বন্ধু-স্বজনের মনের খবর রাখে কে! ডিপ্রেশন নিয়ে বাস্তবে কতটা সচেতন আমরা?
Depression Treatment: যে মানুষটি হাসিমুখের আড়ালে ভেতরের চরম উথালপাথালকে আড়াল করছেন, তাঁর কথা শোনার মতো সংবেদনশীল শ্রোতা ক্রমেই কমে আসছে।
গুগলে সুইসাইড লিখে সার্চ করলেই সাহায্যের নম্বর এগিয়ে আসে সবার আগে। যদিও চরম সেই মুহূর্তে কতজন গুগল সার্চ করে সাহায্য পেয়ে আত্মহত্যা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন তার তথ্য নেই। এসব জনস্বার্থে করতেই হয়। মানবিক ও মানসিক সাহয্যের জন্য মানুষ এখনও প্রযুক্তি নয়, মানবের উপরেই নির্ভরশীল হতে চায়। ভয়াবহ সেই মুহূর্তে একটি ফোন, একটি দৌড়ে আসা, একটি জড়িয়ে ধরার মতো বান্ধব পেলে বহু সম্ভাবনাময় প্রাণ নক্ষত্র হয়ে উঠতে পারত। অথচ মানুষের পাশে মানব নেই। ক্রমাগত আলোকবর্ষ দূরত্ব বাড়ছে। একটি আত্মহত্যার পর অনেকগুলি আলোচনা, সতর্কবার্তা, অনেকগুলি পরামর্শ। তারপর আবারও নিকষ আঁধার, যে আঁধারে পড়শির খোঁজও রাখেন না কেউ। সকাল থেকে রাত্রি একইসঙ্গে থাকা মানুষের মনের খোঁজও পান না মানুষ।
ফসিলস-এর প্রাক্তন বেসিস্ট চন্দ্রমৌলি বিশ্বাস আত্মহত্যা করার বেশ কয়েকঘণ্টা আগে, ফেসবুকে ডিপি পাল্টেছিলেন। মৃত্যুর পর অনেকে অবাক হয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই লিখেছেন, যে মানুষ এত ঘণ্টা আগে ডিপি বদলায় সে কী করে এত ঘণ্টা পরে আত্মহত্যা করতে পারে! অবাক হওয়া যেতে পারে, কিন্তু অবাস্তব বা অসম্ভব ঘটনা এটা নয়। মৃত্যুর মিনিট পাঁচেক আগেও সুস্থ-স্বাভাবিক ফোনালাপ সেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন এমনটাও হামেশাই ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ডিপিতে আমরা হাসিমুখেরই ছবি দিই, আমরা সুন্দর নিসর্গের সামনে বসে থাকা ছবি দিই, প্রাণোচ্ছল, আকর্ষণীয় ছবি দিই, কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশজনই 'ভালো' বলেন। বাস্তবে কতটা প্রাণোচ্ছল থাকছেন তিনি? বাস্তবে কতখানি ভালো? সোশ্যাল মিডিয়া এক ছদ্ম সমাজ আমাদের উপহার দেয়। আমরা যা যা ভালোবাসি তাই তাইই সাধারণত আমাদের নিউজফিডে ঘোরে, আমরা যেমন মানুষ পছন্দ করি তেমন মানুষেরই ফ্রেন্ড সাজেশন আসে। এই ছদ্ম সমাজকেই অনেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারও করেন। ভেতরে তিনি যতই পুড়ে শেষ হয়ে যান না কেন, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যান না কেন, সমাজ যেমন প্রাণোচ্ছলতা পছন্দ করে অনেকে তেমনটাই প্রকাশ করেন। এ এক ঢাল বৈ কিছু নয়।
আরও পড়ুন- গুরু দত্ত থেকে চেস্টার বেনিংটন, চন্দ্রমৌলি! কেন বারবার জীবনের সুর হারাচ্ছেন শিল্পীরা?
