শীতার্ত কলকাতা, হুইস্কি এবং ব্যর্থ প্রোপোজালগুচ্ছ

Kolkata Winter: মাফলারে মুখচোখ ঢাকা কন্ডাক্টরকে মনে হতো কোনও নভশ্চর। রাস্তাঘাট খাঁ-খাঁ করত। দু-একটা কুকুরের চিৎকার। কুয়াশার মধ্য দিয়ে ট্রাম এগোত। আধুনিক ঘোড়া যেন।

এবছর তেমনভাবে শীতই পড়ল না। দেখা যাচ্ছে না কুহকিনী কুয়াশাও। কলকাতার কাঠখোট্টা, নীরস, পাটোয়ারি রাস্তাঘাটও কুয়াশার মধ্যে দিয়ে বেশ মোহময়ী মনে হয়। আটের দশকে এক-এক দিন আমরা বন্ধুরা দু-একজন মধ্য কলকাতার সস্তা শুঁড়িখানায় বা শুঁড়িখানা সংলগ্ন রাস্তায়, উনুন বা আগুনের পাশে অচেনা সব লোকজনের সঙ্গে বসতাম। বাংলার নানা ভাষাবৈচিত্র্যে, দেহাতি হিন্দিতে, এমনকী ওড়িয়া মেশানো বাংলায় কত রকমের দীর্ঘশ্বাস আর মনখারাপের গল্প শুনতাম। গল্প শুনতাম স্মৃতির আর অভিজ্ঞতার। ঝমঝম করে ডালহৌসির ট্রাম, ২ নম্বর অথবা ৪ নম্বর লাস্ট ট্রাম হিসেবে দেখা দিত। তাদের ফোঁসফোঁস আওয়াজটাও মনে হতো অভিমানের শ্বাসাঘাত। মাফলারে মুখচোখ ঢাকা কন্ডাক্টরকে মনে হতো কোনও নভশ্চর। রাস্তাঘাট খাঁ-খাঁ করত। দু-একটা কুকুরের চিৎকার। কুয়াশার মধ্য দিয়ে ট্রাম এগোত। আধুনিক ঘোড়া যেন। সেই ট্রামের জানলা দিয়ে লাল ডাকবাক্স, ফাঁকা রিকশা-ঠেলা, ল্যাম্পপোস্ট আর বাড়ির থামগুলো মিলেমিশে, অবয়ব পালটাত। পার্কের রেলিং আর স্টপেজের ছাউনি আঁকাবাঁকা দেখা যেত। ভৌতিক মনে হতো চেনা তল্লাট। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গা-ছমছমে গল্প সত্যি মনে হতো। সবই হয়তো সুরা-অভিঘাত। পরাবাস্তবের প্রহেলিকা। 

শুধু অবশ্য নেশাতাড়িত কুয়াশা এবং শীতই নয়, কখনও কখনও ‘মানবিকতা’ এবং ‘সামাজিকতা’ দ্বারা চালিত হয়ে শীতের রাত্রিতে টহল দিয়েছি শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সেই সূত্রে মনে হয়েছে, রাত্রে, বিশেষত শীতের রাত্রে, ‘আরেকটা কলকাতা’ জেগে ওঠে, সে জাগরণ শুরু হয় সাড়ে বারোটা নাগাদ, চলে ভোর চারটে পর্যন্ত! এ বিষয়ে দু-একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। 

