নির্বাচনী বন্ডের চেয়েও ভয়াবহ! ১২০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি PM CARES ফান্ডে?
PM CARES Fund Scam: বিরোধীদের অভিযোগ, চিনের বেশ কয়েকটি সংস্থা PM CARES তহবিলে দান করেছে।
মহামারী দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না দেশ। হঠাৎ চলে আসা মহামারী রুখতে ঠিক কী কী করা উচিত তা বোঝার আগেভাগেই দেশ জুড়ে লকডাউন। সময় যত পেরিয়েছে কোভিড আক্রান্ত দেশ প্রতিনিয়ত লাশ গুনেছে, প্রতিনিয়ত অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকেছে, গণচিতার ধোঁয়াতে গণতন্ত্রের আকাশ কালো হয়ে এসেছে। ঠিক এই দুর্ভোগের সময়ই কোভিড-১৯ মহামারীর যেকোনও সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে, "প্রধানমন্ত্রীর নাগরিক সহায়তা এবং জরুরি পরিস্থিতির ত্রাণ তহবিল" নামে একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করে। গোটা বিষয়টা পিএমকেয়ার্স ফান্ড নামেই বেশি পরিচিত হয়। মনে রাখতে হবে, দেশে কিন্তু আপদ-বিপদ-দুর্যোগ মোকাবিলায় দুইখানি এমন তহবিল আগে থেকেই ছিল। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ত্রাণ তহবিল (PMNRF) এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিল। এই দুই তহবিলের দেখভাল করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা PMO। পিএম কেয়ার্সের দায়িত্ব নেয় এই কার্যালয়ই। এই তহবিলে কে টাকা দিল, কত টাকা দিল জানা যাবে না। প্রশ্ন ওঠে, PMNRF যেখানে আছেই, সেখানে আরও একটি তহবিলের দরকার কী?
PM CARES আর PMNRF একই ধাঁচের হলেও এর উদ্দেশ্যগুলি আলাদা। PMNRF বর্তমানে দাঙ্গা, দুর্ঘটনা এবং চিকিৎসা বিভ্রাট, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকারদের সহায়তায় কাজ করে। অন্যদিকে, PM CARES জনস্বাস্থ্য সংকটের জন্য তহবিল তোলার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন কোভিড-১৯ মহামারীকালীন দুর্ভোগ, এই সময়কালে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধপত্রকে আরও মানুষের কাছে পৌঁছনো এবং এই সংক্রান্ত গবেষণার জন্যও টাকা দেওয়ার কাজে পিএম কেয়ার্স ফান্ড ব্যবহৃত হবে। দুই তহবিলই সুবিধা অনুযায়ী পরিবর্তন করা যায়।
আরও পড়ুন- বন্ডে ১,৩৬৮ কোটি টাকার অনুদান কেবল একজনেরই! কী এই ফিউচার গেমিং কোম্পানি?
দেশের কেন্দ্র সরকারের বিরোধীরা বলছেন নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারির মতোই পিএম কেয়ার্স ফান্ড বিজেপির আরেকটি বড় দুর্নীতি। কে কত টাকা দিয়েছে তা জানানো যাবে না, এইটুকুতেই স্পষ্ট এর মধ্যে বড়সড় সমস্যা আছে, বিষয়টি অস্বচ্ছ। বিরোধীদের দাবি, PM CARES তহবিলে প্রাপ্ত মোট তহবিলের পরিমাণ কমপক্ষে ১২,৭০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিছু কিছু ব্যক্তি ও সংস্থা অবশ্য প্রকাশ্যেই অনুদানের কথা জানিয়েছিল, যেমন রিলায়েন্স গ্রুপ (৫০০ কোটি টাকা), আদানি গ্রুপ (১০০ কোটি টাকা), পেটিএম (৫০০ কোটি টাকা), জেএসডব্লিউ গ্রুপ (১০০ কোটি টাকা)।
পিএম কেয়ার্স ফান্ডে টাকা দিলে তা আয়কর আইনের ধারা ৮০জি এর অধীনে ১০০% কর ছাড় পাবে। বিরোধীদের অভিযোগ, চিনের বেশ কয়েকটি সংস্থা PM CARES তহবিলে দান করেছে। TikTok দাবি করেছিল তারা ৩০ কোটি টাকা দান করেছে, Xiaomi ১০ কোটি টাকা, Huawei ৭ কোটি টাকা এবং OnePlus ১ কোটি টাকা দান করেছে বলে জানা যায়। চিন যখন লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় ভূখণ্ড দখলের প্রক্তিয়া চালাচ্ছে, চিন-ভারত সম্পর্ক যখন এতই জটিল তাহলে কেন এই সংস্থাগুলি টাকা দিচ্ছে দেশের সরকারকে?
