গুরু দত্ত থেকে চেস্টার বেনিংটন, চন্দ্রমৌলি! কেন বারবার জীবনের সুর হারাচ্ছেন শিল্পীরা?
Chronic Depression: গবেষকরা বলছেন, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক ব্যাধি রয়েছে।
সাল ১৯৬৪। মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে গুরু দত্তের দেহ উদ্ধার হলো। ভারতীয় সিনেমার তারকা তিনি তখন। তবু, বাড়ি থেকে মদ আর ঘুমের বড়ি উদ্ধার হলো মৃতদেহের পাশে। জানা যায়, অতিরিক্ত মদ, ঘুমের বড়ির অতিরিক্ত মাত্রা, বারেবারে মন ভেঙে যাওয়া আর তীব্র হতাশা গ্রাস করেছিল গুরু দত্তকে। ফলে চরম সিদ্ধান্ত। নিজেকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন চেস্টার বেনিংটন। বিখ্যাত ব্যান্ড লিঙ্কিং পার্কের মূল গায়ক! ৪১ বছর বয়সে, বেনিংটন ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দেন। কোনও সুইসাইড নোট ছিল না। প্রবল নেশাগ্রস্ত ছিলেন চেস্টার, সঙ্গে ছিল ভরপুর অবসাদ।
২০১৪ সালে তেলেগু এবং তামিল সিনেমার অভিনেতা উদয় কিরণ আত্মহত্যা করেন। বয়স তখন মাত্র ৩৩। আরেক তারকা চিরঞ্জীবীর মেয়ের সঙ্গে বাগদানের কথা ছিল তাঁর। সেই বিয়ে ভেঙে যায়। ২০১২ সালে বিয়ে করেন বিশিষ্ঠাকে। ২০১৪-তে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় নিজের বাড়িতে। জানা যায়, কাজ ছিল না হাতে। টানা প্রায় একবছর অর্থকষ্টের পাশাপাশি মানসিক সঙ্কটে ভুগছিলেন উদয় কিরণ।
![](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2025/01/13130525/chester-benningtong.jpg)
চেস্টার বেনিংটন
২০১৩ সাল। ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় অভিনেত্রী জিয়া খানের দেহ। জিয়া খানকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য উঠতি অভিনেতা সুরজ পাঞ্চোলির নামে মামলা হয়। সুইসাইড নোটে বয়ফ্রেন্ডের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ। মাত্র ২৩ বছরে শেষ হয়ে যান জিয়া, মানসিকভাবে শেষ হয়ে গেছিলেন তারও আগে। এই উদাহরণ শেষ হওয়ার নয়। কাজ না থাকা, অর্থকষ্ট, মানসিক অশান্তি, বিষণ্ণতা কেড়ে নিয়েছে অজস্র সম্ভাবনাকে। বিনোদন জগতে তো বটেই! গুরু দত্ত থেকে শুরু করে দিব্যা ভারতী, মাত্র ১৯ বছর বয়সে মুম্বইতে তাঁর বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের জানালা থেকে লাফিয়ে পড়েন। সিল্ক স্মিতাকে ভুলে গেলে চলবে না। কাজ ছিল না, প্রেমহীন সম্পর্কে থেকে বিষাদে জীর্ণ সিল্ক গলায় দড়ি দেন। পারভীন বাবিও নিজেকে শেষ করে দেন। অস্কারজয়ী সঙ্গীতকার এআর রহমানও জানিয়েছেন, জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে ছেয়েছিলেন। মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতার কথা স্বীকার করেছেন দীপিকা পাডুকোনও।
আরও পড়ুন- কষ্ট ভুলতে গিয়ে আরও অবসাদ! ডিপ্রেশনের রোগী করে তুলতে পারে মদই?
