প্রবন্ধে কার্লোস ফুয়েন্তেসের মননশীলতার মানচিত্র অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে আজও
Carlos Fuentes: পিতা কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রয়াত সন্তানের প্রতি মমতাকে মূর্ত করে তুলেছেন আত্মজের তোলা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আলোকচিত্রগুলোর হৃদয়গ্রাহী ভাষ্য রচনা করে।
কবিতা ও কথাসাহিত্যের মাধ্যমে আমরা লাতিন আমেরিকার যেসব লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তাদের কারও কারও একইসঙ্গে ভিন্ন আরেক পরিচয়ও রয়েছে যা অপেক্ষাকৃত আচ্ছাদিত কিংবা কম আলোচিত। কবি অক্তাবিও পাসকে প্রাবন্ধিক হিসেবে জানলেও আজ পর্যন্ত তাঁর প্রবন্ধের অনুবাদ গ্রন্থ বাংলা তর্জমায় বেরিয়েছে কি? তাঁর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ যে বইটি বাংলা তর্জমায় প্রকাশিত হয়েছে সেটি 'ইন লাইট অব ইন্ডিয়া', যদিও সে অনুবাদ অতিশয় অপাঠ্য। অথচ শিল্প সাহিত্য, চিত্রকলা, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর কত সব গ্রন্থ রয়েছে! আর এইসব প্রবন্ধের বই বিশ্বদর্শীর গভীর অনুভূতি থেকে উৎসারিত যা প্রজ্ঞায় ও বিশ্লেষণে, পর্যবেক্ষণ ও শৈল্পিক বাকস্ফূর্তিতে অনবদ্য। প্রতিভাহীন বাচালদের হাতে প্রায়শই যে পাণ্ডিত্য পাঠকদের জন্য হয়ে ওঠে নিপীড়ক, তিনি তাকে করে তুলেছেন সুপাঠ্য, প্রাণোচ্ছ্বল ও প্রজ্ঞাদীপ্ত। প্রাবন্ধিক পাসের তুলনা স্প্যানিশ ভাষায় আজও অদ্বিতীয়। অথচ তাঁর প্রবন্ধের প্রতি আমাদের অনুবাদকদের আগ্রহ কেন জন্মায়নি, বুঝতে পারছি না। পাস-পরবর্তী প্রজন্মের বুম-আন্দোলনের লেখকদের ক্ষেত্রেও আমরা অনুরূপ উপেক্ষা দেখাতে কার্পণ্য করিনি। মারিও বার্গাস যোসা কিংবা কার্লোস ফুয়েন্তেস— দু'জনেরই গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি রয়েছে বিস্তর ননফিকশন, আমরা যাকে মননশীল গদ্য বলে অভিহিত করতে পারি। কিন্তু তাঁদের কথাসাহিত্য বাংলায় অনূদিত হলেও প্রবন্ধের তর্জমা হয়েছে কদাচিৎ, গ্রন্থাকারে সম্ভবত আজও নয়।
ফুয়েন্তেসের গদ্যের পরিমাণ পাসের মতো এতটা বিপুল নয় যদিও, কিন্তু তা প্রসাদগুণে, কল্পনার আভায়,পাণ্ডিত্যে ও উন্মোচনের ঐশ্বর্য্যে অনন্য এবং বিষয়ের বহুমুখিতার কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বব্যক্তিত্ব যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের বিচিত্র প্রবাহের এক সঙ্গমস্থল হয়ে উঠেছে। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা পেরিয়ে ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমারের মতো দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর শিল্প ও সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে তাঁর আগ্রহের মননশীল মানচিত্র। ঠিক এই কারণে দেশ ও বিদেশের যেকোনও ধরনের সংকটে গণমাধ্যমে তিনি বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় ছিলেন অগ্রগণ্য। উপসাগরীয় অন্যায় যুদ্ধের (সব যুদ্ধই অন্যায়, উপসাগরীয় যুদ্ধ ছিল সেই অন্যায়ের সর্বোচ্চ রূপ) সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলেন নিয়মিত কলাম। আর সেসব ছিল মার্কিন ও ইউরোপিয় জোটবদ্ধ দেশগুলোর প্রতি তাঁর বিক্ষোভের লেলিহান প্রকাশ কিন্তু তা যুক্তি ও নৈতিকতা দ্বারা সমর্থিত। সাহিত্য বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধের বইগুলোয় উঁকি দিলে দেখা যাবে ইউরোপিয় ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্যকে তিনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও তাৎপর্যে কেবল আবিষ্কারই করেননি, সেই আবিষ্কারের সজীবতায় পাঠককেও স্পন্দিত করেন তাঁর আশ্লেষী ও সৃজনশীল বয়ানের মাধ্যমে। তাঁর প্রবন্ধ সৃষ্টিশীল সংরাগে এতই প্রখর যেন তা কথাসাহিত্যের নানা দিগন্তকে আবিষ্কারেরই প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার জন্য নিয়ত উন্মুখ। গল্প ও উপন্যাসের তুলনায় প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যা কম বটে, কিন্তু তা বিশ্ববোধ ও প্রজ্ঞার দ্বারা এতটাই পরিশ্রুত আর ভাষিক সৌকর্যে মোড়ানো যে উৎকর্ষবিচারী সমসাময়িক ও ভবিষ্যতের পাঠকদের কাছে আদৃত হওয়ার মতো।
