এক বেপথুর এল ডোরাডো দর্শন
Return to the Roots: তাই কথা দিতে গিয়ে আমি প্রতিবার শিউরে উঠি। পরক্ষণেই হাত রাখি প্রায়শ্চিত্তের সহজপাঠে। সে পাঠ আত্মস্থ করে এক দিন কন্যার সঙ্গে উঠব হগওয়ার্ট্স এক্সপ্রেসে।
২০১৩, চিরতরে বরবিল ছেড়ে উঠে আসার ঠিক বিশ বছর পর আবার ফিরতি পথ ধরলাম। এক প্রকার অভিযাত্রিক হয়েই বোধহয়, দিন দুই। আফ্টার টোয়েন্টি ইয়ার্স, ও’হেনরি-র গল্প যেন। সঙ্গে সেবার কন্যা, স্ত্রী-ও ছিল। মুখে নিরন্তর বুলি ছিল, 'চ তোদের সেই রোদ্দুরটা দেখাব, যেটা ’৮৭-তে উঠত বিকেল ৪:১৩-য় বা ’৮৯-এর কোনও সেপ্টেম্বর সকালে' কিন্তু হাওড়া-বরবিল জনশতাব্দী যত আমার এককালের পরিচিত প্রান্তরে সেঁধিয়ে যেতে লাগল, কেমন আবছায়ার চৌহদ্দি ক্রমশ গ্রাস করল কথার রাজ্য, ভিতর ভিতর কুঁকড়ে গেলাম আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম পেরিয়ে যাওয়া রুক্ষ টিলা, ঘন সবুজ বনান্তের দিকে, যেন কী আশ্চর্য, অজানা এক মহল্লায় প্রবেশ ঘটছে আমার। এমন ভাবগতিক স্থায়ী হল অল্পক্ষণ, আই গেস, ঠিক তারপরই বুঝলাম অভিযাত্রিকই প্রকৃত আমি। উপড়ে যাওয়া শিকড়ের গভীর ক্ষতস্থল, প্রাক্তন কোনও রোদের অছিলায় প্রিয়জনেদের দেখাতে আনা, অভিযাত্রিকের অসম সাহস ছাড়া আসে না।
যে রেললাইন শৈশব থেকে আমার অস্তিত্বের সমান্তরাল রেখা হয়ে দিগন্তে গিয়ে মিলিয়েছে, যে লাইন পেরিয়ে আদিবাসীদের হাটিং পেরিয়ে একটা ঢাল বেয়ে বাঁ দিক গেলেই পমদের বাড়ি, খুকুমা-গোরাকাকু, কুট্টিকাকুদের বসত, যে লাইনে শুধুই মালগাড়ি চলত একদা, সেই লাইন বেয়েই সারান্ডার জঙ্গল কেটে ট্রেন সাময়িক বিরতি নিল আপন আস্তানায়, বরবিল স্টেশনে। কিন্তু ঈশ্বরেরও বোধহয় মায়া ধরে, গলার কাছটায় মনকেমন পাকায়, নইলে ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার মেরেকেটে দেড় সেকেন্ড ওভাবে মেঘের আড়াল করে দেন? কিছুটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি, ও মা! এই তো সেটা আর ওই তো ওটা, তা হলে আমাদের বাড়ি? তখনই মাথায় কেউ বলে, ছিল তো, এই মাত্র, ২০ বছরের ধুলোয় ধূসরিত, ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ফলে সে দিন দুই আমি, অভিমানী এক অভিযাত্রিক হয়েই এ দোর সে দোর ঘুরে মরলাম ধরাছোঁয়ার বাইরে ধরব বলে। হল অনেক কিছুই, যাওয়া-টাওয়া, পুরনো পথ চিনে, বাঁশপানি, মুরগা মহাদেব মন্দির, আমার স্কুল সেন্ট মেরি’জ, কিরিবুরু, এমনই একাধিক। যাওয়া হল কিন্তু আমি পৌঁছতে পারলাম কিনা, এখনও বুঝিনি। মানে সেই যে বার স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র, কোনও