হোটেল থেকে অমিতাভকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন পুজোয়! মস্তান ফাটাকেষ্ট আজও মিথ

Mastan Fatakeshto: ফাটাকেষ্ট যখন বড় হয়ে উঠছে তখন শিয়ালদা রেল ইয়ার্ড ছিল মস্তানদের ডেরা। বড়,ছোট, কুচে, গেঁড়ে নানা শ্রেণির মস্তান। এত মস্তান কেন? কীসের মধু?

বিড়ি বাঁধা কেষ্টকে কারও মনে নেই, ড্রাইভার কেষ্টও হারিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে কিন্তু সময়ের সীমানা পেরিয়ে কেষ্ট দত্তকে মনে রেখেছে মানুষ। অথচ কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিট লাগোয়া সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে কেষ্ট বলতে তিনজন কেষ্টকেই জানত পাড়া পড়শিরা। তবে স্বগুণে অমর হয়ে গেছেন কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে কেষ্ট দত্ত ওরফে ফাটাকেষ্ট। ফাটাকেষ্টই কলকাতার সেই মস্তান যিনি জীবদ্দশাতেই সেলিব্রিটি। অথচ তাঁর চেয়ে বহুগুণ খতরনাক মস্তান বৃহত্তর কলকাতায় অনেক ছিল- মস্তানির বিচারে যারা উচ্চকোটির, দুষ্কর্মের বিচারে অসামান্য নিপুণ, ডাকাতি-খুন-গুমখুন-বোমা-বন্দুকের সম্ভারে যাদের নেটওয়ার্কের হদিশ পেতে হিমশিম খেত পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু নামগুণে তারা কেউ ফাটাকেষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। তিনি ওয়ান অ্যান্ড ওনলি কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ফাটাকেষ্ট দ্য গ্রেট!

কিন্তু এই নাম প্রচারে এল কীভাবে? এই নাম প্রচার আদৌ কি মস্তানির শিরোপা না কি তাঁর মিথ হয়ে যাওয়া কালীপুজোর মাহাত্ম্যগুণে? না কি দুটোই? আসুন, প্রবেশ করি সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের এঁকেবেঁকে যাওয়া প্রাচীন গলিগুলোতে। একটু এগিয়ে আসুন, প্যাঁচালো গলিগালা পেরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গা দেখতে পেলেন? এটাই নরেন সেন স্কোয়ার। পাশেই ৬২ নম্বর বস্তিতে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা কেষ্ট দত্তের। নিম্নবিত্ত, বেআব্রু পরিবারে জন্ম হলে যে লড়াই করে টিকে থাকার মরিয়া প্রয়াস চালাতে হয় কেষ্টও তাই করেছে। পাড়ার লড়াইয়ে ভিড়ে গেছে। ইঁট, চ্যালা কাঠ, চেইন, চাকু হাতে তুলে নিয়েছে কৈশোরেই। বাতাসে একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য মাটির তলা থেকে যাত্রা শুরু করলে শহরের তলপেট যেভাবে নবীন কিশোরকে টেনে নেয়, ফাটাকেষ্টর জীবনও তাই। পাড়ায় পাড়ায় মস্তান। উঁচুবাড়ির পাশে নিচু বস্তি। অর্থনৈতিক সামাজিক অসাম্যে কেষ্ট দত্তও জড়িয়ে পড়ল পাড়ার মারপিটে। ততদিনে গুটি বসন্তের দাগ মুখে জেগে উঠেছে কিন্তু ফাটাকেষ্ট নাম তখনও হয়নি। সেটা হলো একটা বিধ্বংসী মারপিটের পর।