নানা সময়ে দুই বা তিনটি অদ্ভুত জায়গায় শীতের রাতে আমি গেছি। প্রথমটি হাসপাতাল বা নার্সিং হোম, দ্বিতীয়টি শ্মশান। দু' ক্ষেত্রেই প্রধান কারণগুলি খুব মনোগ্রাহী নয়। একটি অসুস্থতা এবং অন্যটি মৃত্যু। তখন কলকাতার অদ্ভুত এক ছবি আমি দেখেছি। কয়েকটি মোড়ের কথা বলি। প্রথমটি শ্যামবাজার মোড়, দ্বিতীয়টি এক্সাইড মোড়, তৃতীয়টি মৌলালী মোড়, চতুর্থটি কলেজ স্ট্রিট-গোলদিঘি। রাত একটার সময় রোগীর আত্মীয়স্বজন এবং অন্যান্যদের দেখা যায়। বলা ভালো রাতভোর। মূলত বড় হাসপাতালগুলিকে কেন্দ্র করে এই জমায়েত। পিজিতে প্রধানত রাত্রে যাঁরা থাকেন আট এবং নয়ের দশকে কুয়াশা ফুঁড়ে কিছু মানুষ চা, ডিম ভাজা, পাঁউরুটি, কখনও কখনও হাতরুটি এবং আলুর দম নিয়েও হাজির থাকেন। কখনও কখনও দেখেছি মিষ্টি বা ঘুগনি, কলা বা ঝালমুড়ি। সিগারেট-বিড়ি। এই ধরনের ভিড়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় অবশ্য অসুখ, রোগী বা রোগিণীর কষ্ট, ডাক্তার এবং হাসপাতালের অব্যবস্থা ইত্যাদি। অবসন্ন করার মতো আলোচনা। পাশাপাশি চলে আসে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, দুর্ভাগ্য, জীবনের অনিত্যতা — এমন অনেক বিষয়। শ্যামবাজার মোড়েও একই অবস্থা। উডল্যান্ড বা বেলভিউতে আলোচনা একই, তবে উচ্চবিত্ত বাক্য, শব্দ ব্যবহার এবং পশ্চাৎপট। 

শীতের রাতে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে গরম চা এবং খিদের মুখে সাদামাটা খাবার বেশ উপভোগ্য তখন। শ্মশানে-শ্মশানে একই দৃশ্য। কনকনে ঠান্ডা গঙ্গার জলে অনেকসময় বন্ধু-স্বজন বা বয়স্ক আত্মীয়কে সাহায্য করতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে পৌঁছতে হয়েছে, স্রোতে নাভি ভাসাতে। দূরে দেখেছি দু-দু'টি সেতু। তার ওপর-নীচে হয়তো বড়দিন বা নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ‘গহন আঁধারে’ আলোকসজ্জা ‘জ্বলিতেছে কেন, যেন সারে সারে প্রদীপমালার মতো’। এও এক শীতের কলকাতা। যেখানে মানুষের কান্না, বেদনা, হাহাকার আর মনোকষ্ট ভেসে যাচ্ছে নদীর ধারায়। এমনই এক রাত্রে, খানিকটা অবিশ্বাস্যই দৃশ্যটি; দেখেছিলাম স্রোতে ভেসে যাচ্ছে একটি প্রদীপ। একলা সেই দিয়া, শ্মশানঘাট, জলের ছলাৎ-ছল শব্দ, ধোঁয়া, ভাঙা ঘট — মনে হয়েছিল প্রতীকী। শহর কলকাতার উৎসব আর হইচই নিয়ে অনেক কথা বলেছি, এ হলো তার উল্টোদিক।

বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি নানা সময়ে একরাশ উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা নিয়ে গভীর-গভীরতর রাতে, হানা দিয়েছি ব্লাড ব্যাঙ্কে। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সেগুলিও প্রায় সারা রাত খোলা থাকত। সেইসব অপার্থিব শীতের রাত্রি, সূঁচের মতো ধারালো হিমেল হাওয়া, রাস্তার ধারে আগুনের ওম আর শ্মশানের হরিধ্বনি, আশ্চর্য সব লোকজন, কিছু ভিখিরি, ভবঘুরে, ক্লান্ত মুটেমজুর, ঘুমন্ত দেহ আর কুয়াশা ঠেলে ক্বচিৎ কখনও হেডলাইটের আলো, অথবা হাসপাতালে ওষুধের গন্ধ, গম্ভীর নার্স কিংবা ডাক্তারদের হেঁটে যাওয়া। রাস্তার দৃশ্য আর অভিজ্ঞতা থেকে জীবনানন্দ দাশের ‘রাত্রি’ কবিতা মাথায় ঘুরপাক খায় – তার দৃশ্যকল্প, টুকরো টুকরো উচ্চারণ, অন্ধকার এবং জমাট দীর্ঘশ্বাসগুলি।

‘এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে’

