হাতকড়া-শিকলে বেঁধে নির্বাসন! যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার ভারতীয় অভিবাসীরা...
US Deports Migrant Indians: আকাশপথেও হাতকড়া খোলা হয়নি। পা বেঁধে রাখা হয়েছে শিকল দিয়ে। এমনকী দীর্ঘ যাত্রাপথে শৌচাগারও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।
আমেরিকা গিয়েছিলেন উন্নত জীবনের খোঁজে। এজেন্টদের হাতে টাকা গুঁজে বৈধ নথি ছাড়াই ঢুকে পড়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। এমনটা নতুন নয়। তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলে দিয়েছেন, অবৈধ অভিবাসীদের সেই দেশে কোনও ঠাঁই নেই। শয়ে শয়ে অভিবাসীকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে নিজেদের দেশে। ভারতেও ফেরানো হচ্ছে 'অবৈধ' অভিবাসীদের। ভারত এমনিতে আমেরিকার সুহৃদ। ট্রাম্প আর মোদির বন্ধুত্ব গভীর। অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরানো হচ্ছে, দেশ তাঁদের গ্রহণও করবে। কিন্তু যেভাবে ফেরানো হচ্ছে তাতে একজন মানুষের মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে কি? হাতকড়া পরিয়ে, শিকল দিয়ে বেঁধে নির্বাসিত করা মানুষের সারি ক্রীতদাসদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভারতগামী বিমানে কোনওরকমে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। বিমানের মধ্যে, আকাশপথেও হাতকড়া খোলা হয়নি। পা বেঁধে রাখা হয়েছে শিকল দিয়ে। এমনকী দীর্ঘ যাত্রাপথে শৌচাগারও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।
দ্য ওয়ারকে এমনই একজন নির্বাসিত অভিবাসী হরবিন্দর সিং জানিয়েছেন, হাতকড়া পরিয়ে, পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল যখন, তাঁরা ভেবেছিলেন বোধ করি অন্য অভিবাসী শিবিরে পাঠানো হচ্ছে তাঁদের। মার্কিন সামরিক বিমানে ওঠার আগে অবধি তাঁরা জানতেনই না যে নির্বাসিত করা হচ্ছে তাঁদের। হরবিন্দর বলছেন, "আমরা মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের হাতকড়া খুলে দিতে যাতে আমরা জল খেতে পারি এবং শৌচাগার ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু তাঁরা সাড়া দেননি।" গত ৫ ফেব্রুয়ারি অমৃতসরে বিমানে করে ১০৪ জন ভারতীয়কে নির্বাসিত করেছে আমেরিকা।
আরও পড়ুন- অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে নির্বাসন! মুখরক্ষা হবে মোদির?
বৈধ নথিপত্র ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য যে 'অবৈধ' অভিবাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের বেশিরভাগই গুজরাত, হরিয়ানা এবং পঞ্জাবের বাসিন্দা। মার্কিন সীমান্ত টহলদারির প্রধান বৃহস্পতিবার নির্বাসিতদের ভারতীয়দের একটি ভিডিও পোস্ট করেন। যাতে দেখা যায় C-17 সামরিক বিমানে হাতকড়া এবং শিকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁদের। এই শিকল খোলা হয় অমৃতসর বিমানবন্দরে। জানানো হয় আগামী পাঁচ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না এই নির্বাসিতরা।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বৃহস্পতিবার সংসদে বলেছিলেন, আমেরিকান ফেডারেল নীতিতে মহিলাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বাস্তবে, ওই বিমানে করে মহিলাদেরও নির্বাসিত করা হয়েছে। মহিলাদেরও হাতকড়া এবং শিকল পরানো হয়েছিল। অমৃতসরের বাসিন্দা মনজিত কৌর নির্বাসিত হয়েছেন। ৪০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় শিকল পরিয়ে রাখায় তাঁর হাত-পা ফুলে গিয়েছিল। দেহে ছোটখাট আঘাতও ছিল। একমাত্র শিশুদের হাতকড়া পরানো হয়নি।
দ্য ওয়ারের একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, পঞ্জাবের কাপুরথালা জেলার লাভপ্রীত কৌর তাঁর ছেলের সঙ্গে নির্বাসিত হয়েছেন। লাভপ্রীত বলছেন, “আমাকে হাতকড়া পরানো হয়েছিল এবং আমার পা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সবার সঙ্গেই একই আচরণ করা হয়েছে। আমাদের একত্রে মার্কিন সামরিক বিমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে আমরা নির্বাসন সম্পর্কে জানতে পারি। লাভপ্রীত সেই অজস্র ভারতীয়দের একজন যিনি 'ডানকি রুট' ব্যবহার করে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। এর জন্য ১.৫ কোটি টাকা খরচও করেছিলেন তিনি। লাভপ্রীত এই বছরের ১ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ জানুয়ারি সেই দেশে পৌঁছন। আসার ঠিক দশ দিনের মধ্যে তাঁকে নির্বাসিত করা হলো।