পিতাপুত্রের যুগলবন্দি
কিন্তু গদ্যের অন্য এক ফুয়েন্তেস আছেন যিনি স্প্যানিশভাষীদের বাইরে এখনও পর্যন্ত অজানা। উপন্যাস বা গল্পের তুলনায় তাঁর প্রবন্ধের অনুবাদ হয়েছে কম। তারও চেয়ে কম হয়েছে তাঁর ব্যক্তিভিত্তিক দু'টি বই রেত্রাতোস এন এল তিয়েম্পো (Retratos en el Tiempo) এবং পেরসোনাস (Personas) সম্পর্কে নিগূঢ় হদিস। এ দুটো বইয়ের মধ্যে চরিত্রগত মৌলিক পার্থক্য খুব একটা নেই। তবে প্রথমটির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, বইটির জন্ম হয়েছিল তাঁর ছেলের আলোকচিত্রগুলোর সূত্রে। এ হচ্ছে পিতাপুত্রের এক যৌথ শিল্পকর্ম। কিন্তু কেন পুত্রের সঙ্গেই তাঁকে প্রকাশ করতে হয়েছিল এই গ্রন্থ? একইসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন- কী এমন কারণে তাঁর সন্তানই হয়ে উঠেছিলেন এই গ্রন্থের সহলেখক? দুটো প্রশ্নের উত্তর অভিন্ন এক রেখায় এসে মিলিত হবে যদি জানা যায়, তাঁর সন্তানও বহন করেছিলেন পিতার শৈল্পিক উত্তরাধিকার, কিন্তু ভিন্ন মাধ্যমে, কিংবা তত ভিন্ন নয়, কারণ আমরা দেখতে পাব ফুয়েন্তেসও খুব নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে না হলেও রং ও রেখার রাজ্যে খুব অল্প সময়ের জন্য বিরাজ করেছেন। তবে বিরাজ না করলেও চিত্রকলা সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল, চর্চার কমতি ছিল না। পিতৃসূত্রে চিত্রকলা, আলোকচিত্র আর কবিতা—এই তিন জগতের নাগরিকত্বে ছিল তাঁর আত্মার অধিষ্ঠান। পিতার মতোই ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষায় আত্মজের ছিল নির্ভুল ও অনর্গল স্ফূর্তি ও সক্ষমতা। ফরাসি ভাষায় লেখা স্বরচিত কবিতার সংকলন Survivent les mots: Poèmes 1986-1999 ফ্রান্সের অভিজাত প্রকাশনী গালিমার থেকে বেরিয়েছে ২০০৩ সালে। মাত্র ৫ বছর বয়সে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত শিশুদের রেখাচিত্র প্রতিযোগিতায় শঙ্কর পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। আর মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের পার্স স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কবিতা। অর্থাৎ বর্ণমালা, রং ও রেখা এবং সর্বোপরি আলোছায়ার এই বিস্ময়-বালক কার্লোস ফুয়েন্তেস লেমুস পিতার শৈল্পিক রক্তধারাকে বহন করছিল। কিন্তু যে রক্ত প্রবাহের ফলে আমরা জীবন্ত, আর যা নিশ্চয়তা দেয় প্রাণস্পন্দনের, সেই রক্তই হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘাতক; হেমোফিলিয়া। এটি এমনই এক ঘাতক ব্যাধি যা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না; ক্ষতস্থানে রক্ত যদি জমাটই না বাধে তাহলে মৃত্যু হয়ে ওঠে অবধারিত। মাত্র ২৬ বছর বয়সে কার্লোস ফুয়েন্তেস লেমুস মৃত্যুবরণ করেন। পিতা কার্লোস ফুয়েন্তেসের জীবনের এই ট্রাজেডি ক'জনই বা জানি? যেমন জানি না, বাইরে সুখী বলে মনে হওয়া রবীন্দ্রনাথের স্বজন হারানোর গভীর ক্ষতগুলো। পিতা কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রয়াত সন্তানের প্রতি মমতাকে মূর্ত করে তুলেছেন আত্মজের তোলা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আলোকচিত্রগুলোর হৃদয়গ্রাহী ভাষ্য রচনা করে। কারা এই আলোকচিত্রের আলোকিত ব্যক্তিত্ব? সংস্কৃতি-জগতের দেশি বিদেশি সব টাইটান যারা ছিলেন পিতার বান্ধব: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, নরমান মেইলার, হুয়ান গোইতিসোলো, উইলিয়াম স্টাইরন, কার্লোস সাউরা, আন্তোনিও সাউরা, হ্যারল্ড পাইন্টার, মহম্মদ আলী, লোলা বেল্ত্রান, গ্রেগরী পেক, আলবের্তো হিরোনেইয়্যা, জেকুলিন কেনেডি ও কার্লি সিমন, এডওয়ার্ড এলবি, হোসে লুইস কুয়েবাস, ব্রেইটেন ব্রেইটেনবাখ, হাকোবো বোর্হেস, সুজান সন্টাগ, জন কেনেথ গলব্রেইথ, বালেরি আদামি, রোমান পোলানস্কি, রবার্ট মিটচুম, গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি, হুলিয়ান রিওস এবং অর্ডে হেপবার্ন। এঁরা সবাই ছিলেন পিতার বন্ধু। একদিকে কার্লোস লেমুসের আলোকচিত্রে বিধৃত এঁদের প্রত্যেকের আদল ও অবয়ব, অন্যদিকে, পিতা কার্লোসের স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়নে এই ব্যক্তিত্বদের ভাষ্য গ্রন্থটিকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য, সংগীতের পরিভাষায় যাকে আমরা বলতে পারি যুগলবন্দি।
