স্বদেশি আন্দোলন থেকে সিনেমা, দেশলাই‌ বাক্সেই লুকিয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনের ভান্ডার

পৌরাণিক কাহিনি থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিভিন্ন মনীষীদের ছবি সব পাওয়া যেত এই দেশলাইয়ের বিজ্ঞাপনে।

একটা ম্যাচবক্স বা পাতি কথায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য দেশলাই দিয়ে কী কী করা যায়? আগুন জ্বালানো যায়, নানাবিধ কারুকার্য করা যায়। কিন্তু দেশলাই বাক্সের ওপর বিজ্ঞাপনও দেওয়া যায়? ভাবতে পারেন! আমাদের রান্নাঘর, পুজোর ঘর, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজে ব্যবহৃত এই দেশলাই নাকি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম? জেনে আরও অবাক হবেন যে, স্বদেশি আন্দোলনে বিজ্ঞাপনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে দেশলাই বাক্সকে ব্যবহার করা হতো। তাই দেশলাই শুধু আর জ্বালানি নয়, সময়ের খাতে বয়ে আসা এক ঐতিহাসিক বিবর্তনের জ্বলন্ত দলিলও বটে।

কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনে যাওয়ার আগে দেশলাই আবিষ্কারের ইতিহাসটা জেনে নেওয়া জরুরি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আদিম মানুষ দু'টি শুকনো কাঠ ঘষে আগুন জ্বালাতে শেখে, তারপর একধাপ এগিয়ে তার হাতে এল চকমকি পাথর। হাজার হাজার বছর ধরে এই চকমকি পাথর দিয়ে আগুন জ্বালানোর কাজ চলেছিল। দেখা গেল, চকমকি পাথর শুধু আগুনের ফুলকি তৈরি করছে, কিন্তু মানুষ এমন এক দাহ্যবস্তু চাইছিল, যা আগুনের ফুলকি পেলেই জ্বলে উঠবে।

এরপর বিজ্ঞানের অগ্রগতি হলো। ১৬৮০ সালে হাউক উইৎস নামক এক বিজ্ঞানী প্রথম নরম কাঠকে সরু করে চিরে তাকে ভালোভাবে শুকিয়ে তাতে গন্ধকের প্রলেপ দিয়ে আধুনিক দেশলাই কাঠির প্রাচীন রূপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ফসফরাসযুক্ত নিরাপদ দেশলাই প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৫৫ সালের ইউরোপে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশলাই ইউরোপ থেকে ভারতে আসে। ১৯১০ সালে ভারতে প্রথম দেশলাই উৎপাদন শুরু হয় জাপানি অভিবাসীদের হাত ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে দেশলাই শিল্পের কার্যালয় তামিলনাড়ুতে চলে যায়।

আরও পড়ুন: তিরঙ্গা নয়, তার নাম ছিল ‘কলকাতা পতাকা’, জাতীয় পতাকার যে ইতিহাস রয়ে গেছে আড়ালে

দেশলাইয়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, যখন দেশলাই প্রথম এই ভারত সাগরের তীরে তার তরী ফেলেছিল, তখন দেশলাই বাক্সে পাশ্চাত্য সভ্যতার ছবি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে ইউরোপীয়রা খুব চালাকির সঙ্গে দেশলাই বাক্সে বিদেশি ছবির সঙ্গে মিলিয়ে কিছু ভারতীয় দেবদেবীদের ছবিও দিতে শুরু করে।

সামান্য একটা দেশলাই বাক্স, কিন্তু তার গায়ে ফুটে ওঠা গল্প যেন সময়ের ধারাবিবরণী। মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই আছে রূপকথাও। দেশলাই বাক্স কিন্তু বিজ্ঞাপনের জায়গা ছিল না কোনওদিন। স্বদেশি আন্দোলন এই দেশলাই শিল্পের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। দেশের মানুষের মনে দেশের প্রতি প্রেম এবং দায়িত্ব জাগিয়ে তোলার জন্য দেশলাইকে হাতিয়ার করে ঘরে ঘরে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হতো। এক অসামান্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল এই দেশলাই শিল্প।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের দ্বারা লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানুষ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। স্বদেশির ডাক এসেছিল তখন থেকেই। যখন ব্রিটিশরা বাংলা ভাগ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী নেতারা ব্রিটিশ কর্তৃক এই বাংলা বিভাজনকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দুর্বল করার উপায় হিসেবে দেখেছিলেন, তাই প্রতিবাদস্বরূপ ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট তারা কলকাতার টাউন হলে স্বদেশি আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। যেখানে আন্দোলনের বার্তা ছিল স্পষ্ট– ‘বিদেশী দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ’। 'জীবনস্মৃতি'-তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘স্বদেশে দিয়াশলাই কারখানার স্থাপন করা আমাদের সভার উদ্দেশ্য ছিল‌।'

