শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব আস্ত এক ব্যাধি এখন
Holi 2024 Shantiniketan: শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের বর্ণময় বসন্ত-যাপনের প্রতি নগর কলকাতার মানুষদের নজর অনেকদিনের।
বাংলা ভাষায় বসন্ত শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহৃত। ঋতু বসন্ত ও রোগ বসন্ত। ঋতু বসন্ত আনন্দের ও উদযাপনের, রোগ বসন্ত বেদনার – সে রোগ হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই নিয়ম। ইদানীং অবশ্য ঋতু বসন্ত উদযাপনের এমন কতগুলি বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে যা দেখে মনে হয় ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখাই ভালো। বিশেষ করে যদি কর্মসূত্রে শান্তিনিকেতনে থাকতে হয় তাহলে বেশ ভয়ই করে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রে রেখে যে পর্যটনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে অর্থনীতির যোগ গভীর। অনেকের ভাত-কাপড়ের প্রশ্ন সেখানে – তাই পর্যটন বন্ধ করা উচিত এমন কথা বলার উপায় নেই, তবে পর্যটন ও বিপণনের নামে যে প্রকৃতি-বিধ্বংসী প্রমত্ততা বসন্তোৎসবের দিন প্রবল হয়ে ওঠে তাতে মনে ঋতু বসন্তের উদযাপন যেন ব্যাধি-বিশেষ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
অথচ এমন তো ছিল না। মোটের উপর শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের ইতিহাস ইদানীং অন্তর্জালে ক্লিক করলেই চোখের সামনে ‘খোল দ্বার খোল’ বলে হাজির হবে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব সবসময় দোলের দিন পালিত হতো না। ধর্মীয় উৎসবের বদলে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঋতু উৎসবের আয়োজন করতেন। সেই ঋতু উৎসবে আশ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করতেন – তা আশ্রমের নিজস্ব উদযাপন। সেই উৎসব যাতে প্রতিবছর নতুন রকমের হয় তার জন্য রবীন্দ্রনাথ নাট্য, গান রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্র শমীন্দ্রনাথ এই ঋতু উৎসবের সূচনা করেন। সে ১৯০৭-এর ঘটনা। দোলের দিন ছিল না সে-দিন। ১৯২৩-এ মাঘী পূর্ণিমায় বসন্তের গানের আসর বসানো হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে গানের সঙ্গে নাচের যোগ ঘটে পরে। ওরে গৃহবাসী গানের সঙ্গে নাচ, ডালি সাজানো এসবের যোগ তৈরি হল – এভাবে ক্রমশ গড়ে উঠল শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের নিজস্ব নান্দনিক প্রকরণ। শান্তিদেব ঘোষের নাচ বিশেষ ধারা তৈরি করল – প্রাণময় সেই নাচ। কলকাতা শহর থেকে দূরে প্রকৃতির মধ্যে শান্তিনিকেতনে বসন্ত যাপনের সেই নিজস্ব ক্যানভাস আশ্রমিকদের অংশগ্রহণে বর্ণময় হয়ে উঠত। নানাজনের স্মৃতিকথায় নানা নমুনা আছে।
আরও পড়ুন- বাংলা ছড়াতে বানানের টোটকা
কলকাতা শহরে হোলির বিশেষ রূপ দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে রূপ পছন্দ করেননি। ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
‘এই ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলো-মাখা আধুনিকতারই একটা স্বদেশী দৃষ্টান্ত দেখেছি হোলিখেলার দিনে চিৎপুর রোডে। সেই খেলায় আবির নেই, গুলাল নেই, পিচকারি নেই, গান নেই, লম্বা লম্বা ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে রাস্তার ধুলোকে পাঁক ক’রে তুলে তাই চিৎকারশব্দে পরস্পরের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাগলামি করাকেই জনসাধারণ বসন্ত-উৎসব ব’লে গণ্য করেছে। পরস্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙিন করা নয়।’
