ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায়! তবু কেন অ্যাসিডিটির এই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ভারতে?
Zantac Medicine Cancer: ভারতে র্যানিটিডাইন বিক্রি বন্ধ করার জন্য সরকার গত পাঁচ বছরে কাজ করেনি কেন, বিশেষ করে যখন অন্যান্য ওষুধের যথেষ্ট বিকল্প বাজারে রয়েছে!
গত মাসেই বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, GSK এক রেকর্ড ভাঙা রেকর্ড গড়েছে! ২.২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই কোম্পানির সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধগুলির একটির বিরুদ্ধে চলা একাধিক মামলার নিষ্পত্তি করেছে GSK। কী এমন ওষুধ? খুব সাধারণ, খুবই সাধারণ। অ্যাসিড রিফ্লাক্স বন্ধের ওষুধ- Zantac®। এই ওষুধটির একটি সক্রিয় উপাদান হচ্ছে Ranitidine। গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ওষুধটিতে উচ্চ পরিমাণে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী এন-নাইট্রোসোডিমেথাইলামাইন (এনডিএমএ) নামক কার্সিনোজেন রয়েছে।
আমেরিকান ফার্মেসি ভ্যালিশিওর প্রথম এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। এদের গবেষণাগারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের র্যানিটিডাইন পরীক্ষা করে কিছু নমুনায় ৩,০০০,০০০ ন্যানোগ্রামের বেশি NDMA পাওয়া গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই এনডিএমএ-এর গ্রহণযোগ্য সীমা হচ্ছে ৯৬ ন্যানোগ্রাম। সমস্ত কার্সিনোজেনের মতোই অত্যধিক এনডিএমএ ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
NDMA-এর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের কারনে এটির সঙ্গে অণুগুলির স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ সমস্যাটি কেবল GSK-র সমস্যা নয়। র্যানিটিডাইন উৎপাদনকারী যে কোনও কোম্পানি এই একই সমস্যার সম্মুখীন হবে। যে কারণে ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) এবং ইউরোপিয় মেডিক্যাল এজেন্সি (ইএমএ) ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের আওতায় থাকা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের র্যানিটিডাইন বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। GSK নিজেই ২০২০ সালে ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছিল যে, তাদের কোম্পানি ভারত থেকে সমস্ত র্যানিটিডাইন প্রত্যাহার করছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক অন্যান্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলিকে র্যানিটিডাইন তৈরি এবং বিক্রি করা থেকে বিরত করতে কোনও পদক্ষেপ করেনি।
আরও পড়ুন- নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করেও রেহাই! ১০০০ কোটির বন্ড কিনেছে কোন কোন ওষুধ কোম্পানি?
২০২১ সালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসা খবরে দেখা যায় ভারতে তখনও দিব্যি র্যানিটিডাইন বিক্রি হচ্ছে। সরকারের থেকে জবাব চাওয়া হলে বিশেষ সদুত্তর মেলে না। সরকার পক্ষ বলেছিল, তারা বিষয়টি 'দেখছে’। যদিও এই 'দেখা'-র পরও কোনও পদক্ষেপ করেনি সরকার।
সরকারের কাছে দু'টি নির্দিষ্ট প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, কেন ভারতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভারতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত র্যানিটিডাইনের একই মাত্রার এনডিএমএ শনাক্ত করার চেষ্টাও করেনি, কোনও প্রতিক্রিয়াও জানায়নি। দ্বিতীয়ত, ভারতে র্যানিটিডাইন বিক্রি বন্ধ করার জন্য সরকার গত পাঁচ বছরে কাজ করেনি কেন, বিশেষ করে যখন ফ্যামোটিডিন, এসোমেপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, ওমেপ্রাজল, সিমেটিডিনের মতো অন্যান্য ওষুধের যথেষ্ট বিকল্প বাজারে রয়েছে যা 'গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স' বা অ্যাসিডিটির চিকিৎসা করতে পারে।
