নতুন করে হিংসা বাংলাদেশে! মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল কারা?
Bangladesh 32 Dhanmondi: হঠাৎ করে কেন ঠিক ৬ মাসের মাথায় নতুন করে এই ক্ষোভ প্রকাশ? ইউনূস একদিকে বলছেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ চলছে। তাহলে কি গত ৬ মাসে একটুও এগোয়নি বাংলাদেশ?
নতুন করে অশান্ত বাংলাদেশ। অথবা, বাংলাদেশ হয়তো গত ৬ মাসে আসলে শান্তই হয়নি। হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এখনও ততখানিই উগ্র। সেই ক্ষোভের প্রকাশ এখনও ততখানিই বিধ্বংসী। শেখ হাসিনা-বিরোধীদের ক্ষোভে প্রায় গুঁড়িয়ে গেল ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িখানি। বুধবার, ৫ জানুয়ারি রাতে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে শেখ মুজিবুর স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে জনতা। ছাত্র জনতা ধানমন্ডির বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালাতে থাকে। এই ক্ষোভের নেপথ্যে রয়েছে শেখ হাসিনার একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য। এই বাড়িতেই পাঁচ দশক আগে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির এই বাড়িটিকে সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলেন।
গত জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে, ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাত ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজনা চরমে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক ছাত্র-জনতা এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা ফেসবুকেই ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে ‘বুলডোজার মিছিল’ এবং ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ কর্মসূচির ডাক দেন। সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহও ফেসবুকে একটি পোস্ট করে লেখেন, “আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।”
রাতে অনলাইনে এক ভাষণে হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশকে নিয়ে ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ছিল, উন্নয়নের বিস্ময় ছিল। সেই বাংলাদেশকে চরম ভাবে ধ্বংস করে জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের দেশ হিসাবে পরিণত করা হয়েছে।" হাসিনার অভিযোগ, বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন আসলে একটি ‘ষড়যন্ত্র’ ছিল। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওই ভাষণে বলেন, “লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে সংবিধান, স্বাধীনতা, পতাকা পেয়েছি— তা কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না। এ শক্তি তাঁদের এখনও হয়নি। এটি তাঁদের দুর্বলতার প্রকাশ। তাঁরা দালান ভাঙতে পারে কিন্তু ইতিহাসকে ধ্বংস করতে পারে না। ইতিহাস যে প্রতিশোধ নেয়। এ কথা তাঁদের মনে রাখতে হবে। যাঁরা এ সব করছেন, তাঁরা হীনম্মন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁদের হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা পছন্দ নয়। পাকিস্তানিদের অধীনে থাকা এবং পদলেহন করাটাই হয়তো তাঁদের পছন্দ।”
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী: শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা
যখন এই কথাগুলি বলছেন হাসিনা, তখনই ভিড় বাড়তে শুরু করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে। স্বৈরাচারী শাসক, ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে থাকেন তারা। এই বিক্ষোভের উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছতেই বিক্ষোভকারীরা ওই বাড়ির সদর দরজা ভেঙে ফেলেন, ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে দেন। কিছু জায়গায় আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই বাড়িতে গত অগাস্টেও হামলা চলেছিল। সেই থেকে বাড়িটি পরিত্যক্তই ছিল বলা যায়। সেই বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। মুজিবের স্মৃতি মুছে ফেলার কোনও পথই বাদ রাখছেন না 'নতুন বাংলাদেশের' বিক্ষুব্ধ জনতা। শুধু এই বাড়িটিই নয় ধানমন্ডির ৫/এ-তে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর যা ঘটেছে, সেই নজির গত অগাস্টেই দেখেছে বিশ্ব। বাড়িতে হামলা করে সেই বাড়ির যাবতীয় জিনিস তুলে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ৩২ নম্বরের এই বাড়ির ভেতর থেকে বই, স্টিল, লোহা, টিন, কাঠসহ বিভিন্ন জিনিস ভেঙে নিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নিয়ে যাচ্ছেন বইও! বেশিরভাগ বই শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা কিংবা পরিবারের সদস্যদেরই লেখা। কিন্তু হঠাৎ করে কেন ঠিক ৬ মাসের মাথায় নতুন করে এই ক্ষোভ প্রকাশ? ইউনূস একদিকে বলছেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ চলছে, অন্যদিকে এই হিংসার চিত্র! তাহলে কি গত ৬ মাসে একটুও এগোয়নি বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের হাসিনা বিরোধীদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের যে সদস্যরা বাংলাদেশে আছেন, তারা নানাভাবে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে হেনস্থার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এতে মদত জোগাচ্ছেন হাসিনাই। অগাস্ট অভ্যুত্থানের পর ভারতে পালিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। অভিযোগ, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও সামান্য নত হননি মুজিব কন্যা। উল্টে দেশবাসীদেরই ক্রমাগত দায়ী করে গেছেন তিনি। আওয়ামী সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকারের জনসংযোগ উপদেষ্টার মেয়ের ছবি বিকৃত করে প্রচার চালাচ্ছে। এই সমস্ত কিছু নিয়েই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আছড়ে পড়ল ৫ ফেব্রুয়ারি। তবে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ কি শেষ হয়ে গিয়েছে? নির্বাচনের ঘোষণার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই অবস্থায় কি আবারও এমন আগ্রাসন খুব জরুরি ছিল? বাংলাদেশের হাসিনা বিরোধী গোষ্ঠী খুব স্পষ্টভাবেই বার্তা দিতে পেরেছে বিশ্বকে যে তারা মুজিবের পরিবারের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতার বিরোধী এবং তারা এই পরিবারের ইতিহাসকেই নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। এই মুহূর্তে হাসিনাও সেই দেশে নেই। নতুন নির্বাচন এই মুহূর্তে সেই দেশের আশু প্রয়োজন। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজের মধ্যে নতুন করে হিংসাকে কেন প্রকট করে তুলছেন হাসিনা বিদ্বেষীরা?
