সলিল চৌধুরীকে কেন বুঝতেই পারল না সেকালের কমিউনিস্ট পার্টি?

Salil Chowdhury: সলিল বলেছিলেন, "কেবল রাজনীতির কথা বলে মানুষের কাছে দলীয় বার্তা কার্যকরীভাবে পৌঁছবে না।"

একটা সময়ে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন গণনাট্য সংঘে। পরবর্তীকালে মনে হয়েছিল, আরও বড়, খোলামেলা পরিসরের প্রয়োজন। গণনাট্য সংঘের সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা করত। সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে ভাতা পেতেন মাসে ৩০ টাকা। পার্টি থেকে কাউকেই পারিশ্রমিক দেওয়ার বিশেষ চল ছিল না। একরকম ঘরের খেয়ে পার্টির কাজ করতে পারলে তাঁকেই বলা হতো সর্বক্ষণের কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীনও পার্টির কাজ করেছেন সলিল চৌধুরী। ১৯৯৫ সালে, মৃত্যুর কিছু মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কেন? সরাসরি বলেছিলেন— "মূর্খদের সংসর্গ ভালো লাগা তো কাজের কথা নয়। এতে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রমাণ মেলে।" তাঁর দুঃস্বপ্ন, ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশের শাসনভার গ্রহণ করছে। শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষকেগুলিকে হত্যা করা হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয়, এম এম কালবুর্গি (২০১৫), গৌরী লঙ্কেশ (২০১৭), নরেন্দ্র দাভোল্‌কর (২০১৩), গোবিন্দ পান্‌সারেদের (২০১৫) মতো লেখক, সাংবাদিক, প্রগতিশীল সমাজকর্মীরা খুন হয়ে গেলেন কয়েক বছরের মধ্যেই। জেলে বন্দি দশাতেই প্রাণ গেল বৃদ্ধ ফাদার স্ট্যান স্বামীর (২০২১)। এই হলো ভারতীয় রাজনীতির একটা দিক। আবার, প্রগতিপন্থী বাম-মনস্ক একজন ব্যক্তি হয়েও, কমিউনিস্ট পার্টি তথা গণনাট্য সংঘের বিভিন্ন কাজের তীব্র সমালোচনা করতে পিছ-পা হননি সঙ্গীতের এই জাদুকর।

গত শতাব্দীর চারের দশকে অবিভক্ত বাংলায় দুর্যোগের ঘনঘটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯-এ। ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ। সলিল চৌধুরী 'অশৌচ' পালন করেছিলেন এক মাস ধরে! ১৯৪৩-এ বাংলায় মহামন্বন্তর। এই সময়ই, দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছেন সলিল। এর আগে অসমের কাজিরাঙ্গার কাছে দিন কেটেছে সলিলের। তাঁর চিকিৎসক বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী সেখানে চা বাগানের ডাক্তারবাবু ছিলেন। চিফ মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন এক আইরিশ ডাক্তার। তাঁর ছিল ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতে গভীর অনুরাগ। সেই সূত্রে বিটোফেন, মোৎসার্ট, চাইকোভস্কি, শপাঁ, বাখ্‌ প্রমুখের কম্পোজিশন শোনার সুযোগ হয়েছিল সলিলের। এরপর ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। পড়াশোনা হরিণাভি হাই স্কুলে। কলেজে পড়ার সময় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিচার নিয়ে গান বাঁধেন— ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’। এর পর ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘রানার’ প্রভৃতি গান। আত্মজীবনীতে লিখেছেন—

"কমরেড বীরেশ মিশ্র ডেকে বললেন, উত্তরবঙ্গের রেল শ্রমিকদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গান বাঁধতে হবে। রেলগাড়ির চাকার শব্দে যে ছন্দের স্পন্দন, তা থেকেই গান তৈরি হলো— ‘ঢেউ উঠছে/ কারা টুটছে/ আলো ফুটছে/ প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে।"

