অভিমানে আজীবন বিয়েই করলেন না, লতার প্রেমকাহিনি আজও চোখে জল আনবে

একটা গোটা দেশ শোকস্তব্ধ। গান এমনই এক শিল্প, বহু কষ্টের মধ্যেও মানুষ গান শোনে, গায়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নানা ভাষাভাষীর মানুষ, যাঁরা হয়তো একের ভাষা অপরে বোঝেন না, সবাই শোকস্তব্ধ। কারণ লতা মঙ্গেশকর এমনই একটি নাম, যাঁর গানের সঙ্গে প্রতিটি ভারতীয়র জীবন জড়িয়ে আছে। প্লাটফর্মের কাঠের বেঞ্চ থেকে সুউচ্চ ইমারত–যাবতীয় সীমা পেরিয়ে গিয়েছে তাঁর কণ্ঠ অনায়াসে। 

সুরের জগতের সম্রাজ্ঞী বলা হয় যাঁকে, ভাগ্যচক্রে তিনি হয়তো বাস্তবেও সাম্রাজ্ঞী বলে পরিচিত হতে পারতেন। কিন্তু একটি ভাবের জগত অপরটি বস্তুর। একটির বাধা অতিক্রম যাও বা চেষ্টায় সম্ভব, অপরদিকে কঠিন বাস্তবের থাকে কিছু কঠিন হিসেব। ভাই হৃদয়নাথের প্রিয় বন্ধু তখন রাজ সিং। দুঙ্গারপুরের যুবরাজ। রাজস্থানের হয়ে ক্রিকেট খেলেন। মিডিয়াম পেস বোলার। গান ভালোবাসেন পাগলের মতো। অনেকেই হয়তো জানেন না, লতা অত্যন্ত ক্রিকেটভক্ত। এই ছিল ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত।

বিকানেরের রাজকন্যা রাজশ্রীর আরেকটি পরিচয় তিনি রাজ সিং-এর ভাইঝি। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্যালেস অফ ক্লাউডস্‌—আ মেমোয়ার’-এ এই সম্পর্কের কথা লিখেছেন রাজশ্রী। রাজস্থানের দুঙ্গরপুর রাজবাড়ির ছোট ছেলে রাজ সিং ১৯৫৯ সালে আইন  পড়তে গিয়েছিলেন মুম্বই। ক্রিকেটে অত্যন্ত চৌখশ। সেই ক্রিকেটের মাঠেই হৃদয়নাথের সঙ্গে আলাপ। হৃদয়নাথও ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন পাগলের মতো। ধীরে ধীরে হৃদয়নাথের বাড়িতেও যাতায়াত বাড়তে লাগল রাজ সিং-এর। একদিন ক্রিকেটের পরে বন্ধুর বাড়িতে বসে চা খাচ্ছেন, তখনই প্রথম আলাপ লতার সঙ্গে। রাজশ্রী লিখছেন এই আলাপই ক্রমে বন্ধুত্বের পথ ঘুরে প্রেমে পরিণত হয়েছিল।

আরও পড়ুন-জীবনযাপনে ছোট্ট বদল, আমার আপনার থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচেন জাপানিরা

আদর করে লতাকে ‘মিঠু’ বলে ডাকতেন রাজ। পকেটে সবসময় একটা টেপ রেকর্ডার থাকত। তাতে ভর্তি সব লতার গান। “ইয়ে মেরে আন্ধেরে উজালে না হোতে আগর তুম না আতে মেরে জিন্দেগি মেঁ” থেকে “জো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পড়েগা”, “নয়না বরসে রিমঝিম রিমঝিম” থেকে “রাত অউর দিন দিয়া জলে” — পূর্বরাগ, অনুরাগ, বিরহ — কখনও সলিল, কখনও মদন মোহন, কখনও হাসরত জয়পুরি কখনও রাজা মেহদি আলি খান—কথায় সুরে কেটে যাচ্ছে অবিরত। জীবন, গান, পড়াশোনা প্রেম। সবকিছুর মাঝে একটি টেপ রেকর্ডার, তাতে মিঠুর আওয়াজ। 