পাড়ার অদূরেই নকুল বলে এক যুবক ছিল। কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ব্যবসা তার। এলাকায় নকলে নামেই পরিচিত ছিল নকুল। ষাটের দশকের কথা। কী একটা বিষয় নিয়ে নকলে আর কেষ্টর ব্যাপক ঝগড়া বাঁধে। তখন যেমন হতো আর কী! ছোটখাট বিবাদ নিয়েই পাড়ায় পাড়ায় টেনশন শুরু হয়ে যেত। এক্ষেত্রেও তাই হলো। সবাই ভাবল ঝামেলা মিটে যাবে কিন্তু নকলে পণ করে নিল, এর শেষ দেখে ছাড়বে। নকলে করল কী, বরাহনগর থেকে বেশ কিছু মস্তান টাইপ যুবক নিয়ে হামলার ছক করল। কেষ্ট নিজের পাড়াতেই তখন। কথা নেই, বার্তা নেই ছুরি-চাকু নিয়ে কেষ্টর উপর হামলা করল নকলের ভাড়াটে বাহিনী। অতর্কিতে। প্রস্তুত ছিল না কেষ্ট। খালি হাতেই প্রতিরোধ করতে শুরু করল। প্রতিপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপর। ক্ষুর চালাচ্ছে ওরা। রক্ত ঝরছে কেষ্টর গা বেয়ে। এবার একটা বেঞ্চ তুলে নিল ফাটা। একটা বেঞ্চকে ঘোরাতে লাগল যেন লাঠি ঘোরাচ্ছে, এমনই গতি। ছোটখাট চেহারা কেষ্টর কিন্তু মুগুর ভাঁজা দেহ! প্রতিদিন গরম দুধে একটা ডিম ফেটিয়ে খায়। এই ওর রোজের রুটিন। সেদিন আস্ত একটা কাঠের বেঞ্চকে বনবন করে যেভাবে ঘোরালো তাতে ছত্রখান হয়ে গেল প্রতিপক্ষ। ততক্ষণে কেষ্টর অনুগামীরাও আসতে শুরু করেছে। পিছু হটল নকলে বাহিনী। লড়াই শেষে বেঞ্চটা একপাশে রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল কেষ্ট। সারা শরীর ছুরির ঘায়ে ফেটে গেছে। সেই থেকে এলাকার লোকের কাছে কেষ্ট দত্ত হয়ে গেল ফাটাকেষ্ট।

ফাটাকেষ্টর ক্লাব

আরও পড়ুন- এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে

ফাটাকেষ্ট যখন বড় হয়ে উঠছে তখন শিয়ালদা রেল ইয়ার্ড ছিল মস্তানদের ডেরা। বড়,ছোট, কুচে, গেঁড়ে নানা শ্রেণির মস্তান। এত মস্তান কেন? কীসের মধু? লোহার ছাঁটের মধুতে জড়ো হতো মস্তানরা। এই লোহার স্ক্র্যাপ নিলাম হতো। নিলামের ভাগ শীর্ষ রেলকর্তা পর্যন্ত পৌঁছত। ফাটাকেষ্ট ভিড়ে গেল এই নিলামের কাজে। এই একই কাজ তখন শিয়ালদা অঞ্চলের আরও বহু যুবক করত। পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নামী রাজনীতিকও হন কিন্তু সেই সময়টা জুড়ে রাউডি ছেলেদের আখড়া ছিল ওই রেল ইয়ার্ডের নিলামের আসর। এসব করেই দিন কাটছিল ফাটাকেষ্টর। পাড়ায় তাঁর কিছু অনুগামী ছেলেপুলেও জুটছিল। নরেন সেন স্কোয়ারের পাশে এই সময়ই প্রথম কালীপুজো শুরু করে ফাটা। ছোট পুজো, ক্লাবের নামটিও সম্ভবত নব যুবক সংঘ ছিল না। ওখানেই কলকাতার কালীপুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ফাটাকেষ্টর মাতৃ আরাধনায় হাতেখড়ি। এই পর্যায়ে কলকাতার মস্তানদের ক্যাপ্টেন ভানু বোসের সান্নিধ্যে আসে ফাটাকেষ্ট। গুরু গোপাল পাঁঠাকে অসীম শ্রদ্ধা করত ফাটাকেষ্ট। তবে মস্তানিতে ভানু বোসের উচ্চতা কোনওদিনই অর্জন করতে পারেনি ফাটাকেষ্ট, কখনও না। কিন্তু নাম ছিল। ওই বয়স থেকেই লোকে জানত, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে ফাটা কেষ্টর ডেরা।

মধ্য কলকাতার এই চত্বরের গোলমালের মূল ধরতে গেলে ফাটাকেষ্ট-সোমেন মিত্র অন্তর্দ্বন্দ্বকে বুঝতে হবে। সোমেন মিত্র নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান। সাইকোলজি নিয়ে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পড়াশোনা করেছেন। প্রিয় দাসমুন্সির সান্নিধ্যে প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেস করেছেন। সব থেকে বড় কথা শিয়ালদা বিধানসভা কেন্দ্রে সোমেন মিত্রকে টিকিট দিয়ে প্রিয়রঞ্জন একটা কাজ অবশ্যই করেছিলেন, সোমেন মিত্রকে একটা উচ্চতায় তুলে ধরেছিলেন তিনি। জিতে নিজের ক্ষমতারও প্রমাণ দিয়েছিলেন সোমেন মিত্র। ফাটাকেষ্টর সেই প্রতিভা আদৌ ছিল কিনা, নিজেকে প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ সে পেয়েছিল কিনা- আজ বিতর্কের বিষয় । কিন্তু এই পর্ব জুড়ে কংগ্রেস নেতা ও কলকাতার বহু মস্তানদের মেন্টর শত ঘোষের সান্নিধ্য পায় ফাটাকেষ্ট এবং নকশাল আন্দোলন রুখতে সক্রিয়, সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অবশ্যই রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মদতে।

বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তেই কলেজ স্ট্রিট হয়ে উঠল নকশালদের মুক্তাঞ্চল। মিছিল-মিটিং-পিকেটিংয়ে লালে লাল কলেজ স্ট্রিট। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেন ভেঙে পড়ে পড়ে। সেই সময় নকশাল প্রতিরোধে যে সব বাহুবলীদের নাম সামনের সারিতে আসে ফাটাকেষ্ট তাদের অন্যতম। কলেজ স্ট্রিটের বিপ্লবের ঢেউ প্রথম আছড়ে পড়ত যে সব এলাকায় সেই কেশব সেন স্ট্রিট, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে পাল্টা প্রতিরোধ করত ফাটাকেষ্ট। এই সময় নকশালদের হিট লিস্টে ফাটার নাম। এই সময়েই নরেন সেন স্কোয়ারে ঘটেছিল সেই বিখ্যাত ঘটনা।

তখন নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। বাড়ির পাশের নরেন সেন স্কোয়ারে গায়ে তেল মেখে রোদ পোহাচ্ছে ফাটাকেষ্ট। রোদে পিঠ দিয়ে বসেছিল। বুঝতে পারেনি পেছন থেকে আক্রমণের জন্য পজিশন নিচ্ছে নকশাল বাহিনী। হঠাৎই ফাটাকেষ্টর পিঠ লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ল ওরা কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড! বোমা গায়ে লেগে পাশে পড়ে গেল। ফাটল না। চমকে উঠে ফাটা দেখল, বোমা পড়ে আছে। বোমা তুলে নিয়ে মারল নকশালী যুবকদের লক্ষ্য করে এবং এবার বোমাটা বিকট আওয়াজ করে ফেটে উঠল। দৌড়ে পালাল নকশালীরা। নকশালপন্থীদের আক্রমণ করতে প্রচুর অস্ত্র মজুদ করেছিল ফাটা। তার নবযুবক সমিতির একটি গোপন কক্ষে এই অস্ত্র ও বোমা রাখা থাকত। নব যুবক সমিতির নাম সত্তরের দশকেই ফেটে পড়ে। ফাটার কালীপুজোও বড় হয় এই সময়টা জুড়েই। নরেন সেন স্কোয়ারের কালীপুজো ছেড়ে বেরিয়ে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের এক গলিতে মাচা বেঁধে কালীপুজো করে ফাটাকেষ্ট। তারপরই কেশব সেন স্ট্রিট লাগোয়া এই বড় আয়োজন। মস্তান হিসেবে ফাটাকেষ্টর নাম যত বেড়েছে ততই বড় হয়ে উঠেছে তার কালীপুজোও।

এখানেই ফাটাকেষ্টকে বোমা মারে

আরও পড়ুন- ‘চাকরি দিলাম, মা-কে খাওয়াবি’! জ্যোতি বসুকেও থামিয়ে দিতেন মস্তান-মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি

ততদিনে নবযুবক সমিতির ব্যায়ামাগার কংগ্রেসপন্থী নবীন যুবকদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। এমনকী নকশাল আধিপত্যে ঘরছাড়া বহু কংগ্রেসীদের আশ্রয় দিচ্ছে ফাটাকেষ্ট। এই সময়টা জুড়ে ফাটার উপর আক্রমণও হচ্ছে মুহুর্মুহু। ফাটার অস্ত্রের অভাব ছিল না। বোমা, পিস্তল, সোডার বোতল, চাকু-ভোজালি, হকি স্টিক সব ছিল। কিন্তু তারপরেও জনশ্রুতি, ফাটাকেষ্টর হাতে অস্ত্র দিয়ে যেত স্বয়ং পুলিশ! সকালে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে রাতে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। সারাদিনের অপারেশন পুলিশের অস্ত্রেই করত ফাটাকেষ্ট। এই তথ্য প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করবে না। তবে বহু প্রবীণ মানুষ একথা জানেন। হয়তো কোনও কোনও দিন কোনও বিশেষ অপারেশনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটত—এমনও হতে পারে। এই তথ্য প্রমাণ করে, নব কংগ্রেসি মস্তানদের সঙ্গে শুধু কংগ্রেস সংগঠন না, প্রশাসনের কত নিবিড় যোগ ছিল।পাশের পাড়ার সমবয়সি সোমেন মিত্র বিধায়ক হতেই ফাটাকেষ্টর হতাশা বেড়ে গেল কি? সোমেন মিত্রের সঙ্গে রাজনীতিতে না পেরে লড়াই কি রূপ নিল কালীপূজা ঘিরে? একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