আরও পড়ুন- বিষয়ভাবনায় অভিন্ন হয়েও যেভাবে হাইনের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ
ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব
পেরসোনাস বইটি রচনাগত বৈশিষ্ট্যে একইরকম হলেও এটি কার্লোস ফুয়েন্তেসের একক বই। এতে আলোচিত হয়েছেন জ্যঁ দানিয়েল, আলফনসো রেইয়্যেস, লুইস বুনুয়েল, ‘গুরুবাক্য’ শীর্ষক ভুক্তিতে চার শিক্ষক (হোসে কামপিয়্যো, মারিও দে লা কুয়েবা, মানুয়েল পেদ্রোসো, ইগনাসিও চাবেস), ফ্রাঁসোয়া মিতেরা, আঁদ্রে মালরো, ‘গণমাধ্যম’ শীর্ষক ভুক্তিতে তিন ব্যক্তি (ফের্নান্দো বেনিতেস, টম উইকার, হেসুস দে পোলাঙ্কো), পাবলো নেরুদা, হুলিও কোর্তাসার, আর্থার মিলার, জন কেনেথ গলব্রেইথ, উইলিয়াম স্টাইরন, আর্থার স্লেশিঞ্জার, ‘অচেনা তিন নারী’ শীর্ষক ভুক্তিতে এডিস স্টেইন, আনা আখমাতোভা, সিমন ওয়েইল, ‘চেনা দুই নারী’ শীর্ষক ভুক্তি সুজান সন্টাগ আর মারিয়া সাম্ব্রানো, এবং মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট লাসারো কার্দেনাস। প্রথম বইটির কোনও কোনও ব্যক্তিত্ব এই দ্বিতীয় গ্রন্থে এসে জুড়ে বসলেও, তাঁদের সম্পর্কে আগের ভাষ্য এখানে পেয়েছে বিস্তৃতি, হয়েছে পরিমার্জিত, কোথাও কোথাও তথ্য ও ব্যাখ্যার যোগফলে অর্জন করেছে পূর্ণতা। অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই সখ্যসূত্রে এবং কর্মগুণে ফুয়েন্তেসের আগ্রহের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। স্বল্প পরিসরে এঁদের সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়, তবে দু'-একজন সম্পর্কে ফুয়েন্তেসের পর্যবেক্ষণ তুলে না ধরলে এই উল্লেখ নিতান্তই কঙ্কালসার বলে মনে হবে পাঠকদের কাছে।
আলফনসো রেইয়্যেস
মেক্সিকান লেখক আলফনসো রেইয়্যেস সম্পর্কে আজকের পাঠক কতটা অবগত তা নিয়ে আমার সংশয় এই কারণে যে, তিনি বাংলা ভাষায় বলতে গেলে একেবারেই অনূদিত হননি, কিন্তু তিনি জীবদ্দশায় একাধিকবার সম্ভাব্য নোবেল প্রাপকদের তালিকায় ছিলেন। হোর্হে লুইস বোর্হেস তাঁকে স্প্যানিশ ভাষায় Finest Prose wrtier হিসেবে কেবল উল্লেখই করেননি, তাঁকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন। অক্তাবিও পাস ও এবং কার্লোস ফুয়েন্তেসের সাহিত্যিক গুরু হিসেবেও গণ্য হয়েছেন উভয়ের কাছে। মেক্সিকো ও এর সাংস্কৃতিক সত্তার আবিষ্কার করেছেন তাঁর অসামান্য প্রবন্ধের বইগুলোতে। লিখেছেন দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিজস্ব বয়ান। হেলেনিক সভ্যতার অনুরাগী রেইয়্যেস ছিলেন সত্যিকারের এক মননশীল ব্যক্তিত্ব। ফুয়েন্তেস তাঁর আত্মজৈবনিক এক লেখায় লাতিন আমেরিকায় ভাবুকতার জগতে আধুনিকতার দিশারীদের অন্যতম রেইয়্যেসকে গুরু, বন্ধু ও দিকনির্দেশকের ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। জীবদ্দশায় প্রকাশিত ফুয়েন্তেসের এই সর্বশেষ গ্রন্থ পেরসোনাস-এ এই গুরু আবারও আবির্ভূত হয়েছেন মেক্সিকোর ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও গোটা স্প্যানিশ সাহিত্যের পেক্ষাপটে। ফুয়েন্তেস তাঁর স্বভাবসুলভ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে তাঁর ভূমিকা, নানা সময় রেইয়্যেসের সঙ্গে আলোচনা ও আড্ডায় ফুয়েন্তেস তাঁর স্মৃতিকোশে যা জমিয়ে রেখেছিলেন তারই কিছু তিনি পরিবেশন করেছেন এই ভুক্তিতে। বোর্হেস সম্পর্কে তাঁর এক মন্তব্যের একটি অংশ এরকম:
“বোর্হেস সম্পর্কে তাঁর কী অভিমত? ‘তার একটিও অর্থহীন পৃষ্ঠা নেই’, বললেন রেইয়্যেস। তার অবাধ কল্পনাগুলো (Fantacias) যুক্তিনির্ভর কল্পরাজ্য, যদিও তা আমাদেরকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তার সামাজিক অভিজ্ঞতা বুয়েনোস আইরেসে জীবনযাপনের অন্ধকার কোণগুলোয় খুঁজে পাওয়া যাবে। বুয়েনোস আইরেস মানেই বোর্হেস কারণ উভয়ই হচ্ছে অভিবাসী আর ভাষাসমূহের এক মিশ্রণ।” (পৃ ২০)