তবে সমস্ত স্বপ্ন একসময় শেষ হয়। পড়াশোনা শেষ করে দুঙ্গরপুর ফিরে গেলেন রাজ সিং। বিয়ের কথা ভাবছেন ততদিনে দুইজনই। মনে একরাশ ইচ্ছে নিয়ে পরিবারের কাছে কথাটা পাড়লেন রাজ। কিন্তু না। স্বপ্ন আর সত্য–সুইয়ের মধ্যে বহু অনুভবের পার্থক্য, ব্যক্তি থেকে সমষ্টির পার্থক্য। যদিও লতা সে সময় খ্যাতির শীর্ষে তবু তিনি তো আর রাজবংশজাত নন। তাঁকে বিয়ে করলে নাকি রাজ সিং-এর পরিবারের সম্মানে চোট লাগবে। রাজি হল না দুঙ্গরপুরের রাজপরিবার। সম্মানের বোঝা ঠেলতে গিয়ে একটা সম্পর্কের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হয়ে গেল। পরিবারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে লতাকে বিয়ে করার সাহস ছিল না রাজ সিং-এর। কাজেই বিয়ে হল না। কিন্তু এই স্বৈরাচারের প্রতিবাদ দুজনেই করলেন নিজস্ব পদ্ধতিতে। সারাজীবন বিয়ে করলেন না কেউই। লতাকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, পরিবারের বড় সন্তান, পরিবারটাকে তো দেখতে হবে। দায়িত্ব অনেক। তাই আর বিয়েটা করে ওঠা হল না। এই লুকোচুরির ছায়ায় কাটতে লাগল বাকি বছরগুলো।

আরও পড়ুন-বিদায়ের বিষাদে ফিরে দেখা ভারতের নাইটিঙ্গলের জীবন

সম্পর্ক পরিণতি পেল না তবে বন্ধুত্ব অটুট থাকল। এই পরিসরে কোনও বাধানিষেধ তাঁদের ঠেকাতে পারেনি। একে অন্যের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন। ইতিমধ্যে ১৯৮৩-তে ভারত বিশ্বকাপ জিতল। রাজ তখন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ম্যানেজার। ক্রিকেট ক্লাব অফ ইণ্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন দীর্ঘ ১৩ বছর। ক্রমে বি সি সি আই-এর প্রেসিডেন্ট হলেন, পরপর দুইবার। ক্রিকেটপ্রেম লতার অক্ষুণ্ণ রইল। একের পর এক পুরস্কারে তখন সম্মানিত হচ্ছেন লতা। নিজেদের জীবনে দুইজনেই সম্মৃদ্ধ। দুজনেই স্মরণীয় হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছেন। তুল্যমূল্য ভাবে লতাই যে বেশি তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই অর্জনের কাছে কোনো এক রাজপরিবারের ‘বংশজাত’ সম্মান কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। তাদের মনে রাখেনি দেশ, দেশের সাধারণ মানুষ। তারা শুধুমাত্র এখন এই গল্পের সাক্ষ্য দিতে আসে। মানুষ তাঁদের মনে রাখবে যারা সুরের সম্রাজ্ঞীকে চিনতে অস্বীকার করেছিল –শুধুমাত্র এই বলেই।

রাজ চলে গিয়েছিলেন আগেই। ২০০৯ নাগাদ। শোনা যায়, সে সময় লতা গিয়েছিলেন দুঙ্গরপুর। নিঃশব্দে প্রিয়তমকে বিদায় জানাতে। শেষ দেখা দেখে আসা। আজ ভারতকে কাঁদিয়ে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন সুরের সম্রাজ্ঞীও। হয়তো এতদিনের পরিণতি না পাওয়া জাগতিক প্রেম এবার ঐশ্বরিক হওয়ার সময় এল। জীবনের দূরত্ব মুছে দিয়ে গেল মৃত্যুর ঢেউ–মহামানবের সাগরতীরে।

 

তথ্যঋণ–

Lata Mangeshkar passes away: Know her love story with former BCCI president Raj Singh Dungarpur and why they never got married, 2022. . APN News.

Raj Singh Dungarpur, 2021. . Wikipedia.

The immortal love story of Lata Mangeshkar and Raj Singh Dungarpur [WWW Document], n.d. . DNA India.

Untold love story of veteran singer Lata Mangeshkar, reason why she is still unmarried, 2019. . Odisha News, Odisha Latest news, Odisha Daily - OrissaPOST.

More Articles