বাহাত্তর সালে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। তখন নকশাল আন্দোলনের রেশ অনেকটা কমলেও, মুছে যায়নি। ছাত্র, যুব, কংগ্রেসি মস্তান সবাই পুরস্কৃত হচ্ছিল। কেউ বিধায়ক, কেউ মন্ত্রী। ফাটাকেষ্টকে চাকরি দিলেন সিদ্ধার্থ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী কাশীকান্ত মৈত্র । সরকারি চাকরি। রিজার্ভ ড্রাইভার। ফাটাকেষ্টর একটা জিপ ছিল। ড্রাইভিংয়ের হাতও ছিল দারুণ। সেই সুবাদে সরকারি কাজ জুটল। মিল্ক কলোনির ডিপোয় হাজিরা দিতে যেতে হতো ফাটাকে, গাড়ি চেপে। ড্রাইভার চালাত গাড়ি। এই বিষয়টা জেনে গেল নকশালপন্থী যুবকদের একটা দল। ডিপোর গেটে হাতের নাগালে পেতেই ফাটার জিপে বোম মারল তারা। ফাটাকেষ্টর ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই মারা যান আর হাতে গুরুতর জখম নিয়ে কোনওক্রমে পালিয়ে বাঁচে ফাটাকেষ্ট।

নকশালপন্থীরা সেই সময় স্লোগান তুলল,"ফাটাকেষ্টর মুন্ডু চাই"। ফাটাবাহিনীও তখন প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। পটলডাঙা, বৈঠকখানা, সূর্যসেন স্ট্রিটের রাস্তা যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল। বোমা-বন্দুকের লড়াইয়ে সরগরম। এই লড়াইয়ে বহু নকশালপন্থী যেমন মারা গেল, ক্ষতি হলো ফাটাকেষ্ট বাহিনীরও। অশোক আর চিত্তরঞ্জন নামে ফাটাকেষ্টর বাহিনীর দুই সদস্য মারা যায় নকশাল আক্রমণে। পটলডাঙা আর বৈঠক খানায় এদের দু'জনকে খুন করেছিল নকশালরা। এই ঘটনার পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এক-দেড়শো ছেলে নিয়ে অ্যাকশনে নামল ফাটাকেষ্ট। ফাটাকেষ্টর অ্যাকশনে যাওয়ার একটা স্টাইল ছিল। সবার আগে বোম চার্জ করতে করতে এগিয়ে যেত। প্রতিপক্ষ যখন ওকে স্পট করছে, ঠিক তখনই পজিশন নিয়ে নিত ওর বাহিনী। কোনো একটা জায়গা থেকে পিছু হটার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করত ফাটাকেষ্ট। অ্যাকশনের সামনে গোটা বাহিনীকে কভার করে দাঁড়াত।

যাইহোক, সোমেন মিত্রের সঙ্গে রাজনীতিতে এঁটে উঠতে না পেরে কালীপুজো নিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সোমেনের আমহার্ট স্ট্রিট বনাম ফাটাকেষ্টর কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিট—এমনটাই গুঞ্জন। আর ফাটার কালীপুজোর শ্রীবৃদ্ধিও এই সময়টায়। এই সময়েই, ১৯৭২ সালে উত্তম কুমারের সঙ্গে ফাটাকেষ্টর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কালীপুজোয় নিয়মিত অতিথি হন উত্তম। এই সময়ে আরও একটা ঘটনা ঘটে যা ফাটাকেষ্টর কালীপুজোকে মিথে রূপান্তরিত করে। 'দো আনজানে' সিনেমার শ্যুটিং করতে কলকাতা এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। উঠেছিলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। শ্যুটিং শুরু হওয়ার কথা, সাড়ে বারোটার মধ্যে স্পটে চলে আসবেন বচ্চন এমনটাই কথা রয়েছে কিন্তু অমিতাভ এলেন দুপুর দুটোয়! কী ব্যাপার? এরকম তো করেন না মিস্টার পারফেকশনিস্ট। হলো কী? পরে জানা গেল, গ্র্যান্ড হোটেল থেকে অমিতাভকে সেদিন কালীপুজোর আসরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ফাটাকেষ্ট। নব যুবক সংঘের কালীমূর্তি দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন সুপারস্টার। তবে একটা কথা তো সত্যি, অমিতাভ না চাইলে তাঁকে নিশ্চয়ই কেউ তুলে আনতে পারত না। শ্যুটিং শুরু হবে, তার আগে কালীপুজোয় আসার অনুরোধ কি অমিতাভ বচ্চনকে কেউ করেছিলেন? মনে রাখতে হবে, অজিত পাঁজা তখন কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী। আর উত্তর কলকাতার ঘরোয়া রাজনীতির সমীকরণে ফাটাকেষ্ট তাঁর খাস লোক। যাইহোক, অমিতাভ বচ্চনকে এনে শহরের সব কালীপুজোকে মাত দিয়েছিল ফাটা কেষ্ট।

আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?

ফাটাকেষ্ট প্রথম কালীপুজো শুরু করে গলির ভেতরে

সোমেন মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের রেষারেষি থেকেই সুব্রত মুখার্জির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ফাটাকেষ্ট। তবে রাজনীতি, মস্তানি কোনও কিছুই ফাটাকেষ্টকে অমর করেনি। অমর করেছে তার কালীপুজো, যা বারোয়ারি হয়েও মাহাত্ম্য অর্জন করেছে। জাগ্রত মন্দিরের মতোই এই মণ্ডপে মানত করে যান হাজার হাজার মানুষ। মনস্কামনা পূর্ণ হলে সোনা দিয়ে পুজো দিয়ে যান কালীর। ব্যাঙ্কে তিন-তিনটে ভল্ট ভাড়া করে কালীর সোনার গয়না রাখতে হয় আজও পুজোকমিটিকে। আজও শাড়ি পড়ে কয়েক হাজার, আর আছে মালা! ফাটাকেষ্টর সময় থেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুলের মালা, ফলের মালা আসে মাতৃমূর্তিতে পরিয়ে দেওয়ার জন্য। মূল পুজো শুরুর আগে দু'ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রায় হাজার দেড়েক মালা পরানো হয় কালীকে। এখনও এই নিয়মই চলে আসছে।

ফাটাকেষ্টর কালীপুজোয় শুধু বাংলা-বোম্বের সেলিব্রিটিরা আসতেন না। মহাযোগী, সাধুরাও আসতেন। একবার ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথকে তাঁর আশ্রম থেকে কাঁধে চাপাল ফাটাকেষ্ট। বাবা বড় যোগী। কাশীধাম থেকে এসেছেন। ঠাকুরকে মাতৃমূর্তি দর্শন করাতে একেবারে কাঁধে চাপিয়ে নিল ফাটাকেষ্ট। এরপর শুরু হলো দৌড়। বিটি রোড ধরে ছুটছে ফাটাকেষ্ট, কাঁধে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ। ছুটতে ছুটতে ফাটাকেষ্ট এসে থামল কেশব সেন স্ট্রিটের পুজো মণ্ডপে। কাঁধ থেকে নামাল সীতারামদাস ওঙ্করনাথকে। চতুর্দিকে ঢাক বেজে উঠল। সর্বজনীন বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপ পবিত্র হয়ে উঠল সীতারামদাসজির আগমনে।

ফাটাকেষ্টর এই ছুট আজও মিথ হয়ে আছে। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে নার্সিং হোম পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলেন না। লুটিয়ে পড়লেন রাস্তায়। ১৯৯২ সাল, শনিবার। আগের দিনও ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কালীপুজো নিয়ে। পরের দিন সকালে বাড়িতেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক! ১৪৩০ ডব্লু এমবি গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ছুটল ল্যান্সডাউনের এক বেসরকারি নার্সিংহোমের দিকে। জীবনের কী করুণ পরিহাস। নার্সিংহোমের কাছে গিয়ে হঠাৎই ব্রেকডাউন হয়ে গেল গাড়ির। প্রতিদিন ঠিক চলে সেদিন হঠাৎ কী হলো কে জানে! বুকে হাত চেপে নিজেই গাড়ি থেকে নামলেন ফাটাকেষ্ট। চলতে পারছেন না। ওই... ওই তো নার্সিংহোমের দরজা কিন্তু পা চলছে না ফাটাকেষ্টর। এই দুই পায়ে মাইল-মাইল ছুটে বেরিয়েছেন মধ্য কলকাতার ডন। আজ সেই দৌড়ের পরিসমাপ্তি । নার্সিংহোমের কাছেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন ফাটাকেষ্ট। শেষ হলো এক বর্ণময় জীবন।

More Articles