বাউল কম, শান্তিনিকেতন দাপাচ্ছে বাবুর বাড়ির 'ফাউল'-রা
Santiniketan Baul: এখন শান্তিনিকেতন ও তার আশেপাশে জায়গা করে নিয়েছে সমস্ত বাবুর বাড়ির বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরা। তাদের পিঠে দোতারা আর সঙ্গে গাঁজার থলি। গান কিছু হচ্ছে না, বাউল চর্চাও হচ্ছে না।
রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, বোলপুর আর বীরভূমের সঙ্গে শক্তপোক্তভাবে, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বাউলের ভাব ও চর্চা। সে আজকের কথা নয়। আজ তার চমক-ঠমক বেশ উচ্চকিত। কিন্তু আদতে তলিয়ে দেখলে তা অন্তঃসারশূন্য। কেন এবং কীভাবে পর্যায়ক্রমে তা লিখব। লিখব বাউলের প্রকৃত সাধনা ও গান কেমন করে শান্তিনিকেতন থেকে, যাকে বলে উচ্ছিন্ন হলো, সেই কথা। তবে বলে রাখি, এমনটা ছিল না শুরুর সময়বেলা। ফলে শুরু করতে হলে রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করতে হবে। কেননা তিনিই ছিলেন লালন থেকে বাউল গান ও চর্চার প্রধান ও বলা যেতে পারে প্রথম প্রচারক। তাঁর কারণেই বাউলের গান প্রাথমিকভাবে বিস্তৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথের গান এবং সাহিত্যে নানাভাবে তা স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও বাউল কোথাও কোথাও মনে হয়েছে একে অন্যের পরিপূরক। কবি কখনও কখনও নিজেকেই বাউল বলেছেন। বলেছেন, রবি-বাউল। সেসব অন্য কথা। আমাদের আলোচনার মূল উৎসে এবার ফিরব। তা হলো, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে বাউলের দীর্ঘকালীন সম্পর্ক।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত বাউল গান শুনতেন। আশ্রমিকদের বাউল শোনাও ছিল অভ্যাসের অন্তর্গত। এক সময় বীরভূমের প্রখ্যাত বাউল নবনী দাসকে এই শান্তিনিকেতনে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ ও গান শুনতেন। পরবর্তীতে তাঁকে জমিও দিয়েছিলেন বসবাসের জন্য বা আখড়া তৈরি করার জন্য। নবনীর অবর্তমানে এই আখড়া বা আশ্রমের অধিকার বা দায়িত্ব বর্তায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র পূর্ণদাস বাউলের ওপর। এখান থেকেই অবাউলীয় কাজকর্মের শুরু বলা যায়। পূর্ণদাস লক্ষ-কোটি টাকায় এই জায়গাতেই তৈরি করতে থাকলেন লোকনাথ বাবার মন্দির— যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কেননা বিশ্বভারতীর জায়গায় কোনও মন্দির-মসজিদ- গির্জা করা যাবে না তা স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দলিলেই আছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ প্রথমে আপত্তি জানায়। পূর্ণদাস বেফিকির মামলা করেন। তা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শেষতক কোর্টের ডিক্রি নিয়ে সেই মন্দির ধূলিসাৎ করে দেয় বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন- ক্রমে জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন
এখন প্রশ্ন হলো, হঠাৎই লোকনাথ বাবার মন্দির কেন? এর উত্তর হলো, পূর্ণদাসের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থান, তাই-ই প্রথম থেকে এক নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক তৈরি করেছে। ইদানীং বাউলকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে এই দেশের শাসকদলের লেজুড় হয়েছে অনেকেই। অথচ সমস্ত মূলধারার ধর্মকে নস্যাৎ করেই বাউলের উৎপত্তি। এখন মেলাখেলায় গেলেও অহরহ শুনি, হর হর মহাদেব। এরা কি বাউল? ভেক ধরলেই কি বাউল হয়? এখানে একটা গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, "আমি কে তাই আমি জানলেম না,/ আমি আমি করি, কিন্তু আমি আমার ঠিক হইল না। / কড়ায় কড়ায় কড়ি গণি,/ চার কড়ায় এক গণি /কোথা হইতে এলাম আমি, তারে কই গণি’— গানটি রবীন্দ্রভাবনার বিশ্বমুখী অভিযানে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