এই কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার এই কারণে যে, বুয়েনোস আইরেস বহুভাষী ও বহু জাতির অভিবাসীর এক দেশ, একইভাবে বোর্হেসের ধমনীতে জাতিগতভাবে যেমন, তেমনি পাঠ ও লেখায় তার প্রয়োগের সূত্রেও, একাধিক জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহমান। ভাষার দিক থেকেও তিনি বুয়েনোস আইরেসের এক পূর্ণাঙ্গ কিংবা ততোধিক প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তাঁর আয়ত্তে ছিল স্প্যানিশ, ইংরেজি, আলেমান, ফরাসি, লাতিন, ওল্ড ইংলিশ, ইতালিয় এবং পর্তুগেস। কিন্তু কেমন ছিল স্বজাতি ও ভিন্ন জাতি, দেশ ও বর্হিবিশ্ব সম্পর্কে রেইয়্যেসের ধারণার জগত? কূটনৈতিক পেশার সূত্রে তো বটেই, এমনকী তাঁর নিজস্ব আগ্রহের কারণেও রেইয়্যেস ছিলেন জাতি ও স্বদেশের সীমা পেরিয়ে এক বিশ্বনাগরিক। ঠিক যেমনটা ছিলেন তার স্নেহধন্য বোর্হেস। কেবল মেক্সিকান লেখকদের জন্যই নয়, লাতিন আমেরিকার পরের প্রজন্মের লেখকদের জন্য তিনি এটাই শিখিয়েছিলেন যে বিশ্বসংস্কৃতির উপর আমাদের সবারই অধিকার আছে।
“আমার দেশের মানুষকে কেউ নিষেধ করেনি- এবং আমাকেও কেউ নিষেধ করুক, তা আমি চাইব না। জাতীয় হওয়ার একটা উপায় হচ্ছে মহত্তরভাবে সর্বজনীন হওয়া, কারণ সমগ্রকে বাদ দিয়ে আংশিককে বোঝা কখনোই সম্ভব নয়।” ( পৃ ২১)
সাহিত্য সম্পর্কে রেইয়্যেস কী ভাবতেন তা সংক্ষিপ্ত রূপে ফুয়েন্তেস লেখাটির শেষের দিকে তুলে ধরেছেন:
“রেইয়্যেসের মতে সাহিত্য আত্মার এমন এক অবস্থা যা পবিত্রতা বা নাট্যময়তার দিকে নিয়ে যায়। এটি নিজেকে অতিক্রমকারী এক শব্দ, এ হচ্ছে ভাষার মধ্যে আরেক ভাষা। সাহিত্য এমন এক কাল্পনিক ঘটনা বর্ণনা করে অনিবার্যভাবেই যার সম্পর্ক নেই বাস্তবের সঙ্গে। তবে যা বাস্তব তাকে সে নির্মাণ করে, যুক্ত করে এমন কিছু যা আগে ছিল না। সাহিত্য শুধু প্রতিফলনই নয়, বাস্তবের নির্মাণও।” (পৃ ২২)
লুইস বুনুয়েল
চমকপ্রদ ঘটনার বয়ান আছে সিনেমার দার্শনিক লুইস বুনুয়েলকে নিয়ে। অনেকেই হয়তো জানেন, বুনুয়েলের সঙ্গে ফুয়েন্তেস সিনেমায় কাজও করেছেন। বুনুয়েলের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। বুনুয়েল নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়নের দীর্ঘ আলাপে যাব না, কারণ সেই সুযোগ নেই। সিনেমার ভাষা ও কাঠামো বদলে দেওয়া এই পবিত্র উন্মাদ যে পিস্তলের এত আসক্ত ছিলেন তা আমরা কে-ই বা জানতাম! ফুয়েন্তেস তাঁর বাসায় গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন পিস্তলের এক বিরল সংগ্রহ, যেখানে ১৭ থেকে শুরু করে ১৮ শতকের পিস্তলও রয়েছে। সেগুলোরই একটি দিয়ে ছেলে হুয়ান লুইসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নামলেন। ছেলে তাঁর বাবাকে বলল, বাবা, তুমি আগে টেলিফোনের গাইড বইটাতে গুলি কর। করলেনও তাই। বইটিকে গুলি করে ফুটো করে দিলেন। ১৯৬৭ সালে যখন তিনি ভেনিসে উৎসবে সোনার সিংহ পুরস্কৃত হিসেবে পেলেন তখন তিনি ফুয়েন্তেস আর হুয়ান গইতিসোলোকে বললেন, এবার গুলি বানানোর জন্য পুরস্কারটা গলিয়ে ফেলব। এই হচ্ছেন সিনেমার আড়ালের বুনুয়েল।
আর এই বুনুয়েলকে নিয়ে তাঁরই বন্ধু সালবাদর দালি কী করলেন? সবাই জানেন, দালি ছিলেন বুনুয়েলের জানেদোস্ত, একসঙ্গে তাঁরা সিনেমাও বানিয়েছেন। বলতে গেলে হরিহর। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দালি এলেন নিউ ইয়র্কে, পত্রিকা তাঁর সাক্ষাৎকার নিল। দালির পুরনো বন্ধু বুনুয়েলকে তিনি আখ্যায়িত করলেন নৈরাজ্যবাদী, কম্যুনিস্ট, নাস্তিক, যৌন-উন্মাদ এবং আরও কিছু বলে। পত্রিকা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দালির এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করল। বুনুয়েল এই সাক্ষাৎকার দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। স্বজাতি, তাঁর চেয়েও বেশি বন্ধু হয়ে দালি এই কুৎসা করতে পারল! অচিরেই দু'জনের দেখা হলো নিউ ইয়র্কের শেরি-নেদারল্যান্ড হোটেলে।
“পুরনো বন্ধুর মুখোমুখি হয়ে বুনুয়েল বললেন; তোর খোমাটা ভচকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি। কিন্তু তোকে দেখার পর আমাদের বন্ধুত্বের পুরনো স্মৃতিগুলোর জন্য সেই কাজটা করতে পারলাম না...
