বইমেলা নিয়ে কোনও আগ্রহই নেই ফরাসিদের
Book Fair 2025: কলকাতায় পুরনো বই বা সস্তায় সারা বছর বই পাওয়ার একমাত্র উপায় হয়তো কলেজ স্ট্রিট। অর্থাৎ এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে শহরকেন্দ্রিক।
শীতকালের কলকাতা বইমেলার কলকাতা। বড়দের সঙ্গে প্রথমবার মেলা দেখতে যাওয়ার দিন ভারি কৌতূহল ছিল— রথের মেলার মতো বইমেলাটা আবার কী জিনিস? মেলায় ঢুকে দেখি এ কী! এত্ত বই হয়? আমাদের বাড়িতে অনেক বই জানি, লাইব্রেরিতে আরও বেশি বই থাকে কিন্তু খোলা মাঠের মধ্যে এত বই! সে ছিল অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের সময় যা কেবল শৈশবেই সম্ভব।
বইমেলার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আমাদের সাবালক হওয়া। কলেজ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথমবার বইমেলা গিয়ে মনে হলো, এই তো স্বাধীন জীবন শুরু। প্রতিদিন ক্লাস কেটে বইমেলা যাচ্ছি দল বেঁধে। মাঠে বসে গান হচ্ছে। বইয়ের প্রচ্ছদে পড়া লেখক-লেখিকাদের নামগুলি ঘোষণা হচ্ছে। সাধারণত ধরাছোঁয়ার বাইরের মানুষরা আমাদেরই মতো মেলা ঘুরছেন, কথা বলছেন, সই দিচ্ছেন! এসব কৈশোরের বিস্ময়! আমাদের বইমেলা ছিল ময়দানের মাঠে।
বইমেলার বয়স হয়েছে, আমাদেরও। নানা মাঠ ঘুরে বইমেলা ঠাঁই নিয়েছে করুণাময়ীর পাড়ায়। কালে-কালে আমাদের অনেকের প্রথম বই বেরিয়েছে মেলায়। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে আড্ডা মারার মতো আমরা নানা প্রান্ত থেকে রোজ গিয়ে মেলার মাঠে ঘুরেছি, গল্প-তর্কে মেতেছি। কলকাতার বইমেলা কেবল কলকাতাবাসীর নয়, বাঙালি পরিচয়ের সমার্থক হয়ে উঠেছে। বই নয়, মেলা নয়, ব্যবসা নয়, বইমেলাই মূল বাঙালি আবেগ।
আরও পড়ুন-জামার তলায় চুরি করা রুশদি! বইমেলায় ক্রমেই ফিকে হচ্ছে বইপাগলরা
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অ-বাণিজ্যিক বইমেলা, এশিয়ার বৃহত্তম বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা এবং লন্ডন বইমেলার পরে, এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বার্ষিক বই সমাবেশ। ফুটফলের হিসেবে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় বইমেলা। ১৯৭২ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বইমেলার ধাঁচে কলকাতা প্রকাশক ও বই বিক্রেতা গিল্ড ১৯৭৬ সালে ছোট আকারে এই বইমেলার সূচনা করে। মেলার উদ্দেশ্য ছিল বইয়ের জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা আয়োজকদের মতে, কলকাতা বইমেলার জনপ্রিয়তার কারণেই ২০০৬ সালে ভারতকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অতিথি সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল।
দেশ বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গে বইমেলার গল্প করতে গিয়ে বুঝি, কলকাতা বইমেলা নিয়ে মাতামাতি আর আবেগ সকলকে বোঝানো সম্ভব নয়। ফ্রান্সে বইমেলা জাতীয় কিছু হয় কিনা খোঁজ করতে গিয়ে অন্তত ২৪টি ছোট-বড় মেলার নাম উঠে এল। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে বেশিরভাগই বলল, এরকম কোনও মেলার কথা ওরা শোনেনি। আমার বন্ধু পল বলল, প্যারিসের সালঁ দ্যু লিভ্র বই উৎসবের কথা। ও কখনও সেই মেলায় গেছে কিনা মনে করতে পারল না, এক-দু'বার গেছে হয়তো কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যে ওর জীবনে দাগ কাটেনি, তা বোঝা গেল। আমাদের কথোপকথন শুনে কাসন্দ্র পাশ থেকে বলে, বইয়ের অনেক মেলা মার্সেই, এক্স-অঁ-প্রোভাঁস, লিয়ঁ মিলিয়ে ফ্রান্সের অন্য শহরেও হয় বলে ও শুনেছে, কিন্তু কবে কোথায় কেন এই মেলা হয়, সেই বিষয়ে ওর ধারণা নেই, ও কখনও যায়নি। ওর কোনও বন্ধু বা পরিবারের কেউ এইসব মেলায় গেছে বলে ও মনে করে না।