শান্তিনিকেতন তথা বোলপুরের কথায় এবার আসি। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও এখানে ছিল নানা বাউল ও বাউলের আখড়া বা আশ্রম। সেসময় আশেপাশের গ্রামে বাউলরা থাকতেন গ্রামগুলির শুরুতে বা শেষে, অর্থাৎ প্রান্তবাসী ছিলেন তাঁরা। তাঁদের মাটির দাওয়াতে বসে তখন গান শুনেছি। অধিকাংশের বাড়ি ছিল, যাকে বলে চালাঘর বা মাটির বাড়ি। ক্রমে সেখানে উঠল পেল্লাই কোঠাবাড়ি। পায়রার খোপের মতো ছোটছোট ঘর। আলো-বাতাস নেই বললেই চলে। এর কারণ সারা বছর এই সব তথাকথিত বাউলবাড়িতে কলকাত্তাইয়া আমোদগেঁড়ে অতিথিরা থাকবেন। শিকে ছিঁড়লে দু-পাঁচজন বিদেশের অতিথিও পাওয়া যেতে পারে। এভাবেই শুরু হলো প্রমোদ ব্যবসা, তা যত ছোট করেই হোক। আজ তার বপু বেড়েছে বহু গুণ। এর মধ্যেও নিশ্চয়ই কিছু ব্যতিক্রম আছে। তবে তারা কতিপয় মাত্র।
বাউল মানচিত্রে শুঁড়িপাড়ার কথা বলতেই হবে। এত ঘনীভূত বাউল বসতি আর কোথাও নেই। বোলপুর স্টেশনের কাছে এই গ্রামে একসময় প্রায় বিশ-পঁচিশজন বাউল বাস করতেন। আজ তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের কারণে সংখ্যা আরও বেড়েছে বটে কিন্তু বাউল পরিবেশ আর নেই। এখন এঁদের নিজেদের ঘর-দাওয়া বা নিজস্ব আখড়ায় গানের পরিবেশ প্রায় নেই। এখন তাঁরা বাধ্যতই হাটে হাটে গান করেন। হোটেল-রিসর্ট তাঁদের প্রিয় মেহফিল। কলকাতার বাবুরা বায়না করে নিয়ে যায়। মাঝরাত অবধি চলে নেশা আর গান। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা গান হয় তা আর কহতব্য নয়। শুঁড়িপাড়ার বাইরেও কিছু বাউল গায়ক আছেন যাঁরা অধিকাংশই কলকাতার ব্যান্ডমুখী। কেউ কেউ আবার একে-তাকে ধরে বিদেশেও ঘুরে আসেন। তবে ওই যে লিখেছি, গান হয় না। অথচ একটা সময় বাউলের কমতি ছিল না এই তল্লাটে। রামানন্দ, সুধীরদাস, গৌর ক্ষ্যাপা, বিশ্বনাথ দাস, দেবদাস, নিতাই চাঁদ, স্বপনদাস আরও কত না বাউল। বীরভূম তো বটেই, অন্য সব জেলা থেকেও তখন প্রখ্যাত বাউল শিল্পীরা আসতেন শান্তিনিকেতনের নানা আখড়ায়। সে সময় ছিল গানের রমরমা।
আরও পড়ুন- মদ, মাংস এবং … হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে
এখন চিত্রটা পাল্টে গেছে। এখন শান্তিনিকেতন ও তার আশেপাশে জায়গা করে নিয়েছে সমস্ত বাবুর বাড়ির বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরা। তাদের পিঠে দোতারা আর সঙ্গে গাঁজার থলি। গান কিছু হচ্ছে না, বাউল চর্চাও হচ্ছে না। তবে নেশায় দিন, প্রতিদিন কাটছে দিব্য। পোশাক আশাকে সব হাফ-গেরস্ত বাউল। চুল-দাড়ি, কারও কারও জটা। তুলসীর মালা থাকবেই। আর কথায় কথায় 'জয়গুরু' আর 'জয় শ্রীরাম'। এদের নাম দিয়েছি 'ফাউল'। অধিকাংশই বান্ধবী জুটিয়ে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। এরা সব স্বঘোষিত ক্ষ্যাপা-ক্ষেপি। এদের দিন চলে যায় বাড়ির টাকায়। কেউ কেউ কর্পোরেটে চাকরি করা বান্ধবী জুটিয়েছে। তারা সপ্তাহান্তে মেহফিলে যোগ দিতে আসে। ক'দিন কাটিয়ে যায় নেশাতুর সঙ্গ প্রলোভনে। অনেকেই বাউলমতে কণ্ঠি বদল করে বা মালাচন্দন করে বিয়ে করে ফেলছে। সেটা অবশ্য তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে একটা সাংস্কৃতিক রিউম্যাটিজম বা দূষণ যেন গ্রাস করে ফেলছে বোলপুর-শান্তিনিকেতনকে।
তবে আবারও বলব, সিংহভাগই এই ফাউলদের ফক্কিকারি চললেও দু-চারজন মনোযোগীরও খোঁজ পাওয়া যায়। তাঁরা যে তেমন গান গাইতে পারেন সবসময় তা নয়। তবে মূলত গান গাওয়ার চেষ্টা, কেউ যন্ত্র বাজাবার চেষ্টায় লেগে আছেন। সেক্ষেত্রেও অবস্থাটা যে খুব একটা পাল্টেছে তা নয়। ওই যে লিখেছি, চমক-ঠমক আছে কিন্তু গান নেই। যারা গাইছেন তারা অধিকাংশই বেসুরো। অনেকের কানে সুরই নেই। তথাপি হোটেল-রিসর্টগুলোতে, হাটে হাটে, মাচায় মাচায় এরা আছেন। বাউলের চিরন্তন বাদ্যযন্ত্র সরিয়ে রেখে এরা মূলত গিটার, অক্টাপ্যাড আর কিবোর্ড নিয়ে অনুষ্ঠানে জগঝম্প বাউল গাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যারা এদের দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছেন তারাও সুরতালের ধার ধারেন না। ক্রমাগত এক ক্যাকোফনিই যেন এদের প্রমোদনির্ভর বাউল গান। যারা গাইছেন, তাদের কোনও গুরুদীক্ষা নেই, সংগীত শিক্ষা নেই, নেই কোনও অনুশীলন। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এটা শুধু শান্তিনিকেতন বা বোলপুরের চিত্র নয়। সমগ্র বীরভূমই আজ বাউলশূন্যতায় আক্রান্ত। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও বাউলগুরুদের পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি ক্রমে জটিলতর হচ্ছে,মুছে যাচ্ছে এই বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিসর।