গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে, কোন পথে হাঁটবে এবার শ্রীলঙ্কা?

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে সরকারের ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি, সর্বনাশা কর নীতি এবং সর্বোপরি কোভিডের প্রকোপে পরিস্থিতি আরও হাতের বাইরে চলে যায়।

 

ছবির মতো সুন্দর সাজানো দেশ শ্রীলঙ্কা। তবে তা ছিল বাইরের আবরণমাত্র। ভেতরে ভেতরে ঘূণ ধরেছিল আগেই। আঙুল ঠেকাতেই ভেঙে পড়ল লঝঝরে কাঠামো। বিগত ৭০ বছরে এমন বিপর্যয় দেখেনি গোটা বিশ্ব। তাই এক নিমেষে ব্যর্থ দেশের তালিকায় ঢুকে পড়ল শ্রীলঙ্কা। অভিভাবক করে জনতা জনার্দন ক্ষমতায় এনেছিলেন যাঁদের, একে একে পিঠটান দিতে শুরু করেছেন সকলে। ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়ে রয়েছেন প্রজারা। ধ্বংসস্তূপকে এখনও আকার দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা। তার মধ্যেও জেগে রয়েছে রাজনীতি। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টা চলছেই।

হেঁশেলে চাল বাড়ন্ত দেখেই অশনি সংকেত পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার মানুষ। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধির বন্ধনীতে ফেলে পরিস্থিতিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছিল সেদেশের সরকার। ফলে অচিরেই নেমে এসেছিল অন্ধকার। সোনার দরে বিকোতে শুরু করে চাল, ডাল। মহার্ঘ হয়ে ওঠে শিশুকে খাওয়ানোর দুধও। ফলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় ছিল না সাধারণের। তাতে সাময়িকভাবে ঠেকানো গিয়েছিল বিপর্যয়। সিংহাসনে রদবদল ঘটিয়ে ক্ষোভ সামাল দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে মাত্র, বাদবাকি কিছু যে পাল্টায়নি, বোঝ গেল তিন মাস পরই। ফলে ফের রাস্তায় শ্রীলঙ্কার মানুষ।

গত সপ্তাহ থেকেই শ্রীলঙ্কায় নতুন করে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে অশান্তি। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে রাতারাতি গা ঢাকা দেন দেশের প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, বোঝা গেল রাত কাটতেই। হাজার হাজার মানুষ প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে এসে হাজির হলেন। পুলিশি বাধা কাটিয়ে, ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। টাকা-পয়সা কিছু ফেলে গিয়েছেন কি না সন্ধান চলল। আগুন ধরানো হলো প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব বাড়িতে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হওয়া নিয়ে সন্ধিহান দেশের একাংশই।

কারণ পদত্যাগ করতে প্রস্তুত বলে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে। কিন্তু কবে পদত্যাগ করবেন, তা খোলসা করেননি এখনও। বরং জনগণের নিরাপত্তাকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গড়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। সেই মর্মে বৈঠকে বসে দেশের একাধিক দল। তাতে নিমরাজি হয়েছে সবপক্ষই। আরও একদফা আলোচনায় বসার কথা তাদের। রাজাপক্ষে পদত্যাগ করেল কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। আর এতেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকে। রাজনীতির মারপ্যাঁচে সাধারণ মানুষ আগের মতোই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে থাকবেন বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, অস্থির সময় অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রিত্ব যাঁর হাতে থাকবে, তিনিই আপনাআপনি প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবেন, অন্তত দেশের পার্লামেন্ট নতুন করে ভোট দিয়ে নয়া প্রেসিডেন্ট বেছে না নেওয়া পর্যন্ত। রনিল যদি ইস্তফা না দেন, তিনিই অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হবেন। আর গোতাবায়া এবং রনিল দু’জনেই ইস্তফা দিলে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালাবেন পার্লামেন্টের স্পিকার মহিন্দা ইয়াপা। দলের অনুরোধে তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত বলে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন রনিল। কিন্তু তিনি পদত্যাগ না করলে, কী হবে, তা ভেবেই আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। তাঁদের আশঙ্কা, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে যে কোনও মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তাই সর্বদলীয় সরকারের ‘ললিপপ’ দেখিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা চলছে বলে মত গণআন্দোলনের নেতা পিচার ডি’আলমেইডার।

নিমরাজি হলেও, এই সর্বদলীয় সরকার গড়ার প্রস্তাবে আপত্তি রয়েছে বিরোধী শিবিরের অনেকেরই। তাঁদের মতে, এই মুহূর্তে দেশে ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে রাজাপক্ষেদের দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশের প্রধান বিরোধী দলের আসন-সংখ্যাই মেরেকেটে ৫০। এমন পরিস্থিতিতে কম সাংসদ রয়েছে, এমন দল থেকে কাউকে অথবা নির্দল কোনও সাংসদকে ক্ষমতায় বসানো হলে তাঁকে কেউ মানবেন না। আবার আদৌ এমন কাউকে ক্ষমতায় বসাতে দেওয়া হবে না, ফলে আগের মতোই মসনদে রাজাপক্ষেদের আধিপত্য কায়েম থাকবে বলে মনে করছেন বিরোধীদের অনেকে। একই সঙ্গে রাজাপক্ষেদের ওপরই যেহেতু বিক্ষুব্ধ দেশের মানুষ, নির্দিষ্ট করে গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবি করছেন তাঁরা, সেখানে সর্বদলীয় সরকারে শামিল হয়ে মানুষের বিরাগভাজন হওয়া থেকে পৃথকভাবে জনগণের আস্থা অর্জন করা ঢের ভাল বলে মত বিশেষজ্ঞদের। শুধু তাই নয়, সংকটের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া না গেলে পূর্বতন রাজাপক্ষে সরকারের ব্যর্থতার দায়ও তাদের ঘাড়ে চাপবে বলেও আশঙ্কা করছে কেউ কেউ।

বিজিত, পরাজিত সব দলকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গড়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের রায়ে যে দল ক্ষমতা দখল করে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাইরে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁরা কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ, তার নিরিখে তাদের যোগ্যতা যাচাই করতে পারেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে যোগ্যতা প্রমাণের দায়বদ্ধতা থাকে না। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে আগেও সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রনিল। সেবারও জল গড়ায়নি।

তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত সপ্তাহেই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা সরকার। আর তারপরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস, লরি, ট্রেনে চেপে রাজধানী কলম্বোয় এসে পৌঁছন লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দখল নিয়েছেন তাঁরা। জ্বালিয়ে দিয়েছেন রনিলের নিজস্ব বাড়ি। এই মুহূর্তে দেশের ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ চরম অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছেন। খাদ্যস‌ংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে রাজকোষে সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা শূন্যে এসে ঠেকেছে। ফলে নিত্য পণ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কা কোনও দেশ থেকে কিছু করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের সঙ্গে এখনও আলোচনা চালিয়ে চলেছে কলম্বো। তাদের কাছ থেকে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে শ্রীলঙ্কা, যাতে দেশে স‌ংকট কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যায়। তাই যত শীঘ্র সম্ভব সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে সরকারের ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি, সর্বনাশা কর নীতি এবং সর্বোপরি কোভিডের প্রকোপে পরিস্থিতি আরও হাতের বাইরে চলে যায়। ছাঁটা চালের দামই ২৫০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শিশুর দুধের দাম বেড়ে হয় ১৯০০ টাকা প্রতি কেজিতে। তেলের দাম পৌঁছয় ৮৫০ টাকা। তাতেই বিক্ষোভে নেমেছেন মানুষ।


More Articles