আবার ১৯৪৮-এ কাকদ্বীপ-তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে লিখলেন— ‘হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শান হো/ জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেব না, আর দেব না/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো’। এসবই গণনাট্য সংঘের জন্য। গণনাট্য সংঘ কোন কৌশলে শক্তি সঞ্চয় করল, এর উত্তরে সলিল চৌধুরী বলেছেন— বলরাজ সাহানি, পৃথ্বীরাজ কাপুর, কৈফি আজমি, সাহির লুধিয়ানভি, জান নিসার আখতার, এম এস সত্থ্যু, হাবিব তানভির, চেতন আনন্দ, দেব আনন্দ, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ওমর শেখ, মৃণাল সেনদের মতো শিল্পীরা যখন এক মঞ্চে সমবেত হন, সেই সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি তো হবেই। এসেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কী করুণ পরিণতি হলো তাঁর! মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যিনি ‘মহর্ষি’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, তাঁর কোনও বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শে উৎসাহ ছিল না। তিনিও IPTA-তে যুক্ত হয়েছিলেন। সলিল বলছেন, পূরণচাঁদ যোশী যখন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, সেই সময়ই সম্ভব হয়েছিল এই সাংস্কৃতিক নবজাগরণের।

আরও পড়ুন- থিয়েটারে-বাস্তবে যেভাবে নগ্ন প্রতিবাদের মুখ হয়েছেন মণিপুরের মেয়েরা

এরপর পার্টি গ্রহণ করল জনযুদ্ধের নীতি। পার্টির সাধারণ সম্পাদক তখন বি টি রণদিভে। সলিল চৌধুরীর গণনাট্যে কাজ করার প্রতিবন্ধকতা শুরু হলো এই সময়ে। তাঁকে বলা হলো, ‘Party cell’-কে দিয়ে অনুমোদন করাতে হবে গান, তবেই জনসমক্ষে গাওয়ার ছাড়পত্র মিলবে। সলিল চৌধুরীর স্পষ্ট বক্তব্য, পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গীত সম্পর্কে বিশেষ কোনও ধারণা ছিল না। অথচ তাঁরাই গানের বিচারক। তাঁরা ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটি নিষিদ্ধ করলেন। কী কারণে এই শাস্তি? পার্টির নেতারা বললেন, ওই বধূটি লঙ্কার গুঁড়ো ছুঁড়ে মেরে তাঁর সংগ্রামী মানসিকতার পরিচয় দিতে পারত। তা তো সে করেনি। অতএব ওই গান গাওয়া যাবে না।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নানা উত্থান-পতন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকেও বিভিন্ন সময়ে দিশাহীন করেছে, তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের গোড়ায় তাঁর মনে হয়েছিল, এভাবে পার্টি কতদূর এগোবে! সলিল চৌধুরীর স্পষ্ট বক্তব্য, সাংস্কৃতিক ফ্রন্টকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত লোক কমিউনিস্ট পার্টিতে বরাবরই কম ছিল। গণনাট্য আন্দোলনকে সামনে রেখেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জয়যাত্রা কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট চলত একেবারে এলোমেলোভাবে। কেবল রাজনীতি-সচেতন হলে হয় না, পার্টি নেতৃত্বকে কবিতা, গান, নাটক ইত্যাদি সম্পর্কেও চর্চা করতে হবে। বহু প্রতিভাবান মানুষ গণনাট্যের মঞ্চে এসেছিলেন। পার্টির সামনে সুযোগ ছিল, এঁদের একত্র করে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার হয়নি। সভা-সমিতিতে গান-বাজনার রেওয়াজ নিয়েও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সলিল চৌধুরী—

"সভায় যখন লোক নেই, সেই সময় আমাদের বলা হতো গান চালিয়ে যেতে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তখন নেতারা বক্তৃতা দেবেন… নাটক কিংবা গানের আর প্রয়োজন নেই।"

১৯৫৩-৫৪ সাল নাগাদ সলিল চৌধুরী বম্বে চলে আসেন। যোগ দেন বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। এই সিদ্ধান্তকে পার্টি নেতারা বলতেন ‘নৈতিক স্খলন’। তাঁদের কথায় – এখন থেকে এঁরা অস্পৃশ্য (‘untouchables’)। আড়ালে ‘renegade’ বলতে ছাড়া হতো না। সলিল বলছেন,

"এরপর সরাসরি আমাকে বলা হতো, তোমার তো বেশ নামডাক, গণনাট্যের অন্য সদস্যরা এটা কি ভালোভাবে মেনে নিতে পারবে?"

