কষ্ট ভুলতে গিয়ে আরও অবসাদ! ডিপ্রেশনের রোগী করে তুলতে পারে মদই?

Alcohol and Depression: অ্যালকোহলের পরিমাণ প্রতি এক ডেসিলিটার রক্তে যখন ৫০ মিলিগ্রামে পৌঁছয় তখন মেজাজ ফুরফুরে লাগে।

সুরাপ্রেমীরা বলেন মদ্যপানে মন ভালো হয়। মন খারাপ হলে কিংবা সপ্তাহান্তে কিঞ্চিৎ মন হালকা করার উদ্দ্যেশ্যে অনেকেই রওনা দেন ভাঁটিখানার উদ্দ্যেশ্যে। সামান্য মদ্যপানের পরই যখন মেজাজ ফুরফুরে হয়, যাকে বলে ‘হ্যাপি হাই’- তারপর কেউ কেউ নিজেকে ভাবেন রবীন্দ্রনাথ, কেউ কার্ট কোবেন, কেউ বা ক্রিস্টোফার নোলান। তারপর বেশ খানিকটা পেটে পড়ার পর, ধীরে ধীরে অবসাদ বা একাকীত্বের মেঘ নেমে আসে। আর আসল প্রশ্নটা এখানেই শুরু হয়। মদ কি সত্যিই আমাদের মন ভালো করে? কতটা মদ খেলে মস্তিষ্ক আমাদের সঙ্গে বেগড়বাঁই শুরু করে?

গবেষণা বলছে, অ্যালকোহলের পরিমাণ প্রতি এক ডেসিলিটার রক্তে যখন ৫০ মিলিগ্রামে পৌঁছয় তখন মেজাজ ফুরফুরে লাগে। আমরা নিজেদের জড়তা বা মনের ভেতর পুষে রাখা সামাজিক বাধাগুলোকে ছাড়িয়ে ফেলি, কথা বেশি বলি। আবার কখনও কখনও নিজেরা যে কাজগুলো করতে পটু, সেই কাজগুলোতেও একটু ভুলভ্রান্তি করে ফেলি। কিন্তু তারপর পেটে যখন আরেকটু মদ পড়ে, মানে ধরুন তখন প্রতি ডেসিলিটার রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ ১০০ মিলিগ্রাম ছাড়িয়েছে- শুরু হয় অ্যাটাক্সিয়া, নিজের মেজাজ এবং আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন এবং ধীরে ধীরে আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কাজ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ডিপ্রেশন’।

আরও পড়ুন- কীভাবে তৈরি হত কন্ডোম? তাজ্জব করবে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রাচীন কন্ডোমের এই ইতিহাস

ডিপ্রেশনের বাংলা নিম্নচাপ হলেও হতে পারে কিন্তু ডিপ্রেশনের বাংলা মন খারাপ কখনও নয়। আপাতত ডিপ্রেশন আর মন খারাপের পার্থক্য কী কী এবং কেন দু’টি বিষয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, সেই প্রসঙ্গ অন্য কোনওদিনের জন্য তুলে রেখে এটুকুই বলা যায়, ডিপ্রেশন হলে অবসাদ অবশ্যই হয়। তবে ডিপ্রেশন মানে কেবল অবসাদকেই বোঝায় না। ডিপ্রেশন মানে শরীরের পুরো সিস্টেম অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্র তো বটেই, পাচন, পুষ্টি, রেচন, স্বাভাবিক যৌন চাহিদা, অনাক্রম্যতা-সহ নিজের দৈনন্দিন জীবন বিঘ্নিত হয়। পুরো সিস্টেমটাই যেন একপ্রকার বৈকল্যের শিকার হয় এবং সেই কারণেই অ্যালকোহলকে বলা হচ্ছে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের ‘সাইকোট্রপিক ডিপ্রেসেন্ট’। NSW-এর স্বাস্থ্য দপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী যে সমস্ত বস্তু আমাদের মানসিক কাজ, আমাদের আচার-আচরণ এবং আমাদের সার্বিক মানসিক ও শারীরিক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে বিকল করে বা বিঘ্নিত করে, তাদেরকে ‘সাইকোট্রপিক ডিপ্রেসেন্ট’ বলে।

অ্যালকোহল প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করলেও, যেহেতু কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আমাদের শরীরের বাদবাকি সিস্টেম বা তন্ত্রকেও নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সার্বিক প্রভাব পড়ে শরীরের উপর। তাই ‘ডিপ্রেসড’ হয়ে পড়ে সমগ্র শরীরের বাকি তন্ত্রগুলিও। দীর্ঘকালীন অ্যালকোহল সেবনে কিংবা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে শুরু হয় সাইকোমোটোর ডিপ্রেশন। অর্থাৎ, যে সমস্ত নার্ভ আমাদের পেশির চলন এবং প্রকারান্তরে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চলন নিয়ন্ত্রণ করে, সেই পুরো ব্যবস্থাটাই বিঘ্নিত হয়। শুধু তাই নয়, স্মৃতিশক্তি এবং যুক্তিভিত্তিক ভাবনা-চিন্তা করতেও সমস্যা দেখা যায়। এর পাশাপাশি আমাদের ‘রিওয়ার্ড সিস্টেম’-কে সক্রিয় করে তোলে অ্যালকোহল। ‘রিওয়ার্ড সিস্টেম’ আদতে আমাদের পুরস্কার, আনন্দ, বা ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশাকে একটু বাড়িয়ে তোলে। আর আমরা যেখানে প্রাথমিকভাবে অ্যালকোহল সেবনে আনন্দই পাই, যা আমাদের কাছে একপ্রকার পুরস্কার বা রিওয়ার্ড, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও মদ্যপানে ইচ্ছে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেখান থেকে বাড়বে আরও মদ্যপানের ইচ্ছে এবং নেশা হওয়ার সম্ভাবনা।

