রাত হলেই গায়েব হয়ে যায় দুবাইয়ের এই আস্ত গ্রাম! 'ভুতুড়ে' কারণ খুঁজতে গিয়ে মাথায় হাত
Al Madam Ghost Village: এলাকাটির বেশিরভাগ বাড়িরই দরজা খোলা; অনেক বাড়ির দরজাই নেই। তবে বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম সাদৃশ্য হচ্ছে উচ্চমানের মোজাইকের নকশা।
দুবাই, নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রচুর টাকা, তেল, বিলাসবহুল জীবন, ল্যাম্বরগিনি, বুর্জ খলিফা। কিন্তু এই বিলাসবহুল জীবন ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মরুভূমি। আর মরুভূমির মাঝে রয়েছে এক রহস্যময় গ্রাম। নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা এই গ্রামটিকে মনে করেন বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় গ্রাম। গ্রামটির নাম হল আল মাদাম। এই গ্রামটি রাতে রীতিমতো ভ্যানিশ হয়ে যায়। আবার সূর্যের আলো ফুটতেই দেখা দেয় সেই গ্রাম। এই জন্য আল মাদাম গ্রামকে ‘ভুতুড়ে গ্রাম’-ও বলা হয়। কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটে তার সঠিক কারণ আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রামটির এই ভুতুড়ে ঘটনা চাউর হতেই বিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজতে আল মাদামে যান। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, গ্রামে নাকি এমন এক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যে কারণে ওই গ্রামের ধারেকাছে ঘেঁষতেও কেউ সাহস পেতেন না।
দুবাই থেকে এক ঘণ্টারও কম দূরত্বে অবস্থিত শারজাহের সীমান্তবর্তী আল মাদাম গ্রামটি অনেকদিন ধরেই পরিত্যক্ত। গ্রামটি পরিত্যক্ত হলেও এখানে পুরোনো ঘরবাড়ি এখনও দৃশ্যমান; তবে বালির ঝড়ে ঢেকে গিয়েছে বাড়িগুলির জানালা, উঠোন ও আসবাবপত্র। গ্রামটিতে রয়েছে বেশ কিছু ঘরবাড়ি ও একটি মসজিদ। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সেখানে গিয়ে দেখেছেন সেগুলোর দরজা-জানলা হাট করে খোলা। ঘরের আসবাবপত্রও এলোমেলো। ওখানকার অধিবাসীদের ফেলে যাওয়া ব্যক্তিগত জিনিস দেখে মনে হয়, অধিবাসীরা তাড়াহুড়ো করে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। এ কারণে আল মাদাম অনেকের কাছেই ‘ভূতের গ্রাম’ নামেই পরিচিত। অধিবাসীরা কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কারণে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন, এমন গল্পও প্রচলিত রয়েছে।
বর্তমানে গ্রামটি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। দুবাইবাসীর কাছে পছন্দের জায়গা আল মাদাম। পৃথিবীর বেশ কিছু প্রথম সারির ইউটিউবার আল মাদামে এসে ট্রাভেল ভ্লগ বানাচ্ছেন। ফলত বিশ্বের দরবারে বেশ ভাইরাল হচ্ছে গ্রামটি। সত্যি বলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে আল মাদাম এতদিন পর্যন্ত একটি গুপ্ত বিষয় ছিল। তবে এই এলাকার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেকেই গ্রামটির কথা জানেন এখন। এলাকাটির বেশিরভাগ বাড়িরই দরজা খোলা; অনেক বাড়ির দরজাই নেই। তবে বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম সাদৃশ্য হচ্ছে উচ্চমানের মোজাইকের নকশা।
আরও পড়ুন- চা খেতে ডেকেছিলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম! ঋষি কাপুরের বয়ানেই স্পষ্ট বলিউডের মাফিয়া যোগ?