—কিন্তু লুইস! বিস্মিত হয়ে দালি বললেন—আমি তো আসলে আমার নিজের প্রচারণার জন্য ওটা করেছি!" টেসে যাওয়া বুনুয়েলের প্রতিশোধটি পরে নিয়েছিলেন ম্যাক্স এর্নস্ট, আরেক শিল্পী, দু'জনের সহযাত্রী এবং বন্ধু। নিউ ইয়র্কেই পেয়ে গেলেন তিনি দালিকে। এর্নস্ট কাছে এসে দালির হাতে থাকা ছড়িটা প্রথমে ভাঙলেন, তারপর ওই ভাঙা ছড়ি দিয়েই দালির মাথা আঘাত করে বললেন: বুনুয়েলের বদলা নিলাম!” (পৃ ৩৩)
আরও পড়ুন- সত্তার দ্বৈত রূপে রবীন্দ্রনাথ ও বোর্হেস: ভাবনার যমজ সন্তান
পাবলো নেরুদা
নেরুদার কথা তো আমরা সবাই কম বেশি জানি। বহু বাঙালির হাতে তিনি অনূদিত হয়েছেন। যার শুরু বোধহয় সেই তিরিশের সমাজতান্ত্রিক ধারার অগ্রগণ্য কবি বিষ্ণু দে-র মাধ্যমে। এরপর এই ধারায় ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয়েছেন বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শক্তি ও সুনীলসহ আরও অনেকে। তাঁকে নিয়ে কলকাতা থেকে গবেষণাধর্মী বইও বেরিয়েছে। আর একথা কে না জানেন যে, তিনি বিশ শতকের মহত্তম কবিদের একজন। কী কারণে তিনি মহৎ তার নিশ্চয়ই অনেক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু কথাসাহিত্যিক ফুয়েন্তেস কবি নেরুদাকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তা এক কথায় চক্ষুউন্মীলক তো বটেই, এমনকী তা আবিষ্কারের অভিনবত্বেও চিত্তাকর্ষক। ফুয়েন্তেস ইতিহাসকে কল্পনা দিয়ে বাস্তবগ্রাহ্য করে তোলেন যা একইসঙ্গে স্পর্শময়, সজীব ও সংরক্ত। বাস্তবতাকে আখ্যানধর্মী বর্ণনার মাধ্যমে যাত্রা করেন সত্যের কাছাকাছি যা কেবল কল্পনা দ্বারা পূর্ণতা ও বিশুদ্ধতা অর্জন করতে পারে। ফুয়েন্তেস এই দুইয়ের কাঁধে জুড়ে দেন তাঁর ছন্দোময় ভাষার জোয়াল। নেরুদাকে তিনি আমাদের সামনে যেভাবে তুলে ধরেন তা কেবল সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকলেই সম্ভব। কী বলেন তিনি? তার চেয়ে বড় কথা কীভাবে বলেন তিনি?