অ্যালকোহল মস্তিষ্কের একাধিক প্রকার স্নায়ুর কাজকে প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করে স্নায়ু থেকে ক্ষরিত বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের কাজকে। স্নায়ুকোশের পর্দায় লেগে থাকে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর। যার মধ্যে অন্যতম গামা-অ্যামাইনোবিউটাইরিক অ্যাসিড (GABA), গ্লুটামেট, এন্ডোক্যানাবিনয়েডস প্রভৃতি। আলকোহল গিয়ে সরাসরি আবদ্ধ হয়ে সেই নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টরগুলিতে। নির্দিষ্ট নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর নির্দিষ্ট নিউরোট্রান্সমিটারের যাতায়াতের পথ, আর সেই পথে গিয়ে যদি অ্যালকোহল নিজেই গিয়ে বসে পড়ে, নিউরোট্রান্সমিটারের যাওয়া আসা এবং কাজ যে ব্যহত হবে, তা তো আন্দাজ করাই যায়।

ঠিক সেই জন্যেই অ্যালকোহল গাবামিনার্জিক নিউরোট্রনাসমিশন পাথওয়েকে প্রভাবিত করলে ঘুম ঘুম পায়, জড়তা কাটে এবং প্রাথমিকভাবে মেজাজ হালকা হয়। একই বিষয় দেখা যায় সেরোটোনিনারজিক পাথওয়েকে প্রভাবিত করলে। তখন সেরোটোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। ডোপানিনার্জিক পাথওয়েকে প্রভাবিত করলে আনন্দ পায়, সন্তুষ্টি বোধ আসে। কিন্তু তার পাশাপাশি আরও অ্যালকোহল সেবনের ইচ্ছে বাড়ে। কিন্তু গ্লুটামিনার্জিক পাথওয়ে অর্থাৎ গ্লুটামিন যে পথে কাজ করে– সে অ্যালকোহলের জন্য প্রভাবিত হলে কগনিটিভ ফাংশন নষ্ট হয়, চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা, যুক্তি দিয়ে ভাববার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিঘ্নিত হয় স্বাভাবিক ঘুমের রুটিন।

আরও পড়ুন- মদ না খেয়েই মাতাল! জানেন কোন কঠিন অসুখ বাসা বাঁধছে আপনার শরীরে

অ্যালকোহল কেবল নিউরোট্রন্সমিটার রিসেপ্টরকেই প্রভাবিত করে না। প্রভাবিত করে নিউরোন বা নার্ভকোশের দেওয়ালে আবদ্ধ সোডিয়াম ও পটাশিয়াম চ্যানেলকেও। এই দুই চ্যানেলই নিউরোনের মধ্যে দিয়ে রাসায়নিক সংকেত বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সাহায্য করে একাধিক নিউরোট্রান্সমিটারকেও। এর ফলে বিভিন্ন অবসাদ, রাগ, দুঃশ্চিন্তার মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি পেশির স্বাভাবিক কাজ ব্যহত হয়।

একাধিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে,অ্যালকোহলিক ইউজ ডিসঅর্ডার (সংক্ষেপে AUD) থেকে দেখা যেতে পারে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। যারা ইতিমধ্যেই অ্যালকোহলিক ইউজ ডিসঅর্ডারের শিকার, তাঁদের মধ্যে প্রায় ২.৩ গুণ বেশি সম্ভাবনা আছে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগার। আশ্চর্যের বিষয় হল, যাঁরা অ্যালকোহল নির্ভরতার (Alcohol dependence) শিকার তাঁদের মধ্যে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগার আশঙ্কা, alcohol abuse-এর শিকার যারা, তাঁদের থেকে বেশি। দেখা যাচ্ছে যাঁরা অ্যালকোহল নির্ভরতার শিকার, তাঁদের মধ্যে ৩.৭ গুণ সম্ভাবনা বেশি ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগার। আবার এও দেখা যাচ্ছে, যাঁদের মধ্যে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার রয়েছে, তাঁদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যার মানুষদের মধ্যে অ্যালকোহলিক ইউজ ডিসঅর্ডারে ভোগার আশঙ্কা থাকে।

সুতরাং, সুরাকে আপনার মন খারাপের ওষুধ বলার আগে, একবার ভাববেন না কি?

More Articles