২০১৮ সালে শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন (এসএএফ) এই গ্রামটির ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এসএএফ সিএনএনের সঙ্গে ওই গ্রামের নিকটবর্তী এলাকাগুলি পরিদর্শন করে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আল মাদাম নিয়ে কথাবার্তা বলে। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য খানিকটা এইরকম- ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে গ্রামটিতে বসতি গড়ে ওঠে। মূলত মরুভূমির বালু ঝড়ের কারণেই গ্রামবাসীরা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যান। ১৯৬০-এর দশকে তেলের খনি আবিষ্কারের পর ও আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবে যাযাবর জাতি বেদুইনদের জন্য সরকার আধুনিক গৃহব্যবস্থার পরিকল্পনা করে। বেদুইনদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বদলে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও সুবিধার অঞ্চল গড়ে তোলা হয়। তবে এই পরিকল্পনার আওতায় থাকা বসতিগুলি খুব দ্রুত তৈরি করার ফলে সব পরিকাঠামো উপযুক্তভাবে বানানো হয়নি। এরকমই একটি বসবাসের জায়গা হল আল মাদাম। আল মাদামে মূলত বসবাস ছিল বেদুইনদের একটি উপজাতি আল-কুতবিদের। এছাড়াও ওই গ্রামে আরও কিছু উপজাতির বাস ছিল বলে জানা যায়।
শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশনের নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, আল মাদামে জল এবং বিদ্যুতের সংকটও ছিল। এই কারণেই বেদুইনরা গ্রামটি পরিত্যাগ করে চলে যায় বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রামটির দক্ষিণ দিকেই মূলত জনবসতি দেখা গিয়েছে। বাড়িগুলি এবং মসজিদটি গ্রামের ওই অংশেই দেখা গিয়েছে। স্থানীয় এলাকায় গ্রামটিকে ‘ঘোস্ট টাউন’ বলে অভিহিত করা হয়।
আরও পড়ুন- রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে
তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাত্রিবেলা উধাও কেন হয়ে যায় গ্রামটি? প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, রাতের বেলায় বালিতে ঢাকা পড়ে যায় গোটা গ্রাম। কারণ সেখানে ক্রমাগত হাওয়া চলতে থাকে। যে কারণে বালি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হাওয়ার সঙ্গে উড়ে যায়। আর সেই বালির তলায় চাপা পড়ে যায় গ্রাম। কিন্তু এই যুক্তিকে আবার বিজ্ঞানীদের একাংশ খণ্ডন করেছেন। তাঁদের দাবি, রাতে বালিতে চাপা পড়ে গেলেও, দিনে আবার দ্রুত বালি সরে যায় কীভাবে? এমনটা তো সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা আরও একটি সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। তা হল, রাতে দৃষ্টিভ্রমের কারণে গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়। কারণ দুবাইয়ে যেমন অর্ধেক মরুভূমি, তেমনই রয়েছে সমুদ্র। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাস দ্রুত গরম হয়, আর উপরের দিকের বাতাস সমুদ্রের কারণে ঠান্ডা থাকে। ফলে নীচের দিকে যখন আলোর প্রতিসরণ হয়, তখনই মনে হয় গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
এছাড়াও আল মাদামের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির বাসিন্দাদের বিশ্বাস, ওই গ্রামে এক মহিলার আত্মা ঘুরে বেড়ায়। ‘উম দুয়াইস’ নামে ওই আত্মার বিড়ালের মতো চোখ, হাতে ধারালো অস্ত্র থাকে। তবে কারণ যাই হোক না কেন গ্রামটির এই রহস্যময় চরিত্রের জন্য তা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
আজকাল মাঝেমধ্যেই সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বেশকিছু বাণিজ্যিক মেলা বা অন্যান্য অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এই পরিত্যক্ত গ্রামে। কয়েকদিন আগেই সেখানে একটি শপিং মলও খোলা হয়েছে। ফলত পর্যটকদের ভিড়ে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে এই জায়গাটি। যদিও এই গ্রামের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণ উদঘাটন করতেই বেশি ভিড় করে থাকেন পর্যটকরা। এই রহস্য কোনওদিন সত্যিই উদঘাটিত হয় কিনা সেটাই দেখার।