আরও পড়ুন- ৫০ বছর পর প্রকাশ্যে মুজিবের হত্যাকারী মেজর ডালিম! ফিরবেন বাংলাদেশে?
৬ মাস অতিক্রান্ত করেও কি তাহলে বাংলাদেশে সেই তিমিরেই বাঁধা পড়ে রয়ে গেল? সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বিষয়ক অভিযোগ, অন্যান্য দেশ এবং ভারতের সঙ্গে জটি কূটনৈতিক সম্পর্ক, নির্বাচনের অনিশ্চয়তা ঢাকতেই কি তাহলে হিংসাকে আবারও আশ্রয় করছে বাংলাদেশ? বাংলাদেশে জরুরি পণ্যে হঠাৎ ভ্যাট বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া বৃদ্ধির থেকে নজর ঘোরাতেই কি আবারও মুজব পরিবারকে সামনে আনা দরকার হয়ে পড়ল? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সেই ইতিহাসকে কেন বারবার আক্রমণ? যদিও, এই বিক্ষোভ ও হিংসার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই বলছেন, ধানমন্ডির এই বাড়ি আসলে ফ্যাসিবাদের প্রতীক। এই বাড়ি বা এই পরিবারকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্কই নেই। এই চিহ্নকে ধ্বংস করে তারা পরবর্তী প্রজন্মকে বার্তা দিতে চান যে শাসক অহংকারী হলে তার ভবিতব্য কী হয়! উল্লেখ্য, রাতে যখন ধানমন্ডির বাড়িতে তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, তখন ঢাকার চারপাশের অন্য এলাকা কিন্তু শুনশান। নীলখেত, মীরপুর, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজু শিল্পকলা, রমনা অঞ্চল একেবারে শান্ত যেন কিছুই হয়নি। তাহলে পরিকল্পনামাফিক, সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘোষণা করে যারা এই হামলা চালালেন, বাংলাদেশকে নতুন করে উত্তপ্ত করলেন, তাঁদের কি চিহ্নিত করবে অন্তর্বর্তী সরকার? ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই স্থিতাবস্থায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য? এই হামলার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলছেন, "ফ্যাসিবাদের চিহ্ন বিলোপের সাথে সাথে খুনী হাসিনাসহ গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।"
বিএনপি নেতা এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান বলছেন, শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন থেকেই কোনও প্রমাণ ছাড়াই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়ী করেছিলেন। লিখেছেন "ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ৫ অগাস্টের পর ছাত্র-জনতা একটা হাতও দেয় নাই। সেই বাড়ির সামনে ব্যারিকেড পর্যন্ত দিয়ে রাখা হয়েছিল। ছাত্র-জনতা তখনই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যখন শেখ হাসিনার মতো একটা খুনি লাইভে ভাষণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এইটা স্পষ্টতই একটা প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়াকে যারা ক্রিয়া হিসেবে দেখাতে চায় এরা ছাত্র-জনতার শত্রু। এই শত্রুদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে এরাই আপনাদের ভিলেন বানিয়ে ছাড়বে।" তাহলে কি এই হামলায় প্রচ্ছন্ন ভূমিকা থাকছে বিএনপির? নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ প্রশ্ন তুলছেন, মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী জামাত কি এই অন্তর্ঘাতের পিছনে রয়েছে? প্রশ্ন অনেক, নতুন বাংলাদেশ কি এর উত্তর জানে?