অথবা

‘তিনটি রিক্‌শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে মায়াবীর মতো জাদুবলে’।

তারপর

‘নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে/ গান গায় আধো জেগে ইহুদি রমণী’… 

দিনের কলকাতা, শীতের কলকাতা, কোট বুট জ্যাকেট আর পুলোভার-পশমিনার কলকাতা। ব্লেজার আর স্নিকার আর হুডির কলকাতা। রাতের কলকাতা কম্বলের, চাদরের, ফুলকি ওড়া আগুনের, কেঁপে কেঁপে কাথাকানি দিয়ে কান ঢাকা, মুখ ঢাকা, দুই ভিন্ন পৃথিবী। শীতকালে বাবুঘাটে গঙ্গাসাগরমুখী তীর্থযাত্রীদের কথাও মনে রাখতে হবে। চিড়িয়াখানা আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ভিড়, বড়দিন আর নিউ ইয়ারের মেলা - সে কলকাতাও তো আমাদেরই।

আরও পড়ুন- কলকাতা শহরের ‘পাগল’-রা সব গেল কোথায়?

 

শীতের কলকাতায় একটি নিশ্চিন্ত ছুটি-ছুটি ভাব আছে। হতে পারে তার কারণ বার্ষিক পরীক্ষা শেষের নিশ্চিন্ততা। গ্রীষ্মের ছুটি জুড়ে ঘণ্টা বাজাতে থাকে হাফ-ইয়ার্লির দুশ্চিন্তা, কিছু হোম-টাস্ক আর পুজোর ছুটি জুড়ে শেষ পরীক্ষার চোখ রাঙানি। এর মধ্যে বড়দের হুঁশিয়ারি! শীতের হাওয়ায় যখন নাচন লাগে, তখন অবশ্য পরীক্ষার চাপ নেই। পরের বছরের অপেক্ষা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও যেন একটা দম ফেলার ফুরসত। এখন যেমন সেমিস্টার সমাপ্তির পালা। এই ছুটি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু কলকাতায় হিমের পরশ ময়দানের ঘাসের ডগায় শিশিরের রেখা ছুঁইয়ে দেয়। ক্রিকেটের মরশুম। একটা সময় কত খেলা দেখেছি এখানে-ওখানে। এ মাঠ-সে মাঠে খেলতে গেছি। জিতেছি। হেরেছি। জিতেছে প্রতিবার ক্রিকেট শুধু। ময়দানের সেসব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। পুত্রকে নিয়ে জর্জ টেলিগ্রাফ-এ যেতাম। মনুমেন্টের পাশের মাঠে প্র্যাকটিস হতো। কোচ ছিলেন জগুদা। সে সময় দেখতাম, ময়দানের আনাচে কানাচে কত ক্লাব। কত কোচিং সেন্টার। কত ম্যাচ। শীতের মিঠে রোদ্দুরে লাল বল আর সবুজ ঘাসে কত অনাবিল অমলিন মুহূর্ত। টেন্টের উপাদেয় চিকেন স্টু। ময়দান আর শীতের দুপুর আবার একটা নিজস্ব দুর্দান্ত জগৎ। সাইট স্ক্রিনগুলো হু-হু হাওয়ায় ফুলে ফুলে ওঠে। ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচ মানেই হাইকোর্ট অ্যান্ড প্যাভেলিয়ন এন্ড। পরে হলো ক্লাব হাউস। কমল ভট্টাচার্য, পুষ্পেন সরকার আর অজয় বসুর গলা। খাটো লেংথের বল, যেখানে খেলেছেন সেখানেই পড়েছে… অথবা বিদ্যুৎগতিতে বল চলে গেল সীমানার বাইরে! কেতাবি ঢংয়ের খেলা, মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, চা-পানের বিরতি। কতবার স্মরণীয় সব খেলা দেখেছি ইডেনে। চোখ বুজলেই দেখতে পাই, আজহারউদ্দিনের ১১০ রানের অভিষেক সেঞ্চুরি। সাল ১৯৮৪-৮৫। কেননা, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৪ শুরু হয়েছিল টেস্ট। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। দেখতে পাই, শচিনের সেঞ্চুরি। সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, ২০১০। রান করেছিল তেন্ডুলকার ১০৬।