যে মানুষটি হাসিমুখের আড়ালে ভেতরের চরম উথালপাথালকে আড়াল করছেন, তাঁর কথা শোনার মতো সংবেদনশীল শ্রোতা ক্রমেই কমে আসছে। বেশ কিছু সমীক্ষা বলছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন। তবে বাস্তবের চিত্র পুরোটাই এমন নয়। স্থানভেদে, সামাজিক স্তরভেদে এই সচেতনতাও ভিন্ন। পাশাপাশি, গবেষকরা দেখেছেন মানুষের মধ্যে 'এমপ্যাথি' কমেছে দ্রুতহারে। এমপ্যাথি হচ্ছে সহানুভূতি। অন্য মানুষের আবেগ এবং তারা তাদের জায়গায় কী অনুভব করছেন তা বোঝার ক্ষমতাই একজন মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলে। সহানুভূতিশীল মানুষ অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখেন। ওই ভুক্তভোগী মানুষটির জায়গায় নিজেকে রেখে বিচার করেন।
সহানুভূতিশীল হলে সহকর্মীদের পরিস্থিতি, কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক বা না হোক, বিচার করার এবং অনুভব করার একটি জায়গা তৈরি হয়। বলা বাহুল্য, এই সহানুভূতি এবং সংবেদনশীলতা, দুইই ক্রমহ্রাসমান। আমাদের পাশের বাড়ির মানুষ কেমন আছেন, শরীরে বা মনে এই তথ্য আমাদের জানা নেই। আমাদের পাশে বসে কাজ করা, চা খেতে যাওয়া সহকর্মী কেমন আছেন মনে মনে তা আমাদের জানা নেই। আমাদের বন্ধুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিনা, কোনও সমস্যা তাঁকে শেষ করে দিচ্ছে কিনা সেই নিয়ে সময় ব্যয় করা আমাদের অভ্যাস থেকে মুছে গিয়েছে। চন্দ্রমৌলি বিশ্বাসের আত্মহত্যা আরেকবার সেই নগ্ন সত্যের সামনেই আমাদের এনে দাঁড় করায়।
আরও পড়ুন- ফসিলস-এর ১৮ বছরের সঙ্গী! কেন এমন চরম সিদ্ধান্ত নিলেন চন্দ্রমৌলি?
প্রথমত মানসিক রোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার ব্যাধি সকলেরই রয়েছে, যতই সচেতনতা বাড়ুক না কেন। যেহেতু এই রোগ নিঃশব্দ ঘতক তাই এর উপসর্গ সেভবে চোখে পড়ে না। যার উপসর্গ নেই, তাকে চিকিৎসাযোগ্য মনে না করাটাই অভ্যাস। সম্প্রতি কিছু বছরে, চন্দ্রমৌলির মতোই একাধিক শিল্পী চরম পথ বেছে নিয়েছেন। দেখা গেছে, শিল্পীদের ক্ষেত্রে ক্রমেই বাড়ছে হতাশা। যারা তথাকথিত চাকরির পথে না হেঁটে বিকল্প জীবন নির্বাচন করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রথম তীব্র লড়াইটি হলো সামাজিক লড়াই। স্টিরিওটাইপ ভেঙে এগোতে চেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের যেমন সামাজিক পারিবারিক লড়াই লড়তে হয়, তেমনই দ্বন্দ্ব চলে নিজের মধ্যেও। এতে ছাপ ফেলে যায় সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, আদর্শহীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং আরও কত কী। এই দ্বন্দ্ব বলে বোঝানোর বা স্রেফ বলার মতো বান্ধবই অপ্রতুল। অনেকসময়ই, হতাশাগ্রস্ত মানুষ হয়তো কোনও সাহয্য প্রত্যাশা করছেন না, কেবল পাশে চাইছেন কাউকে। অথচ তা বলে বোঝানোর অবস্থাও নেই। সেই না-বলতে পারা অবসাদ বোঝার মতো সংবেদনশীলতা কমছে।
মাঝারি বা গুরুতর ডিপ্রেশন থেকে সাধারণত আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। এই ডিপ্রেশন দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলে। এই অবস্থায় অনেককেই চিকিৎসকরা সাইকোট্রপিক ওষুধ দেন। মারাত্মক ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রোশক ব্যবহার হয় চিকিত্সার জন্য। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হতে পারেন প্রিয়জনরা। ভুক্তভোগী মানুষটির সঙ্গে থাকা, তার সমস্যার কথা শোনা, কেউ যে পাশে আছে এটুকু বিশ্বাস দেওয়ানোর মতো বড় ওষুধ আর নেই। চন্দ্রমৌলি কিছুকাল আগেই সহকর্মীদের সঙ্গে মিউজিক ভিডিওর কাজ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সক্রিয়। তার মানসিক সমস্যার চিকিৎসাও চলছিল বলে জানা গেছে। থাকতেন বাবা-মায়ের সঙ্গে। তারপরেও জীবন ছেড়ে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করলেন এই প্রতিভাবান গিটারিস্ট। আমরা সেই সংবেদনশীলতার চর্চা জারি রাখতে কতটা সক্ষম? ডিপ্রেশন মহামারী হচ্ছে, নিঃশব্দ ঘাতকের মতো ঘাপটি মেরে আছে। একমাত্র সহানুভূতি দিয়ে সেই ঘাতককে হারানো যায়। জীবনের চেয়ে বড় ম্যাজিক আর কোথায়ই বা আছে!