ভরসার নাম জিগনেশ! বিজেপির দূর্গে যেভাবে একা জিতে দেখিয়ে দিলেন দলিত-কংগ্রেস নেতা

Gujarat Election Results 2022: অনেকেই বলছেন, জিগনেশ মেভানির এই প্রভাব যদি কংগ্রেসে না থাকত তাহলে আরও খারাপ হত কংগ্রেসের নির্বাচনী ফলাফল।

গুজরাতে বিজেপি-র বিপুল উচ্ছ্বাসের মধ্যেও 'একা কুম্ভ' হয়ে উঠে এসেছেন কংগ্রেস নেতা জিগনেশ মেভানি (Jignesh Mevani)! ফের নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের আটকে দিয়ে তিনিই হয়ে উঠেছেন নুইয়ে পড়া কংগ্রেসের গুজরাত-মুখ! কংগ্রেসের গুজরাত-বিপর্যয়ের মধ্যেও গড় রক্ষা করছেন এই কংগ্রেস নেতা। ভেদগাম আসনের প্রায় ২ লাখ ৯৪ হাজার ভোটারের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন জুটেছে তাঁর। ২০১৭ সালের পর ফের দ্বিতীয়বারের জন্য বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন দলিত সম্প্রদায়ের কংগ্রেস-মুখ জিগনেশ। যে আসনে প্রায় ৯০ হাজার মুসলমান ভোটার, ৪৪ হাজার দলিত সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে। যার প্রায় পুরোটাই নিজের ঝুলিতে পুরেছেন এই নেতা।

যদিও ১৯৮৫ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪৯ আসন। ২৭ বছর পর সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় (Gujarat Legislative Assembly Election Result) ১৫০ আসন জিতেছে অমিত শাহের দল। ফের মোদি-গড় রক্ষা করেছে বিজেপি। আর এই বিপুল জয়ের আলোকে আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীরদেশজুড়ে 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র শোরগোলের মধ্যেও গুজরাত রাজনৈতিক বিচ্ছেদ নিশ্চিত করেছে কংগ্রেসের সঙ্গে।

তবে সামগ্রিক কংগ্রেসের সঙ্গে গুজরাত নির্বাচন এবং জিগনেশ মেভানিকে মিলিয়ে ফেলা খানিকটা কঠিন। তিনি আলাদা। একাধিক লড়াই আর বিতর্ক, জল্পনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন জিগনেশ। দলিত অধিকার আদায় থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, একাধিক ক্ষেত্রেই দেশজুড়ে চর্চিত হয়েছেন তিনি। ২০২১-এর আগে পর্যন্ত কংগ্রেস-ছায়াহীন নেতার আন্দোলন-দৃষ্টান্ত বারবার ঘাম ঝরিয়েছে গুজরাত সরকারের, প্রশাসনের। কে তিনি? গ্রেফতার থেকে হেনস্থা, কীভাবে দলিত পরিবারের এই সন্তান সামান্য সাংবাদিক থেকে হয়ে উঠলেন জনতার নেতা?

আরও পড়ুন- গুজরাত ভোটে তিনিই ‘চাণক্য’, অমিত শাহর ছোট্ট চালে যে ভাবে কিস্তিমাত ‘ব্র্যান্ড মোদি’-র

সূচনাপর্বে জিগনেশ

১৯৮০, ১১ ডিসেম্বর। গুজরাতের আহমেদাবাদের এক দলিত পরিবারে জন্ম হয় জিগনেশের। বাবা পুরসভায় কাজ করতেন। মা ছিলেন বিএসএনএলের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে স্বস্তিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ। তারপর আহমেদাবাদের উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়িয়ে ভর্তি হলেন এইচকে আর্ট কলেজে। সেখানেই আদর্শ সম্পূর্ণ হতে শুরু হল তাঁর। অধ্যাপক সৌম্য যোশী থেকে শুরু করে একাধিক আন্দোলনের মুখ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলাদের ভক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। ভারতীয় বিদ্যা ভবন থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা অর্জন করলেন।

এরপর পাড়ি দিলেন মায়ানগরীতে। সেখানেই সাংবাদিকতায় যোগ। গুজরাতি ভাষার ম্যাগাজিন অভিযানে কাজ শুরু করলেন জিগনেশ মেভানি। কিন্তু সে আর বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। কৃষক আত্মহত্যার এক চরম নিদর্শন দেখলেন একটি সিনেমায়। মনবদল হল তাঁর। ছাড়লেন চাকরি, ফিরলেন গুজরাত।

আন্দোলনে জিগনেশ

প্রায় তিন বছরের সাংবাদিক জীবন একদিকে রেখে, বঞ্চিত মানুষের অধিকার নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন যুবক জিগনেশ। ২০০৮ সাল নাগাদ তথ্য জানার অধিকার আইনের হয়ে শুরু করলেন কাজ। দিকে দিকে ঘুরতে শুরু করলেন। অচিরেই হয়ে উঠলেন সমাজকর্মী। মুকুল সিনহার জন সংঘর্ষ মঞ্চ থেকে শুরু করে দলিত অধিকার রক্ষার কাজে ব্যতিব্যস্ত একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যোগস্থাপন হল তাঁর।

এদিকে চাকরি নেই, নিজের খরচ চালানো দায়। অন্যদিকে আন্দোলন, মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই। হিমশিম খেতে খেতেও রুখে দাঁড়ান তিনি। বন্ধুদের মাসিক ১-২ হাজার টাকা সাহায্যও নিতে হয় তাঁকে। এক সাক্ষাৎকারে সেই কথা স্বীকার করেন তিনি।

২০০৯ নাগাদ দলিত সম্প্রদায়ের জমি অত্যাচারের নিদর্শন দেখেন তিনি। সুরেন্দ্রনগরে জমি-সমস্যায় থাকা অনগ্রসর শ্রেণির পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু আইনি লড়াই?