‘নবান্ন’-র পর বিজন ভট্টাচার্য লিখলেন ‘জবানবন্দী’। তাঁর কাজকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে সলিলও লেখেন তিনটি নাটক— ‘জনান্তিকে’, ‘এই মাটিতে’ এবং লেডি গ্রগরির ‘The Rising of the Moon’ অবলম্বনে ‘অরুণোদয়ের পথে’। নাটকগুলি বেমালুম হারিয়ে গেল! প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া যায়নি, কারণ পার্টি নাটকগুলিকে নিষিদ্ধ করেছে। আর যখন তখন পুলিশের হামলা। কলকাতায় একবার নাটকের শো হচ্ছে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করছেন। আর সত্যিই পুলিশ রেইড করেছে। কালীবাবু বলে উঠছেন— ‘এ কী! এখন তো তোমাদের দৃশ্য নয়!’ ইতিমধ্যে আসল পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয়ে গেছে। এই ঘটনাটা সারা জীবন তাঁর মনে থেকে গেছে। এরপরেও, গান গাইতে গিয়ে পুলিশের বেদম লাঠির বাড়ি জুটেছে কপালে।

সলিল চৌধুরী মনে করেন, তৎকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পথ থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁরা। কৃষক, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক, খেতমজুর, শহরের রিকশা চালক— সকলকেই কমিউনিস্ট পার্টির বৃত্তে আনার চেষ্টা হয়েছিল। সাফল্য কি আদৌ এসেছে? এ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল তাঁর মনে।

আরও পড়ুন- ‘পথের পাঁচালী’-তে ছিলই না চরিত্রটি! যেভাবে এক ‘দেহাতি’ কিশোরী হয়ে উঠল বাঙালির দুর্গা

সলিল চৌধুরী ১৯৪৪-৪৫ থেকে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বিপ্লবী কবিয়াল। তাঁর বেশ মনে পড়ে, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী লোকশিল্পীরা যুক্ত হয়েছিলেন গণনাট্যের মঞ্চে। তরজা গানের গুরুদাস এসেছিলেন কৃষক পরিবার থেকে। পরে কাজ নেন শহরে কারখানায়। দশরথলাল ট্রাম কোম্পানির শ্রমিক। মঘাই ওঝা ঢোল বাজানোর ওস্তাদ। তিনি অসমের কৃষক পরিবারের সন্তান। তারপর আসেন আন্নাভাও সাঠে। গণনাট্যের জন্যেই লিখে ফেলেন তামাশা এবং লাওনি। তার সঙ্গে জোটেন ওমর শেখ এবং গাওয়ানকর। আন্নাভাও ছিলেন বস্তিবাসী শ্রমিক কিন্তু চমৎকার কবিতার হাত। এঁদের কি ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারা গেছে? ফ্রান্স, ইতালি, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইওরোপ, চিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে সকলে ব্যতিব্যস্ত। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের দিকে নজর দেবে কে! নেতাদের মধ্যে যথেষ্ট রেষারেষি ছিল। পরবর্তীকালে সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআই(এম)(এল)— পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। 'ভদ্রলোক' শ্রেণির শিক্ষিত লেখক-শিল্পীরা যেমন এসেছিলেন, তেমনই কৃষক-শ্রমিকেরও আগমনে ঘাটতি হয়নি। তাও পার্টি সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে ব্যর্থ হলো। সলিল চৌধুরী বলেছেন— "আমি মনে করি, বাংলার রেনেসাঁসের পর সারস্বত চর্চার এত বড় সুযোগ এসেছে কি?" কাকদ্বীপ-সুন্দরবন অঞ্চলে এক সময় মুকুন্দ দাসের গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। গণনাট্যে দেখলেন, নীতি নির্ধারকরা সকলেই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। "গণনাট্য সংঘ ভেঙে যাওয়ার দায়ভার তাঁদেরই নিতে হবে," দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন সলিল চৌধুরী। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’-কেও তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়নি কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টিতে বলা হতো, সমসাময়িকতার উপর জোর দিয়ে, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সলিল চৌধুরীর মতে, এভাবে শিল্পের পরিধি নির্ধারণ করে দিলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ‘পার্টি রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে ভুল করেছে। এই ভুলের ক্ষমা হয় না’, বলেছেন সলিল।

