জুমেদিন আর খারসাঁওয়াঁ রোডের সর্বজয়া
Life and Hopes: বাবা দেখেছিল আঙ্কলকে কাঁদতে। কোন অহেতুক মায়াঘ্রাণ চরাচরে বিলিয়েছে প্রকৃতি কী জানি, বেহেরা আঙ্কল সে দিন নেমেই দেখেছিলেন, অল্প দূর চাতালে বনস্পতির ছায়াঘেরে মৃদু হেসে তাকিয়ে এক বুড়ো মানুষ।
জুমেদিন আসত আমাদের বাড়ি। একটা ইয়া ঢাউস কাপড়ের বস্তায় প্রায় নুয়ে পড়ে, তা-ও পানমাখা ঠোঁটের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হাসি। জুমেদিন বলত 'মুসকান'। মা বলত জুমেদিন, সেই থেকে আমিও। 'বওদি' বলে এক ডাক, তারপর ভেতরে এসে কিছুতেই সোফায় বসবে না, এমনকী যে লাল মোটা কার্পেটটা ছিল বসার ঘরে, সেটার একটা কোণ তুলে নিট মাটিতেই বসবে জুমেদিন। তারপর গাঁটরি খুলে অনেক রকম বাসন দেখাত আর বদলে মায়ের কাছ থেকে নিত কাপড়।। ছাপা, জর্জেট আরও কীসব, তখন ছাই বুঝতাম। এখনও তথৈবচ যদিও! এনিওয়ে, তো জুমেদিন ওই পানলাগা মুসকান নিয়ে বওদিকে বাসন দেখাত আর আমি অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, বাসনের বদলে কেন শাড়ি নেয় জুমেদিন? অদ্ভুত স্কিম।
এক দিন স্কুল থেকে ফিরে আমার প্রবল মেজাজ গরম হয়ে গেল। ফেরার সময় জুমেদিনকে বেরোতে দেখেছিলাম। তারপর দুপুরে খেতে বসে দেখি মা আমায় অন্য একটা গোল থালায় খেতে দিয়েছে। আমার তো বাঁধা, সাধের সেই খোপ-খোপ থালা। গেল কই? প্রথম পাঁচ ওভার থেকেই মায়ের বাবা-বাছা অ্যাটিটিউডে আমার সন্দেহ যে হয়নি তা নয়, কিন্তু গোল থালা দেখে আর চাপা থাকল না অশনি সংকেত। জুমেদিনের বস্তায় আমার স্টিলের থালা। প্রকাণ্ড পুকুর থেকে তুলে আনা কাদার স্তূপের মতো তখন উথলে উঠছে আমার গোটা জীবনের দুঃখ-কষ্ট। এভাবেই মিলিয়ে গেল আমার প্রাণভোমরা? খাওয়া ফেলে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ে দিকে তাকিয়ে ভাবছি তখন, এই এত দিন ধরে এত হুজ্জুত করে শেষে এই রকম মা তৈরি করলাম! মা অবশ্য খান দু-তিনবার বোঝানোর পর থালা ঢাকা দিয়ে কাজে চলে গিয়েছিল। আমিও অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সে ভর করে সুড়সুড় করে ব্যাক টু দ্য সানমাইকা ঢাকা টেবিল।
আরও পড়ুন: যোগী টিচার, মিস্টার কিউকাম্বার ও প্রাগৈতিহাসিক
তার কয়েক দিন পর, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাজানো সিঁথির মতো রাস্তা দিয়ে বাঁশপানি যাচ্ছি, যেখানে আমার মামার বাড়ির একটি ব্রাঞ্চ। যেতে যেতে আমাদের গাড়ির চালক আহমেদ দাদা বাবাকে বিশ্বাস করানোর প্রবল চেষ্টা করছে যে, গত পরশু রাতে ওর এক পরিচিত গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল, হঠাৎ নাকি বনেট-এ দমাশ করে একটা শব্দ হয় আর চোখের সামনে দিয়ে কী যেন একটা বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে যায়। ওই কী যেন একটা, আহমেদ দাদার মতে একটি শেয়াল। এবার শীতে শেয়ালেরা পাহাড়ের কোনও গলিঘুঁজি থেকে নেমে তো আসতই হামেশা, এসে পুকুরের পরেই যে খেতের জমি, সেখান অবধি এসে 'কু' ডাকত। না, কেমন ভুল হয়ে গেল। 