![](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2025/01/13130519/Silk-Smitha.webp)
সিল্ক স্মিতা
বলিউডের ম্রুণাল ঠাকুর, আমিত সাধের মতো তারকারাও আত্মহত্যার প্রবণতার কথা জানিয়েছেন।অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের মতো একাধিক বিখ্যাত বলিউড তারকারাও হতাশা, অবসাদের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ ফিরে এসেছেন চরম সীমায় গিয়েও, কেউ কেউ সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো হারিয়ে গিয়েছেন। শুধু ইদানীং সময়েই নয়। মানসিক টানাপড়েনে আত্মহত্যা বিশ্বজুড়ে বহু কিংবদন্তীর জীবন কেড়েছে। রুশ কবি-নাট্যকার মায়াকোভস্কি মাথায় গুলি করে নিজেকে শেষ করে দেন। নোবেলজয়ী বিখ্যাত সাহিত্যিক এনি সেক্সটন আত্মহত্যা করেন। প্রচুর পরিমাণে ভদকা খেয়ে, গ্যারেজে ঢুকে গাড়ির ইঞ্জিন চালিয়ে ইঞ্জিন থেকে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস টেনে নিয়ে মারা যান তিনি। জানা যায়, বহু বছর ধরে তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগেছিলেন তিনি। ২০ বছর ধরে অবসাদে কাটিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন ঔপন্যাসিক ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস। এই তালিকা অনন্ত। তাতে সদ্য জুড়ে গেলেন ফসিলস ব্যান্ডের প্রাক্তন বেসিস্ট চন্দ্রমৌলি বিশ্বাস।
বিনোদনের জগতে অবসাদের বা অন্যান্য মানসিক রোগের পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কট এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেক জীবিকাতেই লড়াই থাকে। তবে বিনোদনের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু আলাদা। সেখানে নির্দিষ্ট চাকরি নেই কোনও, বিশেষ করে যারা কোনও ব্যানার ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক, সঙ্গীতশিল্পী বা বিনোদন দুনিয়ায় যারা আছেন, তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। এই পেশাতে চড়াই উতরাই অনেকটা বেশি থাকায় অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনের সমস্যাও বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন- ফসিলস-এর ১৮ বছরের সঙ্গী! কেন এমন চরম সিদ্ধান্ত নিলেন চন্দ্রমৌলি?
![](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2025/01/13130513/Mayakovsky.jpg)
মায়াকোভস্কি
আরও একটি বিষয় হচ্ছে, অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখেন কিন্তু খুব কমজনই খ্যাতি পান। হয়তো একইসঙ্গে কাজ শুরু করেছেন, কিন্তু কেউ একজন বা দু'জনই পরিচিত হয়েছেন বাকিরা হারিয়ে গেছেন। অথবা নতুন মুখ আসায় পুরনোদের জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে- এমন উদাহরণও বিস্তর। এটাও অনেকেই মেনে নিতে পারেন না বলেই জানাচ্ছেন মনোবিদরা। মনোবিদরা বলছেন ডিপ্রেশনের তীব্রতা বদলায়। সাধারণত এটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: হালকা, মাঝারি আর গুরুতর। ডিপ্রেশন মাঝারি বা গুরুতর হলেই নিজেকে কষ্ট দেওয়া বা আত্মহত্যার চিন্তা বা আত্মহত্যার প্রচেষ্টার মতো ঘটনার দিকে তা চালিত করতে পারে। ডিপ্রেশন থাকলেই যে সকলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তেমন নয়। তবে ডিপ্রেশন অবশ্যই আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষকরা বলছেন, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক ব্যাধি রয়েছে।
আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায় আরও কিছু কারণও- যেমন আগে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা, আত্মহত্যার পারিবারিক ইতিহাস, দীর্ঘস্থায়ী চাপ বা অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিগত সংকট, যেমন সম্পর্কের সমস্যা, হুমকি, চাকরি হারানো বা প্রিয়জনের মৃত্যু। শরণার্থী, অভিবাসী, আদিবাসী, এলজিবিটিকিউ মানুষ এবং বন্দিদের মধ্যেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি। বিশেষজ্ঞরা বারেবারে বলছেন, ডিপ্রেশন চিকিত্সাযোগ্য, আত্মহত্যা এড়ানো যায়। শুধু সময়মতো সঠিক সাহায্যের দরকার৷ অনেকেই সেই সাহায্যের হাত হয়তো খুঁজে পান না। প্রবল অন্ধকারে কাছের জিনিসও তো দেখা যায় না।