বাড়ি ভাঙা সত্যিই বাম-আমলের দায়? কীভাবে কলোনি গড়ে উঠেছিল কলকাতায়?
Baghajatin Colony: ১৯৫০-এর পর কলোনি গড়ে উঠতে শুরু করে কলকাতা শহরতলিতে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা এপার বাংলায় এসে প্রথমে নিজের নিজের মতো করে জায়গা বেছে জবরদখল করে বসবাস শুরু করেন।
কলকাতায় রোজই কত শত ইতিহাসের জন্ম হয়। সময়ে-অসময়ে সব বদলে গেলেও ইতিহাস ঠিকই থেকে যায়। তাই আজও প্রাসঙ্গিক থেকে যায় কলকাতা শহর গড়ে ওঠার গল্প, কলকাতার শহরতলিতে কলোনি এলাকা গড়ে ওঠার কাহিনি। গত ১৪ জানুয়ারি বাঘাযতীনে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি ভেঙে পড়ার পর থেকেই কলোনি এলাকা আলোচনার বিষয়। কারণ ঘটনার পরদিনই কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘বাম আমলের পাপ বহন করছি আমরা। সেই সময়ে কলকাতার কলোনি এলাকায় কোনও বাড়ির প্ল্যানিং থাকত না। বেআইনিভাবে সব বাড়ি তৈরি করা হতো।” ৯৯ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও জানান, বাম আমলে পুকুর ও জলাজমি ভরাট করে একের পর এক বাড়ি তৈরি হয়েছে।
সত্যিই কি তাই? কীভাবে গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরতলিতে কলোনি এলাকাগুলি। বাম আমলেই কি এর শুরু? কলোনি গড়ে ওঠার ইতিহাস আরও পুরোনো। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার অনেক আগের। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর নিপীড়িত ও অত্যাচারিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন, মূলত সেই সমস্ত উদ্বাস্তুরাই সরকারি বা ফাঁকা পড়ে থাকা ব্যক্তিগত মালিকানার জমি জবরদখল করে গড়ে তুলেছিলেন একের পর এক কলোনি। রেল লাইনের ধারেও গড়ে ওঠে বস্তি।
প্রথম উদ্বাস্তু কলোনি তৈরি ১৯৪৮ সালে। কলকাতার দক্ষিণে যাদবপুরের বিজয়গড়ে একটি পরিত্যক্ত মিলিটারি ব্যারাকে এটি তৈরি হয়। ১৯৫০ সালের শেষ নাগাদ শহরে এবং আশেপাশে ১৪৯টি কলোনি ছিল। পরবর্তী ২০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে আরও ১৭৫টি কলোনি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন- কোটি টাকার ফ্ল্যাট, রাস্তায় ভর্তি বেকার! কলোনির জীবন যেমন
১৯৫১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় ৪,৩৩,০০০ বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু এসেছিলেন এবং তাঁদের সংখ্যা বছরের পর বছর বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে আসা উদ্বাস্তুরা বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবিত্ত। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত এবং কলকাতা শহরে তাদের যোগাযোগ ছিল। তবে ১৯৫০ সালের পর প্রচুর সংখ্যায় দরিদ্র শ্রেণির উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করেন।
সম্প্রতি ভেঙে পড়া বাড়িটি কলকাতা পৌরসভার ৯৯ ওয়ার্ডের বিদ্যাসাগর কলোনিতে অবস্থিত। ওই বাড়ির বর্তমান মালিক অভিষেক সরকারের সঙ্গে কথোপকথনে জানতে পারি, জলাজমি ভরাট করে নয়, পাকাবাড়ি প্রোমোটিং করানো হয়েছিল। তবে, তার আগে জলাজমি থাকতে পারে। সেটা তিনি দেখেননি। অভিষেক সরকারের জন্ম ১৯৮৪ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে। সেইসময় কলকাতা শহরতলিতে যে যেমন পেরেছিলেন বেড়ার বাড়ি বা কুঁড়েঘর করে কোনওরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছিলেন। যদিও তাঁরা প্রথমে গড়িয়াতে ছিলেন, পরে বাঘাযতীনে আসেন বলে জানা গেছে।