১৯৮৮ সালে এক নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরে সলিল চৌধুরী বলেন— "কনটেন্ট যদি ফর্মকে বদল করে তাহলে ফর্মের নবজন্মের প্রয়োজন ঘটে। ধরা যাক ‘অবাক পৃথিবী’। এর দ্বিতীয় পর্বে ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে’— এটা কোনও গৃহীত আঙ্গিক নয়। মাইনর কর্ড দিয়ে শুরু হয়ে পরে মেজর কর্ডে যাচ্ছে, সেখানে একটা হারমোনিক ভিত্তি-প্রধান গান হয়ে উঠছে। আবার ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’ গানে ‘যখন প্রশ্ন ওঠে ধ্বংস কি সৃষ্টি’— সেখানে কমপ্লিটলি মডিউলেশন হয়ে কর্ড বদলে যাচ্ছে। এটা যদি তাত্ত্বিকভাবে আলোচনা করতে হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন এসে যাবে, কী করে মিডিয়েন্টকে সুর করে রিলেটিভ মাইনর থেকে রিলেটিভ মেজর কর্ডে যাওয়া হয়েছে? এই আলোচনার পরিবেশ পার্টিতে কোথায়? তাছাড়া পুঁজিপতিরা টিভি, ক্যাসেট, রেডিও, বিজ্ঞাপনে যেমন অসাধারণ অর্কেস্ট্রেশন বা পারফেকশন দিয়ে পচা জিনিসকে জৌলুসে ভরিয়ে যুবমানসে প্রচার করছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে গেলে একটা হারমোনিয়াম বা একতারা নিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। অস্ত্রাগারে ওদের হাতে যেসব অস্ত্র আছে, তার অধিকাংশ অস্ত্র আমারও দরকার। এটা পার্টি বোঝে না। তারপর ধরুন, একজন গণআন্দোলন করেন, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য বা দরদি— তিনি যে গণসঙ্গীতের সার্থক শিল্পী হবেন, এমনটা কি বলা যায়? কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মানেই নাটক, গান, সিনেমার বোদ্ধা বা গুণগ্রাহী তেমন তো নয়। অথচ তাঁরাই সব নির্ধারিত করে দেওয়ার জন্য উৎসুক।"

সলিল চৌধুরীর মনে পড়ে, ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’ ছবিটি যখন বেরোয়, দেখতে হইচই পড়ে গেল। মোটরবাইক চেপে গান গাইছে নায়ক – এই দৃশ্য দেখেই প্রেক্ষাগৃহে দর্শক শুরু করল পয়সা ছুঁড়তে! সলিল বলছেন, "আমাদের পার্টি এই পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু স্লোগান দিয়ে, বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। আজকের নাট্যশিল্পীকে, সুরকার বা গায়ককে প্রশিক্ষিত হতে হবে। এই প্রশিক্ষণ ছাড়া কাজ হবে না। অডিও-ভিজুয়ালের কথা বলেছিলেন পূরণচাঁদ যোশী। সেকথা পার্টি কানে তুলেছে? কম খরচে ছবি তৈরি করে জেলায়-গ্রামে পৌঁছে যেতে হবে। একটা সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। সেটা পার্টির উদ্যোগেই হওয়া উচিত ছিল। সেসব কিছুই হয়নি। কেবল রাজনীতির কথা বলে মানুষের কাছে দলীয় বার্তা কার্যকরীভাবে পৌঁছবে না। গণনাট্য শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই লেখক-শিল্পীরা অন্যান্য জায়গায় চলে গেলেন। আমিও গিয়েছিলাম বোম্বাইতে, ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির জন্য। গণনাট্যের সময়ও দেখেছি, আমাদের কর্মীরা অর্ধাহারে অনাহারে এক গ্রাম থেকে অন্যত্র পায়ে হেঁটে গেছেন। তাঁরা ভাবেননি নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের কথা। কথা হচ্ছে, পার্টি কেন ভাবল না! পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে তো আমরা একজোট হতে পারি।"

 

গ্রন্থ সহায় :
১) সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ ১, দে’জ
২) জীবন উজ্জীবন, প্রতিক্ষণ
৩) সলিল চৌধুরী : প্রথম জীবন ও গণসঙ্গীত, সমীরকুমার গুপ্ত, মিলেমিশে, কলকাতা
৪) Conversation With The Maestros, Kalpana Biswas, CONTEXT005, January 2014
৫) ওয়েবসাইট salilda.com

More Articles