গাজায় নিথর ৩,৫০০ শিশু! বেঁচে থাকা সন্তানদের গায়ে নাম লিখে রাখছেন কেন মা-বাবারা?

Gaza Children Death : গাজার অনেক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, নিহত ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহে যে পোড়া আঘাত তারা দেখেছেন তা দেখে বোঝা যাচ্ছে ইজরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করছে।

যুদ্ধ লাগা দেশের মানুষ কীভাবে বাঁচে? এই উত্তর পৃথিবীর যে কোনও আপাত শান্ত কোণে বসা মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব আদৌ? বোঝা সম্ভব মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মানুষ কী কী পরিকল্পনা করে? যুদ্ধে সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে বাঁচা, অথবা মৃতপ্রায় মানুষ আসলে কীভাবে নিজের, স্বজনের মৃতদেহের পরিকল্পনা করে, কখনই কি সম্ভব বোঝা? গাজার এই প্রায় সাড়ে ৮০০০ মানুষের কথা বাকি বিশ্ব কতটাই বা অনুভব করতে পেরেছে, বেঁচে থাকা মানুষের যন্ত্রণাও কি ঠিক সেভাবে অনুভূত হবে? যদি হতো, বিস্ময়ে মাথা খাঁ খাঁ হয়ে যেত, লজ্জায়, ঘৃণা মাথা নত হয়ে যেত এই দেখে যে জ্যান্ত সন্তানের শেষকৃত্যের পরিকল্পনা করে রাখছে মা-বাবারা। গাজার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মৃত শিশুর অধিকাংশকেই চেনার মতো অবস্থা নেই। যাতে মারা গেলে অন্তত চেনা যায়, শিশুর দেহে নাম লিখে রাখছেন মা-বাবারা। যুদ্ধ মানুষকে দিয়ে ঠিক কী কী করিয়ে নেয়, বিশ্ব কি জানে?

ইজরায়েলি বোমার আঘাতে নিরন্তর কেঁপে উঠছে গাজা। যে প্রায় ৮,৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। সারা আল-খালিদি নিজের চার সন্তানকে নিয়ে গাজা শহরের তাল আল-হাওয়া এলাকায় নিজেদের বসার ঘরের মেঝেতে একে অপরকে জড়িয়ে বসেছিলেন। ভয়ে কাঁপতে থাকা পাঁচখানি দেহ। সারা রাত বিস্ফোরণ থামেনি, এলাকা জুড়ে যেন আগুনের বলয়। সেই মুহূর্তে সারা আল-খালিদি ভেবেই নিয়েছিলেন, বাড়িতে একটা বড় বোমা এসে পড়লেই বাচ্চারা মারা যাবে। তিনিও মরে যাবেন এবং কেউ তাঁদের শনাক্ত করতে পারবে না।

আরও পড়ুন- ২০ দিনে ৩,৩০০ শিশুর মৃত্যু! কেন এত শিশু মারা যাচ্ছে গাজার যুদ্ধে?

সেই রাতে পরিবারটি বেঁচে যায়। পর দিন দক্ষিণে খান ইউনিসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান তারা। সেখানে গিয়ে দেখেন, ওই আত্মীয়রা তাঁদের সন্তানদের শরীরে নিজেদের নাম লিখে রাখছেন। অবাক হয়ে যান সারা। কাঁদবেন, না নাম লিখে রাখবেন- কোন পথে যাবেন একজন মা? আল-শিফা হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে বাচ্চাদের শরীরে তাঁদের নাম লিখতে দেখে সারা বোঝেন, নাম লেখা দরকার। সারা বিশ্ব জানুক, শিশুর লাশ কেবল সংখ্যা নয়। ইজরায়েল যে শিশুদের হত্যা করছে তারা কেবল সংখ্যা নয়, তারা নাম, তারা এক একটা কাহিনি, তারা স্বপ্ন, গাজায় ইজরায়েলি দখলদারিত্বে খুন হয়ে যাওয়া স্বপ্ন।