এই বসন্ত-উৎসব কবির পছন্দ নয় বলেই শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা করলেন রঙিন করার উৎসব। একথা অবশ্য ভাবার কোনও কারণ নেই ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ রবীন্দ্রনাথ ‘জনসাধারণ’কে নান্দনিকতা বোধশূন্য বলে মনে করতেন। যেখানে জনের মধ্যে লোকসংস্কৃতির রূপ প্রকাশিত সেটুকু তাঁর চোখে ধরা পড়ত। প্রমাণ ‘মালঞ্চ’ উপন্যাস। সেখানে কিন্তু গাড়োয়ানদের উৎসব কেবল মলিন করেনি, রঙিনও করেছে। লিখেছেন, ‘অনেক দূর থেকে শব্দ শোনা যায় মাদলের আর গানের, গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের বস্তিতে হোলি জমেছে। মেঝের উপর পড়ে আছে থালায় বরফি আর কিছু আবির। দারোয়ান দিয়ে গেছে উপহার।’ গাড়োয়ানরা নীরজার ঘরে তাদের উৎসবের বরফি আর আবির দিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তাদের নান্দনিক রুচি। চিৎপুর রোডের ল্যাঙট-পরা কাদা-মাখা মালিন্যের থেকে গাড়োয়ানদের বস্তির হোলির রূপ ভিন্ন – সেখানে রং লেগেছে। খেটে-খাওয়া মানুষেরা তাঁদের রঙের স্পর্শ ভদ্রলোকদের দিতে কসুর করেননি।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের বর্ণময় বসন্ত-যাপনের প্রতি নগর কলকাতার মানুষদের নজর অনেকদিনের। ‘শান্তিনিকেতন’ যেন তাঁদের কাছে ক্রমশই বিশেষ দৃশ্যবস্তু – শান্তিনিকেতন কেন কীভাবে উত্তরযুগে দৃশ্যবস্তু হয়ে উঠল তার সাংস্কৃতিক ইতিহাস তথ্যে-তত্ত্বে বিচার করা চলে। যা ‘দৃশ্যবস্তু’ তাকে প্রমত্ত অবস্থায় স্পর্শ করার অভিলাষ থেকেই যত বিপত্তি। স্পর্শ নানা ভাবে করা সম্ভব। শান্তিনিকেতনের গাছগুলি পুষ্পবিহীন করে পুষ্পসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠার উৎকট বাসনা স্পর্শ অভিলাষ সঞ্জাত। আবার নাচ-গান শোনা ও দেখার নামে অংশগ্রহণকারীদের উপর হামলে পড়াও একরকম স্পর্শবাসনা। মাত্রা ভেদে তা উৎকট, বিরক্তিকর, অপরকে অবমাননার অপরাধও হয়ে উঠতে পারে। ফলে শান্তিনিকেতন আশ্রমের কর্তৃপক্ষ সচেতন হয়ে উঠছেন, নিরাপত্তাহীনতা থেকে উৎসব করবেন কি করবেন এই দোলাচল। উৎসব অনিয়মিত, কখনও কখনও তা কেবল বাধ্য হয়েই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন- আবির নয়, হাওয়ায় ওড়ে শ্মশানের চিতাভস্ম! শিবের প্রিয় এই দোল উৎসব আজও এক বিস্ময়
এই সিদ্ধান্ত আরেক-রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে যে পর্যটনপুঁজির রমরমা সে কেন তার দাবি ত্যাগ করবে? ত্যাগ করেনি। ফলে নানা কিসিমের প্রস্তুতি। দুলাল চন্দ্রের সই ও ছবি দেখে যেমন আসল ও নকল চেনার চেষ্টা করেন বাঙালি এক্ষেত্রেও তার ব্যবস্থা। উৎসব কি ছাড়া যায়! বসন্ত আসছে। দোলের দিন শান্তিনিকেতনে নানা উৎসব ফুটবে। কোনটি রুচিশীল যথার্থ শান্তিনিকেতনী, কোনটি আধা – কোনটি সিকি, সবাই সবার মতো দাবি করবেন। এর মধ্যে আরেকদল উঠবেন যাঁদের শান্তিনিকেতন হতে বয়ে গেছে। তারা ডিজে নির্ভর – ধুম মাচাতে আপত্তি নেই। সব মিলিয়ে দশচক্রে কবিগুরুর ভাবনার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। রঙিন থাকার নানা ব্র্যান্ড ব্যান্ড বাজাতে উদ্যত।
অতঃপর কী করণীয়? গণতন্ত্রের এই স্ফীতোদর বিচিত্র শারীরিক নাচনতন্ত্রের বাইরে থাকাও তো হতে পারে আরেক রকম গণতান্ত্রিক অধিকার। বসন্তে নাকি আমাদের একখানা মন নানাখানা হয়ে যায়। বসন্তের ধর্মই তাই। নানাখানার মধ্য থেকে কোনখানা আপনি বাছবেন সে তো আপনার সিদ্ধান্ত। তবে সাধু সাবধান। এটুকুই বলা যাক।