'কু' ডাকত বলে দাগিয়ে দিলাম। অনুচিত অনুচিত। যেবার বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো, সেবার ওরা শীতের হাওয়া কেটে ঘর অবধি পৌঁছে দিয়েছিল বটে ওই স্বর, তা বলে ওরা চিরন্তন 'কু' কেনই বা হতে যাবে! কিন্তু জুমেদিন বোধহয় বুঝেছিল হাওয়ার সে দিন অন্য মন, অন্য ভাব, ঠিক বেপরোয়া নয় সে, কিন্তু অত্যধিক উদাসীন। যেন ভোরবেলাই তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে দিনের টাস্ক। মৃত্যুর একাধিক কাফন লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে দিক বুঝে বুঝে উড়িয়ে দিতে হবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়।
ওই শেয়াল লাফিয়েছিল গাড়িতে, সে গল্প শুনতে শুনতে যে বিকেলে যাচ্ছিলাম বাঁশপানি, তখনই শুনি, স্টিলের খোপ থালা দেওয়ার সঙ্গে শাড়ির কোনও যোগ ছিল না, জুমেদিনই মুগ্ধ হয়ে দেখে গিয়েছিল স্টিলের চকচকে। আর মাকে মুখ ফুটে পুরোটা বলতেই পারেনি যে দূরে রেখে আসা মেয়েটাকে একদিন যদি ওই থালায় বসে খেতে দেখত… কিন্তু মায়েরা কোথাও তো ভিনগ্রহী হয়। তাই মা, এমনিই জুমেদিনের মুন্নিকে ওইটে দিয়ে বলেছিল, 'নাও আরও কিছু টাকা, একটা আস্ত নতুন খোপ-থালাও কিনো'। কী কারণে যেন ঠিক শেষ মুহূর্তে জুমেদিন বাড়ি যাওয়ার বাসে সেদিন ওঠেনি আর বাসটিও হাইওয়েতে অ্যাক্সিডেন্ট করে ক্ষত-বিক্ষত চিত্তে কত দিন রাস্তার ধারেই মরে পচেছিল।
জুমেদিন বলেছিল, রাকা মাইন্স বলে একটি জায়গা থেকে আরও কিছুটা গিয়ে ওর বাড়ি। বরবিল থেকে তা বহু দূর। টাটানগর থেকে খড়্গপুর যাওয়ার মাঝে পড়ত অদ্ভুত এই স্টেশনটি। কপার মাইনস একটি। সব ট্রেন যে সেখানে থামত, তেমন বোধহয় নয়। কিন্তু বম্বে মেল বা স্টিল বোধহয় থামত। অন্তত আমি যে যে বার ট্রেনের জানলা পেতাম, সে সে বার তো থামতই। আর টাটানগর থেকে উঠতাম যখন, কলকাতার পথে, সেই রঙিন বাক্সে চোখ রেখে মেলার মাঠে ‘সিনেমা’ দেখার মতো একে একে পেরিয়ে যেত রুক্ষ জমি, দীর্ঘ অবসাদেই হয়তো কুঁকড়ে যাওয়া সারিবদ্ধ টিলা-পাথর, পলক ফেলার আগেই রূপ বদলে সবুজের আবিষ্কার, পরক্ষণেই ধুলোর অলিখিত রাজপাট সদর্পে ভেঁপু বাজায়। কারণ রাকা মাইনস-এ ট্রেন থেমেছে তখন। কিছু সেকেন্ড মাত্র দাঁড়াবে গাড়ি, একটা কংক্রিটের তৈরি প্ল্যাটফর্ম-মাফিক ছিল কিন্তু কোথাও কোনও ছাওয়া নেই, খোলা আকাশ সহায়। তাতে যেমন অবাক হতাম আমি, অধিক অবাক হতাম ওই প্ল্যাটফর্ম-মাফিকের ঠিক পরের শুয়ে থাকা বিস্তৃত দিগন্ত দেখে। ওই লাল ধুলোর রাজ্যে পথ বলে কোনও আইডিয়া আদৌ আছে? সত্যি বলছি, অত নীরবতা আমি বহুকাল শুনিনি। জুমেদিনকেও ওই ধুলোর কুয়াশায় দেখিনি আর কখনও। কে জানে, ওর মুন্নি খেয়েছিল কিনা ওই স্টিল খোপ থালায়! আশা রাখি আকণ্ঠ। বিশ্বাস রাখি এ ঘোর আকালেও, যে জুমেদিনকে দেখতে হয়নি রঘুর হোটেলের রঘুর মতো, বুধাইয়ের ছুঁতে না পারা থালা।