ইডেন গার্ডেন থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এবার যাচ্ছি ময়দান মার্কেটের দিকে। এই মার্কেটে খেলার নানাবিধ সরঞ্জাম পাওয়া যায় সারা বছর জুড়ে। ঠিকঠাক দরদাম করতে পারলে বেশ নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যাবে এখানে। রাস্তা পেরোলেই গ্র্যান্ড হোটেল। তার পিছনে নিউ মার্কেট। এদিকে লিন্ডসে স্ট্রিট, ওদিকে জাদুঘর। এদিকে গ্লোব সিনেমা, ওদিকে কলকাতা কর্পোরেশন, একদিকে রানি রাসমণির বাড়ি, অন্যদিকে টিপু সুলতানের মসজিদ – পুরো এলাকাটাই এসপ্ল্যানেড! কর্মখালি কোথায়, ধর্মতলা জুড়ে আমি তো শুধু দেখি কত মানুষের কত রকমের রুজি-রোজগার, দোকানপাতি, বেসাতি-পসরা, আর ভিড়। নিজাম, আমিনিয়া, খালসা, কারকো, সিদ্ধেশ্বরী ভোজনালয়, দু’পা দূরে চাঁদনির ভেতর সাবির, ওদিকে বাদশা আর এদিকে রিজেন্ট কত রকমের জিভে জল আনা খাদ্যসামগ্রী। বস্তুত এই অঞ্চলে অলিগলি জুড়ে নানা ধরনের খাবার, অদ্ভুত সব মানুষ আর শীতের মেজাজে রংচঙে স্মৃতি। অঢেল। আশ্চর্য। অবাক করা।

মনে পড়ে গেল, আমাদের ছেলেবেলায় এই সময়টা ছিল কেক-পেস্ট্রি-ব্রাউনি খাবার প্রকৃষ্ট সময়। কোনও সন্দেহ নেই হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট, বাবার হাত ধরে, মায়ের পাশে পাশে তারপর বন্ধু-প্রেমিকা-গৃহিণীদের সঙ্গে, তারপর ছেলেমেয়ের হাত ধরে ঢুকে পড়েছি একমেবাদ্বিতীয়ম নাহুম-এর দোকানে। আমার এক দাদু, অধ্যাপক হৃষীকেশ চক্রবর্তী (মায়ের মেসোমশাই) আমাকে নিয়ে যেতেন নাহুমের অতি উপাদেয় প্যাটিস আর বার্গার খাওয়াতে। তাঁর হাত ধরে সাতের দশকের মাঝামাঝি, গিয়েছিলাম নিউ মার্কেটের মাছ-মাংসের বাজারে। বেশ কয়েকটি পিগারি ছিল তখন নিউ-মার্কেটের পিছন দিকে। একটির নাম ছিল, বল্‌ডউইন পিগারি – আশ্চর্যভাবে মনে আছে। এই নাহুমের থেকে আর একটু পিছিয়ে এলে, ছিল চমৎকার একটি কেক-পেস্ট্রির দোকান। জানি না, কারও মনে আছে কিনা! আমি প্রায়শই সেই দোকানের পেস্ট্রি খেতে যেতাম। তার নাম ‘দ্য গামা’ স’।