এবার নিজেই তুলে নিলেন লড়াইয়ের ব্যাটন। ২০১৩ নাগাদ একাধিক লড়াইয়ের পর পাশ করলেন আইন। হয়ে উঠলেন আইনজীবি। দলিতদের হয়ে গুজরাত হাই কোর্টে শুরু করলেন আইনি লড়াই।

'উনা যাত্রা'য় জিগনেশ-যোগ

উনা, গুজরাতের এই অখ্যাত জনপদ রাতারাতি কুখ্যাত হয়ে ওঠে। দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতনের ছবি প্রকাশ্যে আসে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে। সরব হন জিগনেশ। একাধিক মঞ্চের সঙ্গে যোগসাজশে রুখে দাঁড়ান রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চের নেতা। ততদিনে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। শুরু হয় উনা যাত্রা। আর সেই যাত্রাকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক দল ছাড়িয়ে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন তিনি। আন্না হাজারে, মেধা পাটেকরকে ছাড়িয়ে জিগনেশ মেভানি হয়ে উঠলেন নতুন নেতা।

এই যাত্রার পরপরই রাজ্যের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ফের সরব হলেন তিনি। দিল্লির অলিন্দে, রাজপথে নাম ছড়াল জিগনেশের। দলিত 'অস্মিতা যাত্রা' থেকে শুরু করে 'আজাদি কুচ'- শোরগোল ফেললেন এই যুবক। একাধিক জেলার উপর দিয়ে মাতলেন আন্দোলনে। অধিকার রক্ষায়। বাধা এল। সরকারের, পুলিশের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হলেন তিনি। কিন্তু চলল আন্দোলন, অধিকার রক্ষার লড়াই।

রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চের নামে শুরু হল লড়াই। একা কুম্ভ নেতৃত্ব দিলেন রাজ্যজুড়ে। দলিত অধ্যুষিত এলাকা হল উত্তাল। দলিত অধিকার রক্ষায় আটকে গেল রেল, আগুন জ্বলে উঠল রাস্তায়। এবার আলোচনার পথে এল সরকার।

আরও পড়ুন- আইন মানেনি পুলিশ নিজেই, জিগনেশের গ্রেফতারি সম্পর্কে এই মত অনেকেরই

গ্রেফতার বিড়ম্বনায় জিগনেশ

এই আন্দোলনের পথেই বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে তাঁকে। দিল্লি থেকে আহমেদাবাদ পৌঁছতে গ্রেফতার করা হয়েছে দলিত নেতাকে। ফের একবার বিক্ষোভের সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। যা তাঁর বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরেও বজায় থেকেছে। মধ্যরাতে মোদির বিরুদ্ধে সরব হয়ে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। অসমের এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। চলেছে একাধিক ধারায় হেনস্থার কাজ। কোকড়াঝাড়ের আদালতে বিচার চলেছে। উত্তাল হয়েছে দেশ। অবশেষে ছাড়াও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু একাধিক ঘটনা এবং হুমকির সম্মুখীন হয়েও লড়ে গিয়েছেন জিগনেশ।

রাজনীতিতে পা

ভেদগাম আসন থেকে ২০১৭ সালে নির্বাচনে লড়েন জিগনেশ মেভানি। নির্দল প্রার্থী হিসেবে সেবার জয়ী হন তিনি। সমাজকর্মী জিগনেশ মেভানির পা পড়ে গুজরাত বিধানসভায়। সেখানেও লড়াই চলে সমান তালে। একবার বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হতে হয় তাঁকেও। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি।

বিধায়ক হিসেবে পুলিশের অত্যাচার গ্রেফতারি ছাড়িয়েও ২০২১-এ তাঁর আন্দোলন, দিল্লিতে পদার্পণের অন্যতম সঙ্গী, পরিচিত মুখ কানাইয়া কুমারের সঙ্গে কংগ্রেসে যোগ দেন জিগনেশ মেভানি। হয়ে ওঠেন প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সম্পাদক। শুরু হয় নয়া লড়াই। দলিত থেকে অবহেলিত শ্রেণি, পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন নতুনভাবে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি, আদিবাসী উচ্ছেদের ঘটনার প্রতিবাদ-আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি।

গুজরাত নির্বাচনে জিগনেশ-প্রভাব

বিজেপি প্রভাবে গুজরাতে একপ্রকার ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের হাল ধরতে কাজে লাগানো হয় তাঁকে। কার্যত কংগ্রেসের গুজরাত-মুখ হয়ে ওঠেন এই নেতা। এক বছরেই দলিত নেতা শুরু করেন রাজ্য জুড়ে প্রচার, বিজেপি-বিরোধ। রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলছেন, জিগনেশ মেভানির এই প্রভাব যদি কংগ্রেসে না থাকত তাহলে আরও খারাপ হত কংগ্রেসের নির্বাচনী ফলাফল। দুই অঙ্কেও পৌঁছতে পারত না কংগ্রেস, বলছেন তাঁরা। দাবি, মূলত দলিত এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ভালো ফল করেছে কংগ্রেস। আর যেখানে বিজেপি অল্প ভোটে জিতেছে, সেই সমস্ত আসনে ভোট কেটেছে আম আদমি পার্টি। অর্থাৎ ওই দলিত বা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় জয়ের নেপথ্যে কাজ করেছে বহুকাল পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে জনপ্রিয় মুখ জিগনেশ। তাঁর প্রচার কৌশল এবং মানুষের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কাজে লেগেছে কংগ্রেসের। ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল হলেও গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে একটু হলেও মৌলিক হয়ে উঠেছেন লড়াকু মেভানি। যাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে আলোচনার রসদও।

More Articles