“ঘটনা ছিল এরকম যে আমেরিকা সৃষ্টির সপ্তম দিনে শয়তানের মতোই ঈশ্বর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আর তখন পাবলো নেরুদা শব্দ দিয়ে সবকিছুকে ব্যাপটাইজড করে নিলেন।” এভাবেই শুরু করেছেন ফুয়েন্তেস। এরপর তিনি উপনিবেশিক স্পানঞার সঙ্গে তুলনা টেনে নেরুদার স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরেন এভাবে: “কনকিস্তাদোররা চিলেকে বলতো নতুন সীমান্ত (Nuevo Extremo)। গোলার্ধের এই শেষ সীমা থেকে ক্রিস্তোবাল কোলোনের জাহাজগুলো স্পানঞায় ফিরিয়ে দিলেন। রুবেন দারিওর পরে তিনি ছিলেন ১৭ শতক-পরবর্তী স্প্যানিশ ভাষার মহান কবি। কেবেদো ও গঙ্গোরার হারিয়ে যাওয়া স্বরগুলো তিনি আবিষ্কার করেন। এ ছিল বিজয়ী স্প্যানিশদের প্রতি ইস্পানোআমেরিকার সাংস্কৃতিক সাড়ার এক অগ্রবর্তী রূপ। বহ শতাব্দীর সামাজিক রীতিনীতি, মাঝারি মান, ভয়, বাগাড়ম্বর আর ধর্মীয় নিপীড়নের (Inquisicion) কারণে যে-ভাষা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন একই সঙ্গে সাবেকি ও সাম্প্রতিক প্রাণবন্ততা। নেরুদার কাব্যিক অভিযান ছাড়া লাতিন আমেরিকায় আধুনিক সাহিত্য সম্ভব হতো না। কিংবা আমরা যা চিনেছি, আমরা যার তারিফ করি এবং আমরা যা ধরে রেখেছি, অন্তত সেটা হতো না।” (পৃ ১৩০)
…গোটা লাতিন আমেরিকা তাঁর ভাষায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাঁর কবিতা আমাদেরকে পাঁচ শতাব্দীর হারানো ইতিহাসকে ফিরিয়ে দিয়েছে, যে ইতিহাস শূন্যগর্ভ বাগাড়ম্বর আর বিশাল ঘোষণার মুখোশ পরা, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ আর অভ্যন্তরীণ নিপীড়নের দ্বারা যে ইতিহাসের অঙ্গহানি করা হয়েছে, যে ইতিহাস বহুজনের আক্রান্ত নীরবতা আর অল্প কিছু লোকের আক্রমণাত্মক মিথ্যাচারে বিকৃত হয়ে আছে।” (পৃ ১৩১)
ফুয়েন্তেসের ভাষায়, নেরুদা আসলে একটা গোটা মহাদেশের আনন্দ বেদনা, অপমান ও অর্জন, ইতিহাস ও বিকৃতিকে অভিন্ন করতলে জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু নেরুদার এই আইফেল অর্জনের পাশেই রয়েছে এমন কিছু দিক যার উল্লেখ না করলে তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ অবয়ব আমরা দেখতে পাব না।
রাজনীতি, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ ছিল তাঁর কাব্যবিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতম সহচর। এক সময় তিনি চিলের কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি চিলের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীও হয়েছিলেন, পরে অবশ্য সালবাদর আইয়্যেন্দেকে সমর্থন জানিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এই রাজনীতি তাঁকে যেমন দিয়েছে মহিমা, আবার তাঁর ভাগ্যে এনে দিয়েছিল নিন্দা ও আশাভঙ্গও। এর জন্য কেউ কেউ, অক্তাবিও পাস তো বটেই, দায়ী করেছিলেন নেরুদার অত্যধিক স্তালিনপ্রীতি যা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল স্তালিন সম্পর্কে একাধিক প্রশস্তি। কিন্তু স্তালিন কর্তৃক লেখকসহ অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ হত্যার ঘটনা পত্রপত্রিকায় তথ্য প্রমাণসহ বেরিয়ে এল, তখন তিনি হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন। নেরুদার অন্য একটি রাজনৈতিক ঘটনার জন্য অভিযুক্ত হয়ে আছেন, সেটি মেহিকোতে সংঘটিত।
সবাই জানেন যে, স্তালিনের দু'চোখের বিষ মেহিকোয় নির্বাসিত ট্রটস্কিকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৪০ সালের ২০ অগাস্ট। তবে মাস তিনেক আগে আরও একবার তাঁকে হত্যা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন মেহিকোর বিখ্যাত কম্যুনিস্ট চিত্রশিল্পী দাবিদ আলফারো সিকেইরোস। তাঁরা ট্রটস্কিকে আক্রমণ করলেও এ যাত্রায় বেঁচে যান। কিন্তু সিকেইরোস হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার প্রথমে গা ঢাকা দেন, পরে নেরুদার উদ্যোগে মেহিকো ছেড়ে চিলেতে যাওয়ার সুযোগ পান। নেরুদা তখন মেহিকোয় চিলের রাষ্ট্রদূত। ১৯৩৯ সালে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শহর চিলের চিইয়্যান-এ এক বিদ্যালয়ে মুরাল আঁকার জন্য সিকেইরোসকে ভিসা দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। এও ছিল নেরুদার বিরুদ্ধে অন্ধ স্তালিনপ্রীতির আরেকটি অভিযোগ।