এক দিবসে, ঠিক মনে নেই আর, আমরা প্যারেড করলাম, স্কুলের ভেতরে প্রকাণ্ড মাঠে এক চোট, তারপর গেট দিয়ে বেরিয়ে আমরা চললাম টাউনের মধ্যে দিয়ে, বাজারের পাশ দিয়ে। পথের ধারে দাঁড়িয়ে আমাদের বাবা-মায়েরা, আরও কত জন। আমরা সবাই প্যারেড করছি, দেখছে গোটা বরবিল, সামনে বড় গোল্লা ড্রাম, কেটল ড্রাম বাজাতে বাজাতে চলেছে সিনিয়র দাদা-দিদি, আমরা তালে বা বেতালে পিছন পিছন। মাঝে একবার দেখি, কোনও এক বিব্রতজন স্কুটারের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সারেঙ্গী ডাক্তারকে, তখনও এমারজেন্সির মানে আমরা আর বুঝি কই! টাউনের হাওয়া যেন কোমল আস্তরণে ঢেকে রেখেছিল প্রিয় সন্তান-সন্ততিদের। গায়ে লাগেনি তাই বোধহয় অলক্ষুণে ছিঁটে। আউআউ পাগলও ছাতাপড়া দাঁত নিয়ে কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে খানিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছিল, তারপর কোথায় যে মিশে গেল, খুঁজে পাইনি। আসলে খুঁজতেই চাইনি তো। প্যারেড করতে করতেই আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল স্কুলে। সেখান থেকে তারপর বাবা-মা হোক বা পাশের বাড়ির আঙ্কল, নিয়ে নেবে আমাদের। কিন্তু এমন দু’চার জন তো ছিলই, যারা প্যারেড করতে করতে প্রায় বাড়ির সামনে দিয়েই পেরোচ্ছিল, ও মা! পিছন ফিরে দেখি, তারা হাওয়া। পাশে দাঁড়ানো কারও বাবা হয়তো লাইন থেকেই হাত ধরে, স্কুটারে চাপিয়ে…
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
এ সবই মনে পড়ল জলের মতো আবার বছর কুড়ি পরে। শুধু মনে হয়েছিল, আমি যে গাড়ি করে পেরোচ্ছি ও-পথ, আমাকে যেন ধার থেকে কারা অবাক হয়ে দেখছে। গোটা পথটা প্রায়। আর আমি কী রহস্যে কিছুতেই অদৃশ্য সেই চেয়ে থাকা জনেদের চোখে চোখ রাখতে পারছি না। কারণ আমি আবার নতুন করে যেন হাঁটতে শিখছি। যেমন আমার মা শিখেছিল আবার ষাট পেরিয়ে, পার্ক সার্কাস ৪ নম্বর ব্রিজের কাছে একটি স্ট্রোক রিহ্যাবে। পম আমায় বলে বলে দিচ্ছে, এই দেখ, আগে শুধু এখানে কারও হোটেল ছিল আর এখন দেখ... এখানে তুই কী চাস, বল! ওই দেখ, আগে কেমন একটা স্টেট ব্যাঙ্ক, একটা বরোদা টিমটিম করে ছিল। এখন প্রায় ২১-টা, আর ওই দেখ, এখন নীলা আর সুধা আন্টিরা (নাম বদল করলাম, কারণেই) ওই বড় বাগানওলা বাড়িটায় থাকে, মানে এখন তো দিল্লিতেই বেশি থাকে, এখানে মাঝেসাঝে। আমি থমকে যাই, প্রশ্ন করি, কেন যে বাড়িটায় আমার শৈশবের কত না কাল কেটেছে, ওখানেই তো আমি প্রথম বাড়িতে বানানো এক তাল সাদা মাখন