মদে চুমুক দিতে সোনার 'স্ট্র'! সুরাপ্রেমের তাক লাগানো ইতিহাস...

Old Drinking Straws: একটি ধাতব পিপেয় ভরা হত মদ, সেখানে গোল করে বসে সোনার স্ট্র ডুবিয়ে চলত আদিম মানুষের সুরাপান।

'মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর'। এই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ যতটা সত্য, ঠিক ততটাই সত্য যুগ যুগ ধরে মানুষের মদের প্রতি আসক্তি। শুধু মানুষই নয়, দেবদেবী থেকে সুরাসুর, 'জেনেশুনে বিষপান' করার ক্ষেত্রে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি কোনও দিনই। সমুদ্রমন্থনে উঠে এসেছিল অমৃতের কলস। সমুদ্রমন্থনে শ্রম দিলেও সেই অমৃতের কলসের ভাগ পায়নি অসুরগণ। মোহিনী সেজে তা ছিনিয়ে নেন স্বয়ং বিষ্ণু। আর সেখান থেকেই শুরু সুরাসুরের যুদ্ধ। আর এই অমৃতের সন্ধান শুধু পূরাণে নয়, চলে আসছে প্রাচীন সময় থেকেই। গবেষণা বলছে, নিত্যনতুন মদ উদ্ভাবনের নেশাই নাকি মানুষকে আরও সৃষ্টিশীল ও আধ্যাত্মিক করে তুলেছিল সে সময়। শুধুই যে নতুন নতুন মদ তৈরি করেছে মানুষ, তা নয়। প্রয়োজন অনুযায়ী এসেছে আনুষাঙ্গিক নানা জিনিসও। কখনও বানিয়ে ফেলেছে মদ রাখার পিপে তো কখনও মদ খাওয়ার জন্য বিশেষ স্ট্র।

না, 'স্ট্র' কাকে বলে তখনকার মানুষ জানত না। তবে ব্যবহারিক প্রয়োজনে জিনিসকে টেরিয়ে বেঁকিয়ে কাজের জিনিস বানিয়ে নিতে পারত ঠিকই। স্ট্র বলতে এখন আমরা বুঝি সাধারণত প্লাস্টিকের তৈরি স্ট্র-কেই। পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে আজকাল অবশ্য কাগজ বা কার্ডবোর্ডের স্ট্র-এরই বেশি চল। তবে আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন প্লাস্টিকের মতো অপকারী জিনিস আবিষ্কার হয়নি মোটেও। ফলে ভরসা করতে হত ধাতুর উপরেই। প্লাস্টিকের তৈরি স্ট্রয়ের ব্যবহার বহুল ভাবে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। তবে ঝাঁ চকচকে প্রযুক্তি থাক বা না থাক, আবগারি মজলিসের কিন্তু কমতি ছিল না সে সময়েও। আজ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব হাজার পাঁচেক বছর আগের কথা। তখনও দিব্যি বসত সুরাপানের আসর। আর সেই আসর কম শৌখিন ছিল না। কথায় বলা হয় সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। তবে তখনকার মদ্যপায়ীরা কিন্তু মদও চাখত সোনার 'স্ট্র'-এ। কখনও কখনও রূপো কিংবা অন্য মূল্যবান ধাতু দিয়েও তৈরি হত সেই স্ট্র। পিপেতেও অনেক সময় থাকত ধাতুর চমক।

আরও পড়ুন: সারি সারি কফিন ঝোলানো এই পাহাড়ে! ঝুলন্ত কবরের যে ইতিহাস স্তম্ভিত করবে

আর এমন সব পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার কার্যত চমকে দিয়েছে ঐতিহাসিকদের। ১৮৯৭ সালে দক্ষিণ রাশিয়ার কাছে ঢিপি খুঁড়ে মেলে তাম্রসভ্যতার ওই নিদর্শনগুলি। সেন্ট পিটারসবার্গের হারমিটেজ মিউজিয়ামে সাজানো রয়েছে সেসব। তবে মজার গল্প রয়েছে এর পিছনেও। পুরাতাত্ত্বিকেরা যখন খুঁজে পান এই নিদর্শনগুলি, তখন মহাফাঁপড়ে পড়েছিলেন তাঁরা। প্রাথমিক ভাবে তাঁরা ভেবেছিলেন এইসব ফাঁপা নলগুলি আসলে রাজদণ্ড কিংবা শামিয়ানা খাটানোর লাঠি। বা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করতেন সেগুলিকে আদিম মানবেরা। তবে সম্প্রতি সেই ধন্দ ঘোঁচে। রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের একদল পূরাতাত্বিক সম্প্রতি জানিয়েছেন, ওই সব লাঠি বা দণ্ড কিছুই নয়। আদতে সেসব মদ্যপানের জন্য তৈরি বিশেষ স্ট্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিই এখনও পর্যন্ত পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন স্ট্র।