আরও পড়ুন- ট্রিঙ্কাস-এর নৈশ গায়িকার প্রেমে পড়েছিল ছোটবেলার বন্ধু

প্রকৃতপক্ষে, এসপ্ল্যানেডের ভিড়, উত্তুরে হাওয়া এবং ঝলমলে বিপণির একটা অনবদ্য জৌলুস আছে। তার সঙ্গে ছিল দু-দুটো বিশাল সিনেমা হল। লাইট হাউস আর নিউ এম্পায়ার। আমাদের মোবাইল ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, টিভি চ্যানেলহীন শৈশব-কৈশোরে এইসব প্রেক্ষাগৃহ ছিল বিলিতি সিনেমা দেখার প্রধান পর্দা। আরও ছিল টাইগার। যেখানে গাড়ির শো-রুম হয়েছে। সেইসব স্মৃতিবাহী হলিউডের ‘বাতায়ন’ ভেঙে বহুতল তৈরি হচ্ছে। একটা হল ছিল পুরসভার পাশে, তার নাম মিনার্ভা। পরে হল চ্যাপলিন। এখন বহুতল। আপিস হচ্ছে। এলিট ভেঙে শূন্য। জ্যোতি উঠে গেছে। গ্লোব এতদিন বন্ধ ছিল। মেট্রো তার পুরনো উজ্জ্বলতার লেশমাত্র ধরে রাখতে পারেনি। সময় তো পালটাবেই। তবু এসপ্ল্যানেডে হাঁটতে হাঁটতে দেখি বিগত বছরগুলোকে, সে সময়ের বাড়ির চেহারা মনে করি, পুরনো মানুষগুলোর কথা ভাবি।

একসময় আমাদের বেশ বন্ধু গোছের হয়ে গিয়েছিলেন শওকত ভাই, নিজামের বহু পুরনো কর্মচারী। তখন নিজামে নিষিদ্ধ মাংসের রোল ছিল স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়, পকেটের জন্যও আরামপ্রদ। সেই সূত্রেই শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয়। সেটা ওই আটের দশকের গোড়ার দিক। নিজামের পিছনে একটা জনপ্রিয় চায়ের দোকান আছে। সেখানে চা খেতাম আমরা। ফেরার পথে একটু আড্ডা সেরে নিতাম নিজামে। আমি আর আমার দুই বন্ধু তাপস আর অমিত, গিয়েছিলাম শওকত ভাইয়ের ডেরায়। জানবাজারের পিছন দিকে, কলিন লেনের দিকে মেস করে থাকত। খুবই ছোট্ট, অপরিচ্ছন্ন ঘর। দারিদ্র্যে ভরা। আমি ভাবছিলাম, সারাদিন বিরিয়ানি, চিকেন আর মাটন, কাবাব থেকে রেজালার মধ্যে কাটায় শওকত ভাই। হাতে করে প্লেটে প্লেটে টেবিলে সাজিয়ে দেয় সেইসব খানা!

হইহই এসে গেল নতুন বছর। ২০২৫। গ্র্যান্ড হোটেলের একতলায় কত রকমের দোকান। তার মধ্যে একটা হল ‘নিউ ক্যাথে’। এই পানাহারের বিপণি সম্পর্কে কে বা কারা রটিয়েছিল যে, এখানে হুইস্কি খেয়ে কাউকে প্রপোজ করলে নাকি কখনও প্রত্যাখ্যাত হতে হয় না! জানি না, বার-এর কর্মচারীদের কেউ ফন্দি করে এটা প্রচার করেছিল কিনা। খুবই বুদ্ধিমান বলতে হবে! সেজন্য আমাদের বন্ধুমহলে বেশ ঠেলাঠেলি পড়ে গিয়েছিল। সেই মিথ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যখন কোনও এক পয়লা জানুয়ারিতে, দু-পেগ সস্তা হুইস্কি খেয়ে জয়ন্তীকে প্রপোজ করে চূড়ান্তভাবে বিফল হল অরিন্দম [নাম পরিবর্তিত, কেননা দুজনেই বর্তমান]। তারপর দেখা গেল এটা ব্যতিক্রম নয়। আগের তিনজন সফল হয়েছে একথা যেমন সত্যি, পরের সাত-আটজন প্রত্যাখ্যান খেয়ে সম্পূর্ণ থম মেরে গেছে, এ হলো বৃহত্তর সত্য। ফলে আবার সবাই গুজব থেকে বাস্তবে ফিরে এল। শীতকাল এলেই সে সব কতকালের হুজুগ মনে পড়ে! জয়ন্তীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল গেল ডিসেম্বরেই। কর্নফিল্ড রোডের মুখে। পঞ্চাশোর্ধ সুখী, সংসারী জয়ন্তীকে দেখে আমি হেসে ফেললাম! অরিন্দম শুনেছি বহুদিন দিল্লিতে প্রবাসী। শীত, স্মৃতি আর আমি – ঘুরে বেড়াচ্ছি এসপ্ল্যানেডে!

More Articles