স্বদেশি আন্দোলনের এই মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশলাই প্রস্তুতকারকরা, যদিও শুধু স্বদেশি আন্দোলনে যোগদানই নয়, নিজেদের বিক্রি বাড়ানোর জন্যও তাঁরা এই দেশপ্রেমিক উদ্দেশ্যকে সমর্থন করেছিলেন। যেহেতু স্বদেশি মানে ছিল ভারতীয় পণ্য কেনা, তাই বাংলায় তৈরি প্রথম দেশলাই ছিল বাংলা ভাষায় লেখা। দেশলাইয়ের লেবেলে লেখা হলো, ‘স্বদেশী দিয়াশলাই কলিকাতায় প্রস্তুত।' লেখা হলো, ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার‌।' স্বদেশি দেশলাইয়ের প্রচারে এক ব্যবসায়ী একটি অসাধারণ বিজ্ঞাপন করেছিলেন, একটি উড়ন্ত ড্রাগন তার চারটি থাবা নিয়ে দু'টি বাঘের ওপর নেমে আসছে। আর নিচে লেখা ‘স্বদেশী দিয়াশলাই কলিকাতায় প্রস্তুত’। এছাড়া সেই সময়ের দেশলাই বাক্সে ছিল স্বদেশি নেতাদের ছবি, সেই সময়ের সংগ্রামের টুকরো টুকরো ছবি। কিন্তু এই ছোট্ট বাক্সের বিজ্ঞাপন যেন সকলের কাছে দৃষ্টিকটু না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতেন তারা। ভারতীয় জাহাজ থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার- দেশলাইজুড়ে থাকত নানাবিধ ছবি।

১৯৩১ সালে দেশলাইজুড়ে ছিল গান্ধী আরউইন চুক্তি কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভারতের প্রথম টকি ‘আলম-আরা’-র ছবি। শুধু টকি নয়, সেই সময়ের বিভিন্ন ছবি, যাকে আমরা 'টকিজ' বলে থাকি, তারও বিজ্ঞাপন করা হতো এই দেশলাই বাক্সের গায়ে। এরপর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকালে কলকাতার দেশলাইয়ে সবচেয়ে বেশি দেখা গেল, পতাকা, চরকা ও বন্দে মাতরম। শোনা যায়, তখন দেশলাই পেটি স্টিমারে করে কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গে যেত আর পুলিশ সতর্ক পাহারায় স্টেশনে থাকত। যখনই আপত্তিজনক কোনও লেখা চোখে পড়ত, সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশলাই বাজেয়াপ্ত করা হতো। সুইডেনে এক দেশলাই বাক্স ছাপা হয়েছিল, যাতে ‘বন্দে মাতরম’ লেখা ছিল।

এরপর ভারতীয় পতাকার নকশা নিয়ে আন্দোলনের প্রভাবও পড়েছিল দেশলাইয়ের ওপর। ভারতীয় জাতীয় পতাকার নকশা নিয়ে চার দশক ধরে বিস্তর আলাপ-আলোচনা এবং আন্দোলন হয়েছে। কেউ তিরঙ্গার পক্ষে, তো কেউ চার ধরনের রঙের পরামর্শ দেন। একটি দেশলাই ছাপা হলো, যাতে শুধু গেরুয়া রঙ। শুধু জাতীয় পতাকা নয়, দেশলাই বাক্সে স্থান পেয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, লোকমান্য তিলক, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ছবিও। এমন দেশলাইও ছিল, যার ওপর জ্বলজ্বল করত ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের ছবি। দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করে ‘ভারতমাতা’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘হিন্দ মাতা’ নামেও দেশলাই বেরিয়েছিল সেসময়।

একটি প্রয়োজনীয় এবং বহু-ব্যবহৃত জিনিসকে ব‍্যবহার করা যায় কতরকমভাবে, জনগণের কাছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দেবার অন্যতম পথ ছিল এই দেশলাই। পৌরাণিক কাহিনি থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিভিন্ন মনীষীদের ছবি সব পাওয়া যেত এই দেশলাইয়ের বিজ্ঞাপনে। চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে লেবেলে লেখা থাকত, ‘CITIZEN OF THE WORLD’। তাই গর্ব করে বলাই যায়, একটা দেশলাই শুধু রান্নাঘরে আগুন জ্বালাতে নয়, দেশের আন্দোলনে অগ্নিসংযোগেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে।

More Articles