সে বিশ্বাসের ভিত অবশ্য লালিত কত চেনা-অচেনা এমনকী দুরূহ কত কোণ হতে উড়ে এসে জুড়ে বসা পরম স্নেহে, একটা বলে আজ শেষ করি। সে-ও আর এক স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতাগামী এক ট্রেন থেকে দেখা, হয়তো অদৃশ্য-অনুভব করাও বলা তাকে। স্টেশনের নাম সিনি জংশন। ছিমছাম স্টেশন, স্টেশনের মধ্যে থেকেই ঘুলঘুলি মারফৎ দেখা যায় ক্রিসক্রস শাখানদী, অন্তত তখন যেত। আর শোনা যেত ক্রমশ আবছা হয়ে যাওয়া ইতিউতি সাইকেলের জন্মদাগ। আবছা তবে আঁধারমুখী নয়, মৃদু কোনও জলোচ্ছ্বাসের অনুরণন রেখে যাওয়া সেসব সাইকেলধ্বনি, যেন বা। তা সেবার আমাদের সঙ্গে বেহেরা আঙ্কলও এসেছেন। খারসাঁওয়াঁ রোডের বাড়ি ঘুরে আসবেন নয় কিছুদিন। এর আগে বাবার মুখে শুনেছি, বার দুয়েক বাবার হাতে বেহেরা আঙ্কল কিছু জিনিস পাঠিয়েছেন, বাড়ির জন্যে। তা নিতে আসতেন এক বুড়ো মানুষ। ট্রাঙ্ক কলে ট্রেনের সময়-টময় সব জানিয়ে রাখতেন বেহেরা আঙ্কল, তাঁকে এবং মাকে। বাবার স্বভাবতই বড় টেনশন হত, থামবে কিছুক্ষণ ট্রেন বটে। কিন্তু যিনি আসবেন, তিনি বুড়ো মানুষ; যদি আঙুল ফস্কে যায়? বাবা দরজার কাছে অল্প ঝুঁকে অচেনা এক অবয়ব চিনতে প্রয়াসী হত, একটা ইনল্যান্ড চিঠি ও একটি প্রাচীন বিগ-শপার দেওয়ার কথা তাঁকে। মিস কোনওবার হয়নি, একবার তো শেষ মুহূর্তে হয়েছিল দেখা।
বেহেরা আঙ্কল, বরবিল বাজারে একটা খুব বড় মুদির দোকান চালাতেন, যেখানে একবার আমার জেঠু কলকাতা থেকে এসে ‘কয়েকটা লবঙ্গ্ দিজিয়ে তো’ বলে কিছুই পায়নি। কারণ বেহেরা আঙ্কলের সাগরেদ চিন্টু বলে একটা পাঞ্জাবি ছেলে বোঝেইনি, স্বাভাবিক ভাবেই, যে লওং হল লবঙ্গ, ঠিক যেমন জেঠু বোঝেনি লবঙ্গের নীচে একটা হসন্ত লাগিয়ে লবঙ্গ্ বললেই তা হিন্দি হয়ে যাবে না আর হাতে কাঙ্খিত ফলও আসিবে না। সেদিন বেহেরা আঙ্কল এসে পড়ায় জেঠু লবঙ্গ নিয়েই ফিরেছিল। তবে আঙ্কল যেদিন জেনেছিল, জেঠু আর বাবা বাণীকুমারের সন্তান, সে দিন ফ্রি-তেই এক্সট্রা লবঙ্গ দিয়েছিল কিনা, খেয়াল নেই! তো বেহেরা আঙ্কল উড়িয়া হলেও, ছোট থেকেই নাকি মহিষাসুরমর্দিনী শুনতেন রেডিওয়। আর সে ঝোঁক ধরিয়েছিলেন বেহেরা আঙ্কলের মা, যাঁকে সেবার বেহেরা আঙ্কল ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি যে তিনি নিজেই বাড়ি আসছেন। সিনি জংশনে নেমে, আমাদের বিদায় জানিয়ে বেহেরা আঙ্কল খারসাঁওয়াঁ রোডের বাড়ি গিয়ে মাকে চমকে দেবেন, এমনই ছিল ইচ্ছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
কিন্তু সে দিন যখন সিনি-তে থামল ট্রেন আর বেহেরা আঙ্কল-ও আমায় একটা চকলেট ললিপপ আর খান দুই-তিন বাবলগাম কিনে নামলেন প্ল্যাটফর্মে, জানলা দিয়েই অস্ফুটে দেখলাম কী যেন একটা দেখে বেহেরা আঙ্কল বেবাক দাঁড়িয়ে। বাবা দেখেছিল আঙ্কলকে কাঁদতে। কোন অহেতুক মায়াঘ্রাণ চরাচরে বিলিয়েছে প্রকৃতি কী জানি, বেহেরা আঙ্কল সে দিন নেমেই দেখেছিলেন, অল্প দূর চাতালে বনস্পতির ছায়াঘেরে মৃদু হেসে তাকিয়ে এক বুড়ো মানুষ।
অপার্থিব এ হেন বিশ্বাসেই মিলায়ে বস্তু, বুঝি এখন।
তাই যুদ্ধবিরতি-ও অনতিদূর।
ক্রমে বাসা বাঁধে হোপ।
এক জাত অপটিমিস্ট লড়ে যায় ঘোর অমানিশার সহিত।
আর বেহেরা আঙ্কলের চোখ মুছিয়ে বাছাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান আর এক সর্বজয়া।