বোমা-রকেটে ছারখার গাজা! কেন পিরিয়ড বন্ধের ওষুধ খুঁজছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মহিলারা!

Gaza Women Period Control : যে কয়েকটি দোকান ও ফার্মেসি খোলা আছে সেখানে পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড নেই। জলের অভাব চরম।

বাড়ি নেই, পরিবারের অনেকেই মৃত, নিজের জীবনের কোনও ঠিক নেই। প্রতিটা রাত অনিশ্চিত। শিশুর লাশ গুনছে কবর হয়ে যাওয়া গাজা উপত্যকা। একটা যুদ্ধ কতভাবে মানুষের জীবন বদলে দেয়, ছোট বড় ক্ষেত্রে, গাজাকে দেখে নতুন করে যেন বুঝছে বিশ্ব। শরণার্থী শিবিরেও বোমা পড়ছে, হাসপাতালেও। মাটির নীচেও বিস্ফোরণ! কোথায় লুকোবে মানুষ? এরই মধ্যে অনেক ফিলিস্তিনি মহিলাই মরিয়া হয়ে ঋতুস্রাব পিছিয়ে দেওয়ার ওষুধের আশ্রয় নিয়েছেন। গাজায় ইজরায়েলের অব্যাহত বোমাবর্ষণে নিজেকে বাঁচানোর জায়গাই নেই, ব্যক্তিগত পরিসর তো দূর অস্ত। অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে নিজেকে একটু সুস্থ রাখতে তাই পিরিয়ডস পিছিয়ে দিচ্ছেন মহিলারা।

বাস্তুচ্যুত মহিলাদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে কোনও শিবিরে। সেখানে বাঁচার মৌলিক সম্পদেরই অভাব। এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং ট্যাম্পনের চরম অভাব, নেই জল এবং শৌচাগারের সুবিধাও। এই পরিস্থিতিতে মহিলারা নোরেথিস্টেরন ট্যাবলেট খেতে শুরু করেছেন। সাধারণত পিরিয়ডসে বেশি রক্তপাত হলে, এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে, ঋতু চলাকালীন ব্যথা হলে, বা ঋতুস্রাবের সাধারণ অস্বস্তি এবং যন্ত্রণা এড়াতে এই ওষুধ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- গাজায় নিথর ৩,৫০০ শিশু! বেঁচে থাকা সন্তানদের গায়ে নাম লিখে রাখছেন কেন মা-বাবারা?

দক্ষিণ দিকের শহর খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ওয়ালিদ আবু হাতাব জানাচ্ছেন, এই ট্যাবলেটগুলি প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। ঋতুচক্রকে বিলম্বিত করে। তবে এই ওষুধের ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যোনিপথে অনিয়মিত রক্তপাত, বমি বমি ভাব, ঋতুচক্রের পরিবর্তন, মাথা ঘোরা এবং মেজাজের পরিবর্তনের মতো একাধিক সমস্যায় ভুগতে হতে পারে মহিলাদের। তবে বোমাবর্ষণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মহিলারা জানাচ্ছেন, এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তাঁদের কাছে কোনও বিকল্প নেই।

গাজার বাসিন্দা সালমা দুই সপ্তাহ আগেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখন মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহ শরণার্থী শিবিরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ৪১ বছর বয়সি সালমা জানাচ্ছেন, ক্রমাগত ভয়, অস্বস্তি এবং বিষণ্নতা ঘিরে ঘরছে তাঁকে। এই পরিস্থিতি তাঁর ঋতুচক্রের উপরও প্রভাব ফেলেছে। এই যুদ্ধের সময়ই জীবনের অন্যতম কঠিন পিরিয়ডসের মুখে পড়েছেন তিনি। এই মাসে দু'বার পিরিয়ডস হয়েছে তাঁর, যা মোটেই স্বাভাবিক নয় এবং প্রচুর রক্তপাতও হয়েছে।

সালমা জানাচ্ছেন, যে কয়েকটি দোকান ও ফার্মেসি খোলা আছে সেখানে পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড নেই। জলের অভাব চরম। একই বাড়িতে প্রায় ১৫ জন রয়েছেন। সেখানে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধিও যেন বিলাসিতা। কয়েকদিন অন্তর অন্তর শৌচালয় ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেখানে সুরক্ষিত পিরিয়ডসের জন্য অধিক জল ব্যবহার করাও বিলাসিতা। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের পর ইজরায়েল গাজাতে ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহও বন্ধ করে দেয়। গাজা উপত্যকার প্রধান রাস্তাগুলিতে ইজরায়েলের বোমাবর্ষণ হওয়াতে পণ্য পরিবহনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এই পরিস্থিতিতে ঋতুস্রাব আটকানো বা পিছিয়ে দেওয়ার ওষুধ খাওয়া ছাড়া গাজার মহিলাদের কোনও উপায় নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিনের চাহিদা থাকায় তা পাওয়া মুশকিল কিন্তু পিরিয়ড দেরি করানোর ট্যাবলেট বেশ কিছু ফার্মেসিতেই পাওয়া যায় কারণ সেগুলি সাধারণত কম ব্যবহৃত হয়। শরীরের উপর ট্যাবলেটের সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন সালমা জানাচ্ছেন, তিনি তবু আশা দেখেন যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে। তাঁকে একবারের বেশি এই ট্যাবলেট খেতে হবে না।

আরও পড়ুন- ২০ দিনে ৩,৩০০ শিশুর মৃত্যু! কেন এত শিশু মারা যাচ্ছে গাজার যুদ্ধে?

৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে অল্প জায়গায়, অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে থাকছেন তারা। গোপনীয়তার কোনও জায়গা নেই। ইজরায়েলি আক্রমণের ২৫ দিন অতিক্রান্ত। ৮,৫০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজা শহরের মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী নেভিন আদনানের মতে, মহিলারা সাধারণত তাদের পিরিয়ডের আগের দিন এবং পিরিয়ড চলাকালীন মানসিক এবং শারীরিক লক্ষণগুলি টের পেতে থাকেন, মেজাজের পরিবর্তন ঘটে, তলপেটে পিঠে ব্যথা হয়।

আদনানের মতে, যুদ্ধের মতো চাপের পরিস্থিতিতে এই লক্ষণগুলি আরও খারাপ হতে পারে। বাস্তুহারা হওয়ার মতো ঘটনা চরম চাপ সৃষ্টি করে এবং তা মহিলার শরীর এবং হরমোনকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও ঋতুস্রাবের সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরিক লক্ষণগুলিও বাড়তে পারে যেমন পেটে এবং পিঠে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ফোলাভাব। অনিদ্রা, নার্ভাসনেস এবং চরম উত্তেজনাও অনুভব করতে পারেন মহিলারা। সাধারণ পরিস্থিতিতে এই ট্যাবলেটগুলি খাওয়ার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ কর অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল সব গুলিয়ে গেছে।

গাজার বাসিন্দা সামিরার মেয়ের কয়েক মাস আগেই প্রথম পিরিয়ডস হয়। এই অবস্থাতেই যদি তাঁকে পিরিয়ড বন্ধের ওষুধ খেতে হয় তাহলে তা তাঁর স্বাস্থ্যের উপর কঠিন প্রভাব ফেলতে পারে। এই ওষুধের নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সব মহিলাই জানেন। কিন্তু তারা এও জানেন, চারপাশে ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ, মৃত্যু এবং ধ্বংসের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক কোনও ট্যাবলেট হতে পারে না।

More Articles