খেয়েছিলাম পরাঠার সঙ্গে, আর বাইরে যে দোলনাটায় আমরাও দুলতাম এক সঙ্গে গাছ-ঘেরা মাঠে খেলতে যাওয়ার আগে, সেটা ছাড়ল কেন? কেউ ছাড়ে? পম খুব একটা কিছু বলল না, তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ। আসলে বলল তো কত কিছুই ওভাবে। মনে পড়ে গেল খবর পেয়েছিলাম, সুধা আন্টির বর, রাজ আঙ্কল (নাম বদলালাম), আমার প্রিয় বন্ধুর কাকাকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছিল। রাজ আঙ্কলের দাদা, আমরা বলতাম বড়ে আঙ্কল, আমার সে প্রিয় বন্ধুর বাবাকেও তো ভাইয়ের মতোই… ঠিক অফিসের বাইরে…
এ ভাবেই পেরিয়ে যায় জংশন, এক সময়ে জোড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছটাও পেরোই, সেই পঞ্জাবনকে যেখানে দেখা যেত প্রতি রাতে শেষ বাস চলে যাওয়ার অনেক পরেও, সবার ধারণা ভূত সে, তাকে এই প্রথমবার খুঁজি আমি। না, কুঁকড়ে দেওয়া ভূতের ভয় আমায় আজও ছেড়ে যায়নি কিন্তু বোধহয় সেবারই প্রথম আমি খানিক ধরতে পারি, পঞ্জাবনের সে প্রান্ত ছেড়ে না-যেতে পারা। হয়তো বরবিল বা প্রতিটা ছেড়ে আসা ছোট টাউন একটা টাইম লুপ। যার গায়ে পূর্বজন্মের সহস্র অভিমানের পলেস্তরা পড়তে পড়তে এমন পর্যায় গিয়েছে যে বহুদিন অশ্রু নিঃসৃত হওয়া বন্ধ হয়েছে। এখন সে ছোট টাউন অশেষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই যেন হৃদয়হীন এক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে এগিয়ে আসা বেপথুদের দিকে। বোধহয় ছোট টাউন সে কারণেই আমায় কিছুতেই মায়েঘেরা অঞ্চলে পেলব বা মসৃণের ছায়া দেয় না। আমি যতই খুঁজে মরি ড্রয়ারওলা কাঠের সে টেবিল — যেখানে আমার পড়ার বই থাকত আর যেখানে খুব ছোটবেলায় আমি প্রাণের যত্ন নিয়ে অলউইনের হালকা সবুজ ফ্রিজ থেকে একটা আইস কিউব লুকিয়ে রেখে পরের দিন ড্রয়ারে তাকে না পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম ওই ভিজের দিকে তাকিয়ে — ততই একটা অতল ভরটেক্সের সম্মুখীন হই আমি। একটা ঠাস দেওয়াল। সুরেলা একটা গন্ধ বেরচ্ছে যার ও-পার হতে। ঠিক সে গন্ধের মতো, যা পেতাম আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই এক নিম্নবিত্ত পরিবারের এক কামরা থেকে উড়ে বেড়ানো ডিমের ঝোল রান্নাকালীন। যার ও-পারে হয়তো প্রফেসর শঙ্কুর দেখা সেই এল ডোরাডো আছে কিন্তু যেখান থেকে প্রায় অলঙ্ঘ-প্রাচীর টপকে এক বর্ণ-ও ফেরৎ আনা যায় না।