সব মিলিয়ে মোট আটটি এমন ধাতব স্ট্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সে সময়। সোনা বা রূপোর মতো ধাতু দিয়ে তৈরি ওই নলগুলিতে কোনও কোনও সময় ষাঁড়ের মূর্তি খোদাই করা থাকত। লম্বায় সেগুলো হত প্রায় তিন ফুটের কাছাকাছি। ওই স্ট্রগুলির মুখে লেগে থাকা স্টার্চ গ্র্যানুয়েলসের নমুনা পরখ করে মনে করা হচ্ছে, মদ খাওয়ার কাজেই ব্যবহার করা হত সেগুলিকে। আর সেই মদ সম্ভবত বিয়ার। এই ধরনের ধাতব স্ট্র নাকি মাইকপ সভ্যতার উপকরণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু মাইকপই নয়, খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে এই ভাবে সুরাপানের নজির ছিল সুমেরীয় সভ্যতাতেও। তাদের ধাতব স্ট্রয়ের মাথায় আবার লাগানো থাকত বিশেষ ধরনের ছাকনি, যার মাধ্যমে মদের মধ্যে থাকা ভেজাল উপকরণগুলো বাদ দিয়ে দিতেন সে সময়ের মানুষেরা। রাজপরিবারের কোনও সদস্যের মৃত্যু হলে নাকি বসত এমন সুরাপানের আসর।

মদ্যপানের ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়। মদ তৈরির ব্যপারে গোড়া থেকেই কম উদ্ভাবনী ছিল না আদিম মানুষ। পৃথিবীর প্রাচীনতম মদের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল নিওলিথিক গ্রাম জিয়াহুতে। ভাত, মধু এবং আঙুরজাতীয় ফল পচিয়ে তৈরি হত সেই সুরা। তা প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৬৬০০ সালের কথা। সেই সভ্যতার নিদর্শন, মাটির তৈরি পাত্রে মিলেছে সেই মদের উচ্ছিষ্টাংশ। যার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছন গবেষকেরা। প্রায় দশ হাজার খ্রিষ্টপূর্ব বছর আগে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মানুষেরা যব পিষে একধরনের মদ তৈরি করত। প্রায় ন-হাজার বছর আগে উত্তর চিনে প্রথম বিয়ার তৈরি করার প্রমাণ মেলে। সম্ভবত বিয়ারই মদের মধ্য সবচেয়ে প্রাচীনতম। আস্তে আস্তে নানা ধরনের ফলমূল, ভাত ও মধু পচিয়ে আরও নানান ধরনের মদ বানাতে শেখে মানুষ। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে মদ খাওয়ার অভ্যাস শুরু করে মিশরীয়রা। সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতায় ওষুধ হিসেবেও অ্যালকোহল ব্যবহার করা হত। হিব্রু বাইবেল থেকে জানা যায়, সেসময় হতাশাগ্রস্ত কিংবা মুমূর্ষ রোগীকে অনেক সময় মদ্যপানের পরামর্শ দেওয়া হত। জাগতিক যন্ত্রণা ভুলতে সাহায্য করত সেই পানীয়। মনে করা হয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকেই ইউরোপে যাত্রা করেছিল বিয়ার নামক এই বিশেষ মদটি। তাম্রযুগে গ্রীসেও এমন মদ খাওয়ার প্রথা ছিল বলে জানতে পেরেছেন পূরাতাত্বিকেরা। প্রাচীন ভারতেও কিন্তু মদের ব্যবহার ছিল। রামায়ণ ও মহাভারত, দুই মহাকাব্যেই মদের উল্লেখ রয়েছে।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সবথেকে দামি তরবারি! টিপু সুলতানের অস্ত্রের দাম শুনলে চোখ উঠবে কপালে…

ফলে এই সুরাপ্রীতি যে মানুষের একদিনের উপার্জন নয়, তা তো বোঝাই যায়। তবে মদ খাওয়ার যে বাদশাহী আয়োজন থাকত মাইকপ সভ্যতায়, তা অবাক করেছে ইতিহাসবিদদের। এই ধাতব স্ট্র গুলো এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মদ্যপানের উপকরণ বলেই মনে করছেন গবেষকেরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, এমনকী শোক উপলক্ষেও আয়োজন করা হত এমন সুরাপানের। যেখানে একটি ধাতব পিপেয় ভরা হত মদ। বহু ক্ষেত্রেই সেই পিপে তৈরি হত খাঁটি রূপোয়। আর সেখানে গোল করে বসে যে যার কাঞ্চন-স্ট্র ডুবিয়ে চলত আদিম মানুষের সুরাপান। তখন থেকেই যে মানুষ যুথবদ্ধ জীবনযাপন করত, সেই আঁচ পাওয়া যায় সহজেই। আজকের বার বা সরাইখানার ধারণা ছিল সেসময় ছিল কিনা বলা কঠিন, তবে এলাহি মদের আসরে যে মজতেন আদিম মানুষেরাও, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

More Articles