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, এই ধরনের ওষুধ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পর্যায়ের জন্য দায়ী সরকারের যে মূল প্রতিষ্ঠান, সেগুলি চিহ্নিত করা সবার আগে দরকার।
এই ধরনের ওষুধের পরীক্ষার জন্য, এর উপাদানের গ্রহণযোগ্য সীমা এবং বিশ্লেষণী পদ্ধতি সহ মান নির্ধারণের কাজটি করে ভারতীয় ফার্মাকোপিয়া কমিশন (IPC), স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এটি যার সভাপতি হচ্ছেন স্বাস্থ্য সচিব। ইন্ডিয়ান ফার্মাকোপিয়া বিভিন্ন ওষুধের স্ট্যান্ডার্ড এবং পরীক্ষার প্রোটোকল তৈরি করে। আইপিসিকে অবশ্যই 'রেফারেন্স স্ট্যান্ডার্ড' এবং 'ইম্পিওরিটি স্ট্যান্ডার্ড' তৈরি করতে হবে যাতে র্যানিটিডাইনের মতো ওষুধগুলিকে সহজে পরীক্ষা করা যায়।
আরও পড়ুন- মুঠো মুঠো ব্যথার ওষুধ খাচ্ছেন? পেইনকিলার নিয়ে যে আশঙ্কার কথা জানাচ্ছে সরকার
ওষুধ প্রস্তুতকারীরা যাতে আইপিসি নির্ধারিত মানগুলি মেনে চলে তা নিশ্চিত করার কাজটির দায়িত্ব প্রথমত রাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রকদের যারা এই জাতীয় ওষুধ তৈরির লাইসেন্স দেয় এবং দ্বিতীয়ত, রাজ্য এবং কেন্দ্রের ড্রাগ ইন্সপেক্টরদের। যে ওষুধগুলি IPC-এর মানে উত্তীর্ণ হয় না সেগুলি মান্যতা দেওয়া হয় না৷ তাহলে IPC কেন র্যানিটিডাইনের এনডিএমএ বিষয়ক সমস্যাটি ধরতে পারল না? ২০২০ সাল থেকে র্যানিটিডাইনে এনডিএমএর জন্য পরীক্ষামূলক প্রোটোকল সহ অনুমোদিত মান নির্ধারণের জন্য ঠিক কী করেছে এই সংস্থা? ইন্ডিয়ান ফার্মাকোপিয়ার সাম্প্রতিকতম সংস্করণ কিনতে ৫০,০০০ টাকা খরচ করতে হয়। অথচ এটি বিনামূল্যে পাওয়া উচিত কারণ এতে বাধ্যতামূলক আইনি মানগুলি লেখা রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এটি। আইপিসি একবার র্যানিটিডাইনের NDMA-এর অনুমোদিত সীমা নির্ধারণ করেলে এর প্রস্তুতকারকরা, যারা IPC নির্ধারিত মানগুলি মেনে চলতে পারছে না তারা হয় এই ওষুধ উত্পাদন বন্ধ করে দেবে বা ড্রাগ ইন্সপেক্টররা নিম্নমানের ওষুধ তৈরির জন্য এই প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে মামলা করবে৷
বিশ্বের যে কোনও জায়গায় জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এমন উদ্বেগজনক অবস্থা প্রকাশ পেলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আইপিসি ছাড়াও বাজারে কোনও ওষুধ বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব কার? ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০-এর ধারা ২৬এ বলছে, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, স্বাস্থ্য মন্ত্রকেরই দেশে ওষুধের উত্পাদন এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে। মন্ত্রক এই বিষয়ে তাহলে কেন কাজ করছে না? স্পষ্ট উত্তর, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব। এই মন্ত্রকের যুগ্ম সচিবের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বা ফার্মাকোলজি সম্পর্কে জ্ঞান সাধারণত খুব কমই। তবে এই কারণে, কোটি কোটি মানুষের জীবন তো ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে না কিছুতেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রক অবিলম্বে ধারা ২৬এ-এর অধীনে দেশে র্যানিটিডাইনের ক্রমাগত উত্পাদন এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করার আদেশ জারি না করলে দেশে ক্যান্সারের বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়বে বহুগুণ।