সাধারণত কোনও পাবলিক চ্যারিটেবল ফান্ডের জন্য কোম্পানি আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ইচ্ছুক ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করা হয়, CSR বা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটিরর অংশ হিসেবে সংস্থার থেকে তহবিল নেওয়া যায়। তবে, এখানেও প্রশ্নচিহ্ন আছে। অভিযোগ ওঠে, সরকারি কর্মচারীদের তাঁদের বেতনের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে পিএম কেয়ার্স তহবিলে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই জোর করে অনুদান সংগ্রহ বিষয়টি মজুরি নিরাপত্তার অধিকারকে লঙ্ঘন করে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অনুদান পাওয়ার বিষয়টিও এতে যুক্ত আছে, এই বিষয়টি দেখে FCRA। এই অনুদান দিতে গেলে FCRA-র অধীনে রেজিস্ট্রেশনের জন্যও ৩ বছরের অডিট বিবৃতি প্রয়োজন। তবে PM CARES-এ টাকা দিতে চাইলে এই অডিট মকুব! অন্য সমস্ত তহবিল বা এনজিওর উপর যে নিয়ম আরোপিত আছে, কেন তার ঠিক বিপরীতে রাখা হলো পিএম কেয়ার্স ফান্ডকে?
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, PM CARES CAG-এর আওতায় পড়ে না। এর অডিট করবে স্বাধীন অডিটররা। এত বড় একটি ফান্ডের দায়িত্বে বেসরকারি অডিটররা? কেন? দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার ব্যাপক সুযোগ কি জেনে বুঝেই তৈরি করা হয়েছে?
ভারতীয় ট্রাস্ট অ্যাক্ট, ১৮৮২-এর ১৯ নম্বর ধারার অধীনে দাতব্য তহবিল হিসাবে PM CARES-কে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ট্রাস্ট তার সম্পত্তির একটি সঠিক হিসাব দিতে বাধ্য প্রাপককে।
আরও পড়ুন- ইলেক্টোরাল বন্ড মারফৎ জোড়া ফুলেরও বিপুল লক্ষ্মীলাভ! তৃণমূলকে টাকা দিল কারা?
PM CARES একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, এটি বেসরকারি সংস্থাগুলি থেকে অনুদান নেয়। কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেল (CAG) তাই এর অডিট করতে পারবে না। তবে PMNRF আর PM CARES এই দু'টি তহবিলই তৈরি করা হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ২৬৬, ২৮৩ এবং ২৮৪ অনুচ্ছেদকে মাথায় রেখে করা হয়নি। অনুচ্ছেদ ২৬৬(২) বলে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা, কনসলিডেটেড এবং কন্টিনজেন্সি ফান্ড ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত তহবিলই পাবলিক অ্যাকাউন্টের অন্তর্গত।
ধারা ২৮৩(১) বলে, কনসলিডেটেড এবং কন্টিনজেন্সি ফান্ডের হেফাজত, এই জাতীয় তহবিলে অর্থ প্রদান, সেখান থেকে টাকা তোলা, ভারতের পাবলিক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া এবং এই জাতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা সবকিছুই সংসদ প্রণীত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, আইনে বিধি না থাকা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। পিএম কেয়ার্স ফান্দ কিন্তু সংসদীয় তত্ত্বাবধানে নেই।
তথ্যের অধিকার (আরটিআই) আইনের অধীনে ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল, পিএমও থেকে এই ফান্ডে টাকা দেওয়া ব্যক্তি বা সংস্থার বিশদ তথ্য চেয়ে একটি আবেদন দায়ের করা হয়েছিল। পিএমও তথ্য দিতে অস্বীকার করে। অথচ আরটিআই আইন অনুসারে পিএমও আরটিআইয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে না কারণ পিএমও সরকারি সংস্থা। কিন্তু পিএমও জানায়, তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে সরকারি কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না এটি। তাই কে কত টাকা দিল জানানো যাবে না। এত রাখঢাক করে আসলে কি বড় দুর্নীতিকেই ধামাচাপা দিচ্ছে না বিজেপি?