তবে নেরুদা শেষ পর্যন্ত গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হবেন তাঁর লেখার জন্য। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা ভূমিকা তাঁর কাব্যাবিচারের ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যাবে। ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক ভূমিকা যা-ই হোক না কেন, তাঁর লেখায় এর ভূমিকা কেবল স্বাতন্ত্র্যেরই স্মারক হয়ে ওঠেনি, তাঁকে মহিমাও দিয়েছে। তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল অসংখ্য নেতাকর্মী এবং সাহিত্যানুরাগীকে করেছে অনুপ্রাণিত। রাজনৈতিক এই অঙ্গীকার চিলিবাসীদের কাছে তাঁকে করে তুলেছিল প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর নিজের জাতিকেও তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে চেয়েছিলেন তাঁদের ভাগ্য ফেরাতে। আর দ্বৈত দায়িত্ব কেবল নেরুদারই নয়, লাতিন আমেরিকার বহু লেখকই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এক সাক্ষাতে ফুয়েন্তেসকে তিনি বলেছিলেন, “আমরা, লাতিন আমেরিকান লেখকরা উড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ডানায় রয়েছে আমাদের জনগণের রক্তের ভার।” (পৃ১৪২)। নেরুদা আজীবন এই ভার বহন করেছিলেন স্বেচ্ছায় ও সানন্দে।
আরও পড়ুন- নজরুলকে এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমরা: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল
হুলিও কোর্তাসার
এই গ্রন্থে ফুয়েন্তেস লিখেছেন লাতিন আমেরিকার আরেক লেখককে নিয়ে যিনি আর্হেন্তিনার, ফুয়েন্তেসেরই সহযাত্রী যাঁকে তিনি অন্য এক লেখায় অভিহিত করেছিলেন উপন্যাসের সিমন বলিবার হিসেবে। বলিবারই বটে, কারণ উপন্যাসের কাঠামো ও বিষয়বস্তুকে প্রথাগত ধারণার উপনিবেশ যেভাবে কব্জা করে রেখেছিল, হুলিও কোর্তাসার তাকে মুক্তি দেন, তাকে বলিবারের মতোই স্বাধীন করেন। উপন্যাসকে তিনি নতুন প্রকরণ ও কল্পনার মাধ্যমে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী করে তোলেন, যে স্বেচ্ছাচার কথাসাহিত্যকে নতুন বিন্যাসে নবীন ও ভবিষ্যতমুখী করে তুলেছে; Rayuela একাই হতে পারে তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। কিন্তু কোর্তাসারের আছে আরও বহু নির্মাণ আর সৃষ্টি। তার ছোট গল্প Casa Tomada প্রকাশিত হয়েছিল স্বয়ং বোর্হেস সম্পাদিত পত্রিকায় যখন কোর্তাসার কৈশোরও পেরোননি।
রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে মার্কেসের মতোই ছিলেন আজীবন বামপন্থী। কিন্তু কারও সাহিত্যকেই শুধুই বামপন্থী আদর্শ দিয়ে বিচার করতে চাননি কখনই। এ কারণে ভিন্নমতের হওয়া সত্ত্বেও মারিও বার্গাস যোসা বা ফুয়েন্তেসেরও তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৬০ সালে প্যারিসে যখন ফুয়েন্তেস কোর্তাসারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন ঘরের দরজা যিনি খুলে দিলেন ফুয়েন্তেস তাঁকে আর্হেন্তিনিয় আঞ্চলিক ভাষায় বললেন:
“--এই ছেলে, তোমরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
--আমিই সে। ”
এভাবেই প্রথম পরিচয় কোর্তাসারের সঙ্গে। কোর্তাসারের বয়স তখন ৪৬ হলেও দেখতে কম বয়সি মনে হতো। ১৯৬৮ সালে মার্কেস ও কোর্তাসারসহ ফুয়েন্তেস প্যারিস থেকে ট্রেনে করে গিয়েছিলেন প্রাহায় কুন্ডেরার আমন্ত্রণে। এই দীর্ঘ ভ্রমণ নাকি অথৈ আনন্দে উপচে পড়েছিল মুলত কোর্তাসারের কারণে। এই মানুষটি ছিল এক আনন্দ কারণ ওর সংস্কৃতিটাই হচ্ছে আনন্দের। ট্রেনের বার-এ বসে সসেজ আর বিয়ার খেতে খেতে কোর্তাসার আলাপ জুড়ে দিলেন গোয়েন্দা কাহিনির, শার্লক হোমস থেকে শুরু করে আগাথা ক্রিস্টি, গ্রাহাম গ্রিন থেকে আলফ্রেড হিসকক। কোর্তাসার ছিলেন সংগীতেও জবরদস্ত হাফেজ, জ্যাজ সম্পর্কে জানতেন খুঁটিনাটি। থেলোনিয়াস মোঙ্ক, চার্লি পার্কার কিংবা লুইস আমস্ট্রং-এর সুরের জটিল চলাচল ছিল তাঁর নখদর্পণে।
কোর্তাসার বহুদিন, মানে কয়েক দশক পর কোর্তাসারকে তিনি আবারও স্মরণ করলেন ফুয়েন্তেস তাঁর এই নতুন বইয়ে এবং অবশ্যই এ অবধি অকথিত বহু ঘটনার আলোকে। স্মৃতিচারণ আর মূল্যায়নের দুই ধারার মিশ্রণ ঘটিয়ে লেখাটিকে করে তুলেছেন অনন্যসাধারণ। যেমন কোর্তাসারের Rayuela সম্পর্কে এই লেখাটি যা বলেছেন তা নতুন করে এর পাঠককে পথ দেখাবে,
“এক্কাদোক্কা (Rayuela) হচ্ছে এমন এক উপন্যাস যেখানে লেখার পদ্ধতিটাই হয়ে ওঠে অ-লেখা, একটি ভাষা উপহার দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টি করে একটি প্রতি-ভাষা। ধন্যাত্মক ব্যঞ্জনা ও অভিনব শব্দবন্ধ উপন্যাসটিকে লাফ দিতে সহযোগিতা করেছে। কোর্তাসারের নির্দিষ্ট কিছু সিঁড়ি কেবল উপরে ওঠার জন্য, অন্যটি নীচে নামার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।” (পৃ ১৫২)