গত চার সপ্তাহ ধরে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলের নিরলস বোমাবর্ষণ চলছে। হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান অভাবনীয়। প্রায় ৩,৫০০ শিশু সহ ৮,৩০০-রও বেশি ফিলিস্তিনি মানুষ নিহত হয়েছেন। আরও কম করে ১,৭০০ ফিলিস্তিনির দেহ তাদের বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। আটকে পড়া মানুষদেরও অর্ধেকই শিশু।

 

ইজরায়েল গাজায় সমস্ত যোগাযোগ পরিষেবাও বন্ধ করে দেয়। বিশ্ব থেকে আড়াল করে শুরু হয় ভয়াবহ হামলা। জ্বালানি, পানীয় জল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইজরায়েল। ২০০,০০০-রও বেশি আবাসন আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানাচ্ছে, ১.৪ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি অর্থাৎ গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ফিলিস্তিনিরা কোথাওই নিরাপদ নন কারণ নির্বিচারে বোমা হামলা পুরো গাজাকেই গুঁড়িয়ে দিতে চলেছে।

শিশুদের বাহুতে বা পায়ে শিশুদের নাম লেখা হলে যদি এই শিশুরা মারা যায় তাহলে পরিবারগুলি অন্তত তাঁদের চিনতে পারবে। গণকবরের বদলে নির্দিষ্ট কবরে আদরের সন্তানকে রেখে আসতে পারবে। শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য নয়, খেলা নয়, একজন সন্তানকে নিয়ে শেষে এই পরিকল্পনা করতে হচ্ছে অভিভাবকদের!

আরও পড়ুন- জলপাই ক্ষেতে ছিটকে উঠল কৃষকের রক্ত, আর কত বিলালের নিথর দেহ দেখে থামবে ইজরায়েল?

গাজার অনেক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, নিহত ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহে যে পোড়া আঘাত তারা দেখেছেন তা দেখে বোঝা যাচ্ছে ইজরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করছে। ইজরায়েলি বিমান হামলায় মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে স্বজনরা দেহ শনাক্ত করতেও পারছেন না। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক নিহত ফিলিস্তিনিদের নামের একটি ২১২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন বলছে, ২০০টি এমন মৃতদেহ রয়েছে যা শনাক্ত করাও যাচ্ছে না।

গাজার বাসিন্দা মহাম্মদ আবু ওদেহ ২০২১ সালের মে মাসে আক্রমণের সময় নিজের দুই সন্তানকে তাঁর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং ভাইয়ের দুই সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে তাদের একটি বাড়ি ইজরায়েল শেষ করে দিলে অন্য পরিবারের কেউ অবশিষ্ট থাকে। এবারের যুদ্ধে আবু ওদেহ নিজের সন্তানদের সঙ্গেই রেখেছেন তবে তাদের হাতে এবং পায়ে নাম লিখে দিয়েছেন।

"আমার বাচ্চারা যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি এরম কেন করছি, আমি ওদের বলি, তোমাদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্যই। আমাদের সন্তানরা কীভাবে আছে তা কি বিশ্বের কেউ কখনও বুঝতে পারবে?” প্রশ্ন আবু ওদেহর। একজন অভিভাবক হিসাবে সবচেয়ে খারাপ ঘটনার জন্যই নিজেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত করে চলেছেন এমন অজস্র মা-বাবা। তারা বলছেন, বাচ্চাদের নাম তাদের শরীরে লেখাই একমাত্র সমাধান যাতে বিশ্ব জানতে পারে যুদ্ধ, জমি দখল আসলে কোন কবরখানায় নিয়ে আসে সভ্যতাকে। শুধু অভিভাবকরা নন, এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা কিশোর-কিশোরীরাও বলছে, যে শিশুরা বোমা হামলা থেকে বেঁচে গেছে তারা প্রায়শই এমন 'শক' পেয়ে থাকে, এমন ভয়ে থাকে যে কথা বলতেও পারে না। তাই নাম লেখা থাকে গায়ে, যাতে বিশ্ব জানতে পারে, এরা গাজার হতভাগ্য সন্তান।

More Articles