বরবিল আমার চোখের সামনে সেই এল ডোরাডো হয়ে গেল। আর আমার নামের পাশে এখন হয়তো বসে ট্রেসপাসার শব্দখানি! বরবিল বরবিলের মতো থাক, তাকে অনেক বিক্ষিপ্ত করেছি। আর নয়। বিশ্বাসঘাতক আমিই, নিঃসন্দেহে। তাই আর বরবিল টকিজে রাতের শোয়ে খুকুমা-গোরাকাকুদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে আমাদের ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ দেখার দৃশ্যটা বরবিল আমায় রিওয়াইন্ড করে দেখাবে না, ইচ্ছে করেই। সে অমোঘ প্রত্যাখ্যান আমায় মেনে নিতে হবেই, উপায় নেই। আমি তাই ফিরতি পথে, রমেশ আঙ্কলের বেকারি থেকে ক্রিম রোল আর টিফিনে নিয়ে যাওয়া ক্রিম বান্-এর অদৃশ্য গন্ধ পাওয়ার আশায় এ সবই গল্প করে কন্যাকে শোনাব, আমার স্ত্রী-ও তখন নিশ্চিত ভাবেই ওর ছেড়ে আসা শিলংয়ের রেখাচিত্র ফুটে উঠতে দেখবে ট্রেনের জানলায় এসে পড়া বৃষ্টি ছাঁটে, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের জোর বোধহয় স্মৃতিবিজড়িত হতভাগার ধরে আসা স্বরের চেয়ে ঢের বেশি। জল ছাড়ে আসন অতলের আহ্বানে। আমাদের দীর্ঘশ্বাসে জড়ো হওয়া বাষ্পে আঙুল বুলিয়ে কন্যা সে কাচে বানায় ওর প্রিয় হগওয়ার্ট্স।
কখন যেন হাওড়ায় এসে থামবে ট্রেন, খুকুমা অনেক যত্নআত্তির মধ্যেও যে আমায় অপূর্ব প্রিয় আলু-পোস্ত খাওয়াতে পারেনি, সে খেদে ফোন করে হা-হুতাশ করবে। আমিও হেসে গড়িয়ে খুকুমাকে শান্ত করব, আরে এই তো জাস্ট পাঁচ-ছ’ঘণ্টার ব্যাপার, এনি ডে চলে আসব।
কিন্তু ফিরে যেতে যে অদম্য সাহস লাগে…
আর কথা রাখতে, কত জন্মের অনবরত প্রয়াস…
গত জন্মের অস্ফুট অনুরোধ…
মা চলে যাওয়ার আগে একবার 'মামা মিয়া' থেকে জেলাটো খাওয়ার আবদার করেছিল, রাখতে পারিনি আমি।
এই কয়েক দিন আগে পুরনো এক পরিচিত, তীব্র শারীরিক কষ্টে হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়ার আগে হোয়্যাট্সঅ্যাপ করেছিল, কী রে ভুলে গেলি? — উত্তর দিতে পারিনি আমি।
তাই কথা দিতে গিয়ে আমি প্রতিবার শিউরে উঠি।
পরক্ষণেই হাত রাখি প্রায়শ্চিত্তের সহজপাঠে।
সে পাঠ আত্মস্থ করে এক দিন কন্যার সঙ্গে উঠব হগওয়ার্ট্স এক্সপ্রেসে।
আরও পড়ুন:জুমেদিন আর খারসাঁওয়াঁ রোডের সর্বজয়া
তার পর যে ছোট টাউন জানে আমার প্রথম সব কিছু, সে স্টেশনে নেমে, তার কাছে নতজানু হব। এক দিন নিশ্চিত কোনও উইয়ের ঢিপি জমবে এমন মহাকাব্যিক আশা করিনি, না। ইনফ্যাক্ট কী, কেন, অত কিছু ভাবিইনি। জাস্ট এটুকুই ভেবেছি, নতজানু হব ছোট টাউনের সমীপে, ব্যস। তারপর কী হবে, আদৌ কিছু হবে কি... ইত্যাদি জানি না। আর অত জেনেই বা কী হবে। পরবর্তীর অনন্ত অপেক্ষাই যদি কপালে নাচে, তা-ই সই। এটুকু তো আমি ডিজার্ভ করি, তাই না? এতটা পড়ে এটা তো মানবেন!