ভারতে নির্বাসিত করার আগে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসী শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এই অভিবাসীদের। ওই অভিবাসী শিবিরেই তাঁদের হাতকড়া পরানো হয়েছিল। নির্বাসিত অভিবাসীদের ঘুমোতে দেওয়া হয়নি। একটা ছোট্ট শিবিরে প্রায় ৫০ জনকে বন্দি করে রাখা হয়। খেতে দেওয়া হয় কেবল চিপস আর আপেল।
আমেরিকায় গিয়ে আরও বেশি উপার্জন করবেন, আমেরিকায় গিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচবেন, আমেরিকায় গেলে জীবন ‘সেটল’ হয়ে যাবে'— এই খোয়াব নিয়েই সকলে যান মার্কিন মুলুকে। আমেরিকা যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কৃষি জমি, সোনা সব বিক্রি করে দেন। হরবিন্দরের স্ত্রী কুলজিন্দর কৌর জানিয়েছেন, হরবিন্দরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর জন্য ৪২ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন তাঁরা। চাষের জমি, সোনা সব বেচে দিয়েছেন।
মোদি সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই নির্বাসিতদের পরিবারগুলি। তাঁদের বক্তব্য, দেশের সরকার যদি এই নির্বাসিতদের ঘরে ফেরানোর পর যোগ্য চাকরি বা অন্য কর্মসংস্থান নাও দিতে পারে, তাহলে অন্তত নিজের দেশের বাসিন্দাদের সপক্ষে কথা বলা উচিত। পরিবারগুলির অভিযোগ, শুধু মোদি সরকারই নয়, আম আদমি পার্টির সরকারও এই সময়ে নীরবই থেকেছে।
কৃষি পরিবারের সন্তান জাসকরণ। আমেরিকা যেতে গিয়ে ৪৫ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়েছিলেন তিনি।দেনায় জর্জরিত হয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। পরিবারের সবার ছোট তিনি, চার বোনের একমাত্র ভাই। বৃদ্ধ বাবা-মা কপাল চাপড়াচ্ছেন, এই বিপুল দেনা মেটাবেন কীভাবে! জাসকরনও 'ডানকি রুটে' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সফর শুরু হয় তাঁর। ২০২৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সে দেশে এসে পৌঁছন তিনি।
আরও পড়ুন- মহিলাদের খেলা থেকে কেন রূপান্তরকামীদের নিষিদ্ধ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
জাসকরন এবং পঞ্জাবের আরও প্রায় আটজনের একটি দল ডানকি রুটে আমেরিকা যান। সবাইকেই বুধবার নির্বাসিত করা হয়েছে। এরা সকলেই দুবাইয়ের কোনও ট্রাভেল এজেন্টকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এই দলটি অমৃতসর থেকে দুবাই এবং তারপর দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে যায় বিমানে। ব্রাজিল থেকে তারা বাসে করে; পায়ে হেঁটে নদী, পাহাড়, জলাভূমি এবং জঙ্গল অতিক্রম করে বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা এবং অবশেষে মেক্সিকো অতিক্রম করে আমেরিকা যায়।
জাসকরন দ্য ওয়ারকে বলছেন, “আমরা প্রায় ১৩টি দেশ পাড়ি দিয়েছি, তারপর খালি হাতে দেশে ফিরেছি। দুঃখজনক যে, আমাদের এজেন্ট, যিনি এই সমস্ত সময়টা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, তিনি কখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেননি। এজেন্ট আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আমরা এক মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছব কিন্তু মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করতে আমাদের ছয় মাস লেগেছে।" গুরুদাসপুর জেলার বাসিন্দা জসপাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য এজেন্টকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি ছয় মাস ব্রাজিলে ছিলেন। এই বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করেন, তারপরেই মার্কিন সীমান্ত পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং ১১ দিনের মধ্যে নির্বাসিত করে।
নির্বাসিত হয়ে দেশে ফেরা শুধু সামাজিক ধাক্কাই নয়, বিশাল আর্থিক ক্ষতিও। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এই মানুষরা। একে ডানকি রুটে যাতায়াতের ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা, তার উপর জীবনের সর্বস্ব বেচে দিয়ে ভিন মুলুকে গিয়ে অপরাধীর মতো বাঁচা, দুষ্কৃতীর মতো ধরা পড়া— এই জীবন কেন কাটাতে হচ্ছে ভারতীদের একাংশকে? দেশে ফেরার পর এই নির্বাসিতদের জন্য বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত কি করতে পারবে সরকার? প্রশ্ন গিলে খাচ্ছে শতাধিক পরিবারকে।