরা এ সব করার চেষ্টা করছেন তাঁরা নিজেদের ‘দুর্বলতা’ এবং ‘হীনম্মন্যতা’ প্রকাশ করেছেন। হাসিনার প্রত্যয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এর বিচার করবেন। উল্লেখ্য, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটিকে সংগ্রহশালা হিসেবে তৈরি করে দেন। এই বাড়িতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট হত্যা করা হয় শেখ মুজিবকে, তাঁর স্ত্রীকে, হাসিনার তিন ভাইকে, মাত্র ১০ বছরের রাসেলকে। গোটা পরিবার শেষ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এই বাংলাদেশকে সরাসরি পাকিস্তানপন্থী বলেও অভিযোগ করেছেন। হাসিনা ওই ভাষণে বলেন, “লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে সংবিধান, স্বাধীনতা, পতাকা পেয়েছি— তা কয়েক জন বুলডোজ়ার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না। এ শক্তি তাঁদের এখনও হয়নি। এটি তাঁদের দুর্বলতার প্রকাশ। তাঁরা দালান ভাঙতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে ধ্বংস করতে পারে না। ইতিহাস যে প্রতিশোধ নেয়। এ কথা তাঁদের মনে রাখতে হবে। যাঁরা এ সব করছেন, তাঁরা হীনম্মন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁদের হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা পছন্দ নয়। পাকিস্তানিদের অধীনে থাকা এবং পদলেহন করাটাই হয়তো তাঁদের পছন্দ।” তাহলে কি কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার নেপথ্যে যারা, তাঁদের সরাসরি পাকিস্তানপন্থী বলেই মনে করছেন হাসিনা?
মুজিব কন্যা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র বলেই মনে করছেন তিনি। "২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন হয়েছিল একবার। আমি কোটা বন্ধ করে দিই। তখন আদালতে মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু পরিবারে। আদালত আবারও কোটা ব্যবস্থা চালু করে। সরকার 'রিট' করে তা স্থগিত করে দেয়। আবার ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলন শুরু হয়। আসলে এটা ভিন্ন ষড়যন্ত্র। একজন ক্ষমতালোভীর চক্রান্ত এটা।" কাকে ক্ষমতালোভী বলছেন হাসিনা?
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহত ২৩? এই মৃত্যুর বাস্তব কারণগুলি আসলে যা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূসকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন হাসিনা। উল্লেখ্য, হাসিনা সরকার দুর্নীতির অভিযোগে ইউনূসকে গ্রেফতার করেছিল। হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ইউনূস “১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের পদে ৬০০০ টাকার বেতনের চাকরি পেয়েছিলেন। আমি ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পরে এই গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিই। গ্রামীণ ফোনের ব্যবসাও ইউনূসকে দিয়েছিলাম। আমার কাছে বারবার ধর্না দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেখান থেকে লাভের অংশ গ্রামীণ ব্যাঙ্কে যাবে। কিন্তু তা যায়নি। তিনি আর্থিক দুর্নীতি করেছেন। তাঁর ক্ষমতার লোভ আজ বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে এসেছে।”
আর যাঁরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করল মূলত, বাংলাদেশের সেই ছাত্রদের উদ্দেশে হাসিনা বলেছেন, “সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমাদের কোনও রাগও নেই, অভিযোগও নেই। আমি জানি তোমাদের বয়সটাই এই রকম। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এ সবের থেকে দূরে থাকা উচিত। তারা যেন এই ধ্বংসযজ্ঞে অংশ না নেয়।” বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘জঙ্গিদের হাতে’ তুলে না দেওয়ার পরামর্শও দেন হাসিনা।
এই বক্তব্য চলাকালীনই বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির বাড়ি। হাসিনার শাসনাবসানের ঠিক ৬ মাসের মাথায় আবারও ধ্বংসের আশ্রয় নিল বাংলাদেশ। হামলার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলছেন, "ফ্যাসিবাদের চিহ্ন বিলোপের সাথে সাথে খুনী হাসিনাসহ গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত এবং আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।" একাধিক পোস্টে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, হাসিনা ভুল প্রজন্মের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রধান উপদেষ্টা নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজ করছেন বলে দাবি করেছেন। রাষ্ট্র সংস্কার চলছে। জিনিসের দাম বাড়ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে গরিব মানুষ। নির্বাচন কবে হবে কোনও ঠিক নেই। এমতাবস্থায়, হঠাৎ বেছেবেছে ধানমন্ডির বাড়ি আক্রমণ করে কী বার্তা দেওয়া হলো? মুজিবের প্রতি ঘৃণা কি বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়ের চেয়েও বেশি জরুরি? বাংলাদেশের নির্বাচনের মাধ্যমে স্থায়ী সরকার গঠন, রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার, সংবিধান সংশোধনের চেয়েও কি মুজিব ও তাঁর পরিবারের স্মৃতিকে মুছে ফেলাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মূল চাহিদা?