বিদ্যাসাগর কলোনিতে কবে থেকে প্রোমোটিং শুরু হলো? তার আগে জানতে হবে বিদ্যাসাগর কলোনি কীভাবে গড়ে উঠল? বিদ্যাসাগর কলোনির কিছু বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে কলোনি গড়ে ওঠার ইতিহাস জানার চেষ্টা করি। বাসিন্দারা বলেন, “১৯৫০-এর পর কলোনি গড়ে উঠতে শুরু করে কলকাতা শহরতলিতে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা এপার বাংলায় এসে প্রথমে নিজের নিজের মতো করে জায়গা বেছে জবরদখল করে বসবাস শুরু করেন। তারপর ৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পাট্টা দেওয়া হয়। ৯৯ বছরের জন্য জমি লিজ দেওয়া হয়। দলিলপত্রও বানিয়ে দেওয়া হয়। তবে শর্ত হলো, জমি ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু বিক্রি করতে পারবে না।”
কলোনিতে ঘুরতে ঘুরতে এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা। নাম ঢলু মজুমদার। বয়স ৮৭ বছর। ১৯৩৮ সালে জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ১৯৫০ সালে এপার বাংলায় চলে আসেন, দেশভাগের পর। প্রথমে কালীঘাটে ৫৪ নং রাসবিহারী রোডে গুরুদ্বারার বিপরীতে থাকতেন। তখন ১০-১২ টাকা বাড়ি ভাড়া। পরে ভবানীপুর, চেতলা, পোদ্দার নগর, যাদবপুর বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন অর্থাৎ বাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে নানা কারণে। তবে জীবনের বেশি সময়, সংসার থেকে সন্তানপালন সবটাই টালিগঞ্জের চারু মার্কেটে (৫০ বছর থেকেছেন)। এখন বার্ধক্যের কারণে মেয়ের কাছে থাকছেন বিদ্যাসাগর কলোনিতে। তিনিই জানালেন, প্রথমে উদ্বাস্তুরা এসে শহরতলির এইসব জলাজমি এলাকা দখল করলেও পরে এপার বাংলারই বিভিন্ন গ্রাম্য এলাকা থেকে মানুষ এসে এইসব জমি দখল করতে থাকেন নিজের আত্মীয়দের থেকে খবর পেয়ে। কারণ দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে শহরের কাছে এইসব জলাজমি বিনামূল্যে পেয়ে যাওয়া মানে হাতে একপ্রকার চাঁদ পাওয়া।
তপন দাসের জন্ম এপার বাংলায়। বিদ্যাসাগর কলোনির বাসিন্দা। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে সবে। স্মৃতিচারণ করে বললেন, "বাবারা এসেছিল পূর্ববঙ্গ থেকে। এপার বাংলায় স্থায়ী থাকার জায়গা হচ্ছিল না। সেই সময় কংগ্রেস আমলে পুলিশ বারবার এসে তুলে দিত।" সবই বাবার কাছে শোনা কথা তাঁর।
সত্তরোর্ধ্ব তমাল সেন, বুকে পেসমেকার বসানো। নিজের থেকেই বললেন, তাঁর স্মৃতি এখন ঝাপসা। যতদূর মনে পড়ে তাঁর, ১৯৫২ সালে এসেছেন এপার বাংলায়। বেড়ার বাড়ি বানিয়ে কোনওরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই বানানো হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কলোনির তখন কোথাও অংশ উঁচু, কোথাও জলাজমি। কিছু কিছু জমিতে চাষ হতো আবার কোথাও কোথাও জঙ্গল। রাস্তা ছিল না কোনও। জল পেরিয়ে স্কুল-কলেজে গিয়েছেন। বৃষ্টি হলেই হাঁটু জল জমে যেত।
কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল মূলত দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জমি জবরদখলের মাধ্যমে। এমনটাই জানান প্রিয়গোপাল গোস্বামী। বয়স ৬৪ বছর। জন্ম এখানেই। বাবার নাম পবিত্র গোপাল গোস্বামী। ৪৭-এর দেশভাগের পর তাঁর বাবারা এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। জবরদখলে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন পবিত্র গোপাল গোস্বামী। যে কারণে পুলিশের হাতে অ্যারেস্টও হয়েছিলেন। বাবা পালিয়ে বেড়াতেন, জানান প্রিয়গোপাল গোস্বামী।
বিদ্যাসাগর কলোনিতে ২৬ বছর বাস করছেন তপতী দাস। বয়স এখন ৫০ বছর। শ্বশুরমশাই একতলা পাকাবাড়ি বানিয়েছিলেন। তার উপরে আর একতলা বানিয়েছেন তাঁরা। প্রোমোটিং করানোর অফার এলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানান। কলোনি এলাকায় প্রোমোটিংয়ের শুরু কবে? তপতী দাসের কথায়, ১৯৯৮ সালের দিক থেকে প্রোমোটিং শুরু টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ এলাকায়। তখন ছেলেকে টিউশন পড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখতেন উঁচু বহুতল উঠছে। তখন যদিও এত রমরমা ছিল না। ২০১০ সালের পর থেকেই প্রোমোটিং বেশি বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন- প্রায় ৭০ বছর পরিচয়হীন! কলকাতার বুকে একখণ্ড বার্মা কলোনিতে যেভাবে বাঁচেন উদ্বাস্তুরা
বিদ্যাসাগর কলোনিতে প্রোমোটিং শুরু ২০ বছর আগে। বেড়েছে ২০১০ সালের পর। দশটার মধ্যে ৪টি ফ্ল্যাটবাড়ি। যদিও এই ঘটনা সারা কলকাতা জুড়ে। অনেকটা হতাশার সুরেই বললেন বছর ৫৩-র অপুকুমার দাস। বাসিন্দাদের অনেকেরই দাবি, এখন আইন মেনে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে না।
বিদ্যাসাগর কলোনির আর এক বাসিন্দা দেবাশীষ সরকার। বয়স ৫৪ বছর। তাঁর পূর্বপুরুষরা দেশভাগের আগেই এসেছিলেন। দেবাশীষের বাবার নাম উপেন সরকার। ওয়েস্ট বেঙ্গল গর্ভমেন্ট প্রেসে চাকরি করতেন। আগে যার নাম ছিল ব্রিটিশ প্রেস। ৩৩ বছর চাকরি করেছেন। প্রথমে চেতলাতে থাকতেন। আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। ১৯৪৬ সালে চাকরির জন্য এসেছিলেন। বাবার কাছে দেবাশীষ শুনেছেন কীভাবে গড়ে উঠেছিল কলোনি এলাকাগুলি। তাঁর কথায়, “তখন বিদ্যাসাগর কলোনি জলাজমি ছাড়া কিছুই না। কিছু ছিল চাষাবাদের জমি। শন গাছ তুলে দিলেও আবার গজিয়ে যেত। ৭৭-এর পর যখন বামফ্রন্ট এল, আমরা তখন দেখেছি মন্ত্রী প্রশান্ত শূর আসতেন। তাঁকে হ্যাজাক দিয়ে রাস্তা দেখানো হয়েছে।” ইলেকট্রিক থেকে রাস্তা-ঘাট সবই বাম আমলে তৈরি বলে জানান তিনি।
এছাড়া কলোনি পরিচালনা করতে ভোটাভুটির মাধ্যমে তৈরি হতো কমিটি। মোটামুটি ওই ৫৫ সালের পর থেকে এর শুরু। আসলে কে কোন জমিটা নেবে এই নিয়ে নিজেদের মধ্যেই ঝামেলা শুরু হতে থাকে তখন। ফলে কলোনি পরিচালনার জন্য কমিটি তৈরি করা হয়। শেষবার ভোট হয়েছিল ২০১৩ সালে। মূলত কমিটিতে আগে বামেদের লোকজনই থাকতেন বলে জানান দেবাশীষ সরকার। কিন্তু শেষ ভোটে বামেরা শূন্য হয়ে যায়। তৃণমূল ভোট লুট করে জিতেছে বলে দাবি তাঁর। আর তারপর থেকে কলোনির ভোটই বন্ধ হয়ে গেছে।
কলোনি এলাকায় এক-দুইতলা বাড়ি ভেঙে ক্রমেই আকাশ ফুঁড়ে উঠছে ফ্ল্যাটবাড়ি। নিয়ম মেনে হচ্ছে তো? ব্যবসায়ীর মুনাফা, রাজনৈতিক চাপ, কাটমানির চক্করে নিরীহ মানুষদের জীবন, মধ্যবিত্তের মাথার উপর পাকা ছাদের স্বপ্ন নিয়ে খেলা হচ্ছে না তো? প্রশ্ন উঠেছে কারণ ৯৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভেঙে পড়া ফ্ল্যাটবাড়ি বাম আমলে তৈরি বলে দায় সেরে ফেলতে চাইলেন মেয়র।