প্যারিস বই উৎসবের মূল নাম ছিল সালঁ দ্যু লিভ্র। ১৯৮১ সালে সিন্দিকা ন্যাসিওনাল দে ল'এদিসিওঁ-র (SNE) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জঁ-পল জিসরো এবং ফ্রেডেরিক দিতিস-এর উদ্যোগে শুরু হয় মেলা। প্রথমবার ২৩ থেকে ২৭ মে মেলা হয় প্যারিসের গ্রঁ প্যালেই-এর গম্বুজের নীচে। তখন বইয়ের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে ফ্রান্সে কোনও আইন ছিল না। মেলার সময় ২০% ছাড় দেওয়া হতো। এর পরের বছরেই জ্যাক ল্যাং-এর "বইয়ের নির্দিষ্ট মূল্য আইন" চালুর মাধ্যমে এই ছাড় দেওয়ার প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৪ সালে গ্রঁ পালেই-এর গম্বুজ ছেড়ে পোর দ্য ভার্সাই- তে স্থানান্তরিত হয় প্যারিস বইমেলা। ২০১৬ সালে, মেলার নাম পরিবর্তন করে লিভ্র-পারি রাখা হয়। ২০২১ সালের জুন মাসের শুরুতে মেলা আবার ফিরে আসে গ্রঁ প্যালেই এফেমেয়-তে।
কলকাতা বইমেলার মতোই, প্যারিস বইমেলা হয় বসন্তকালে। ছোট-বড় ফরাসি প্রকাশক এবং বই শিল্পের প্রতিনিধিরা আসেন। প্রতিবছর থাকে আমন্ত্রিত একটি দেশ। ২০২২ সালে আমন্ত্রিত দেশ ছিল ভারত। এই বছর থেকেই প্যারিস বইমেলা রূপ বদল করে এক আর্বান উৎসব হয়ে ওঠে। লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়, চলে নানারকম কর্মশালা, শিল্পকলার প্রদর্শনী এবং কনসার্ট। চলচ্চিত্র শিল্প ও সংগীত জগতের নামজাদা ব্যক্তিত্বরা সামিল হন এই উৎসবে। অর্থাৎ, কলকাতা বইমেলার প্রাণকেন্দ্রে যে উৎসবের রেশ, তা প্যারিস বইমেলাকে ছুঁয়েছে হালে। যদিও বলা হয় এই উৎসবটি অক্ষরশ্রমিক এবং বইপ্রেমীদের মিলনস্থল, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, এই মেলা নিয়ে আমজনতার বিশেষ উৎসাহ নেই, কমবয়সিদের মধ্যে একেবারেই নেই। কলকাতার উল্টো ছবি প্যারিস বইমেলায়!
প্যারিস মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি প্রকাশনার বৈচিত্র্য প্রদর্শন। ১৯৮০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বইমেলার ঘোষণায় জঁ-পল জিসরো উল্লেখ করেন, "প্রকাশকদের সমস্ত সংগ্রহ উপস্থাপন করা" এবং কয়েকদিনের জন্য "বিশ্বের বৃহত্তম বইয়ের দোকান" চালু করা এই মেলার উদ্দেশ্য। সত্তরের ফরাসি প্রকাশনা জগতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন 'বই দিবস', 'বইমেলা' এবং 'বই উৎসব' দ্রুত বেড়ে ওঠে। ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন যে, ওই সময় প্রকাশনার সংখ্যা বাড়ছিল ঠিকই, তবে বইয়ের গড় মুদ্রণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। অর্থাৎ মুদ্রণশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্যারিস বইমেলার উদ্যোগ। এর আগে সরকারি উদ্যোগে বইয়ের দাম নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার ফলে বই বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো ছাড় দিতে শুরু করে। ফলে, বড় বই বিক্রেতারা সুবিধা পেলেও, ছোট বইয়ের দোকান এবং ছোট প্রকাশনাগুলি সমস্যায় পড়ে। এই সংকটের মধ্যেই ১৯৮১ সালের বইমেলার দরজা খোলা হয়। কয়েক মাস পরে, ১০ অগাস্ট সংসদে 'ল্যাং আইন' পাস করে বইয়ের দামে ইচ্ছেমতো ছাড় দেওয়া বন্ধ করা হয়। ৪০ বছর পেরিয়ে, বই মূল্যের আইন এবং দেশজুড়ে নানা বইমেলা সত্ত্বেও, ফরাসি প্রকাশনা এখনও সংকটে। বর্তমানে অতিরিক্ত বই প্রকাশের কারণে, অনলাইন বই কেনার রমরমা, বড় ডিজিটাল বিক্রেতাদের চক্রে ছোট বইয়ের দোকানগুলি চ্যালেঞ্জের মুখে।
আরও পড়ুন- পুজোয় তো শাড়িও বেস্ট সেলিং হয়…
রোমানদের সময় থেকে ফরাসি বইবাজারের জনপ্রিয়তা। রাজপথে ঘুরে ঘুরে বই ফেরি করা থেকে শুরু করে প্যারিস সেইন নদীর ধারে পুরনো বইয়ের দোকানগুলির ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হয়ে ওঠা এক ঐতিহাসিক জার্নি। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি অন্য জায়গায়। প্রতি পাড়ায় বইয়ের দোকানগুলি সরকারি ভাতা পায় ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য। সারা বছর ধরে চলে বইয়ের সাপ্তাহিক, এমনকী কোথাও কোথাও দৈনন্দিন বাজার। ফ্রান্সে পুরনো বইয়ের চাহিদা বেশি, এর কারণ হতে পারে নস্টালজিয়া জিইয়ে রাখার ইচ্ছা, পরিবেশ সচেতনতা বা অনেক কম দামে বই কেনার মতো সরল-জটিল নানা কারণ। কলকাতায় পুরনো বই বা সস্তায় সারা বছর বই পাওয়ার একমাত্র উপায় হয়তো কলেজ স্ট্রিট। অর্থাৎ এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে শহরকেন্দ্রিক। সারা বছর ডিসকাউন্টে বই কেনার উপায় আমাদের মফসসল বা গ্রামের বইপ্রেমীদের প্রায় নেই। সেখানে ফ্রান্সের গ্রামগঞ্জ বড়-ছোট শহর- সর্বত্র সস্তায় বই কেনার উপায়, পার্ক বা খোলা আকাশের নীচে ছড়িয়ে রাখা বইয়ের পাহাড় থেকে পছন্দের বই বেছে নেওয়ার রোমাঞ্চ সকলের দোরগোড়ায়। হয়তো এই কারণেই বাৎসরিক আনুষ্ঠানিক বইমেলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ নেই ফরাসি পাঠকদের।
এত কিছু সত্ত্বেও বইপড়া কমে গেছে, ছাপা বইয়ের ব্যবসা উঠে যাবে— এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই হা-হুতাশ শোনা যায় ফ্রান্সে। সরকার থেকে আইন করে বইবাজার বাঁচিয়ে রাখার নতুন নতুন উপায় বের করার চেষ্টা হয়। যদিও, বিদ্বজ্জনেরা বলে থাকেন, বইয়ের ব্যবসা যেমন ছিল তেমনই থাকবে— আদর্শ পাঠকের সংখ্যা বরাবরই কম ছিল, এখনও তাই, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘বই’-এর সংজ্ঞা বদলে নতুন ভাবনায় প্রকাশনা শিল্প সাজাতে হবে।
প্যারিস বইমেলা নিয়ে ফরাসিদের মাতামাতি না দেখে দুঃখ পাই। মনে ভাবি, এ আবার কী! এই নাকি ইওরোপের সবচেয়ে সংস্কৃতিমনস্ক দেশের অবস্থা! 'ফরাসিরা বইমেলায় যায় না' = 'ফরাসিরা বই পড়ে না' এই সরল সমীকরণে বিশ্বাস করতে চায় আমার বইমেলা-প্রেম।
প্রশ্ন হলো, 'বাঙালিরা বইমেলা যায়' = 'বাঙালিরা বই পড়ে', এমন একটা সহজ সমীকরণ কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে আদর্শ বাঙালি বাঙালি এখন ভালোবেসে বই পড়ে, না কি বই ‘সংগ্রহ’ করতে মেলায় যায়? জনপ্রিয়তম বইমেলার আলো প্রাণে নিয়ে বাংলা প্রকাশনা আজ কেমন আছে?
কলকাতা বইমেলার শরীর-মন ভালো তো?