কোর্তাসারের সঙ্গে ফুয়েন্তেসের সম্পর্কটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেমন প্রগাঢ় ছিল, তেমনই তা সাহিত্যিক কারণেও ছিল অচ্ছেদ্য। ফলে ১৯৮৪ সালে কোর্তাসারের মৃত্যুতে ফুয়েন্তেসের মনে হয়েছিল অবিভক্ত আয়নাটি যেন ভেঙে গেল যে আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছিল লাতিন আমেরিকার ভূত ও ভবিষ্যত এবং দুঃস্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে ভূতুড়ে বাস্তবতার জটিল রূপ।
“হুলিও মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আয়নার অংশবিশেষ ভেঙে গিয়েছিল আর আমরা সবাই দেখতে পেলাম রাত্রি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে (ফুয়েন্তেস এখানে La Noche Boca Arriba—‘চিৎ হয়ে থাকা রাত্রি’ শীর্ষক গল্পটির পরোক্ষোল্লেখ করেছেন)। এখন আমরা চাই, ঠিক যেমনটা পরে বলেছিলেন মার্কেস, যে মহান ক্রোনোপিও (Cronopio হচ্ছে আখ্যানে ব্যবহৃত কোর্তাসারের কাল্পনিক চরিত্র) প্রমাণ করুক কোর্তাসারের মৃত্যু ছিল সংবাদপত্রগুলোর অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন আর যে লেখক আমাদেরকে এই সভ্যতা দেখতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে এবং জীবনযাপন করতে শিখিয়েছে, সে এখন এখানেই আছে, আর আছে কেবল অদৃশ্য হয়ে তাদের জন্য যারা ক্রোনোপিও-তে বিশ্বাস করে না।” (পৃ : ১৫৮)
স্মৃতি, আবেগ, মূল্যায়ন আর সশ্রদ্ধ ভালোবাসায় সিক্ত এই লেখাটি পড়লে রক্ত-মাংসের কোর্তাসারকে যেন স্পর্শ করা যায়। ফুয়েন্তেসের প্রাণোচ্ছ্বল গদ্য আর উপলব্ধির মায়াবী আখরে কোর্তাসারকে যেন বিদায় জানাচ্ছে না, বরং আরও বেশি মমতায় আর মননের সমস্ত আভিজাত্য দিয়ে আলিঙ্গন বেঁধে রাখছেন।
আরও পড়ুন- অক্তাবিও পাসের চোখে রবীন্দ্রনাথ: রেখা ও রঙের গায়ক
গ্যালব্রেইথ
লেখাটি শেষ করব কানাডিয়-মার্কিন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী জন কেনেথ গ্যালব্রেইথ নিয়ে ফুয়েন্তেসের লেখাটি নিয়ে। যদিও আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে স্বতন্ত্র ভুক্তি রয়েছে কিন্তু সবাইকে নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখাটি এত দীর্ঘ হয়ে যাবে যে পাঠক ধৈর্য হারিয়ে ফেলবেন।
গ্যালব্রেইথ অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যেকার পারস্পরিক প্রভাব ও সম্পর্ক নিয়ে অত্যন্ত গভীর আলোচনা সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বই লিখেছেন। সারা পৃথিবীর অগ্রসর চিন্তার লেখক বুদ্ধিজীবী মহলে এগুলো কেবল আদৃতই নয়, এর প্রভাবও রয়েছে। ফুয়েন্তেস নিজেও তার এক গুণগাহী পাঠক। গ্যালব্রেইথ তাঁর কাছে বিশ শতকের অগ্রগণ্য অল্প কয়েকজন ভাবুকদের একজন। তাঁর চিন্তার নানা দিকের গভীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তিনি ১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ লেখাটিতে তুলে ধরেছেন। এই লেখাটি থেকে আমি কয়েকটি উদ্ধৃতি দেব যাতে পাঠক বুঝতে পারেন গ্যালব্রেইথ ভাবনার গুরুত্ব আর ফুয়েন্তেসের পক্ষপাতের যথার্থ কারণ।
“গ্যালব্রেইথ অভিযোগ তুলে বলেন আমেরিকায় অবৈধদের যদি বহিষ্কার করা হয় তাহলে অর্থনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া হবে বিপর্যয়কর। এমন সব কাজ/চাকরি থাকবে যা কেউ করতে চাইবে না। অনেক ক্লান্তিকর কিন্তু দরকারি কাজ বাস্তবায়িত হবে না। ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস এবং ফ্লোরিডার মতো অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোয় ফল ও সবজি তোলার লোকই থাকবে না। খাদ্যদ্রব্যের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে। মেক্সিকানরা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চায়। চায় প্রয়োজনের তাগিদে। গ্যালব্রেইথ যুক্তি দিয়ে বলেন— তারা দৃশ্যত আমাদের মঙ্গল সাধন করছেন। তাদের ছাড়া, মার্কিন অর্থনীতি দুর্ভোগের মুখে পড়বে।” (পৃ ১৭৯)
কিন্তু বহিরাগত অভিবাসী ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলাকাভেদে যে প্রাচুর্য ও দারিদ্রের কারণ তাও গ্যালব্রেইথের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে যে ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে সেই দিকেও তিনি ইঙ্গিত দিতে ভোলেন না। “কেউ-ই, গ্যালব্রেইথ মনে করেন, দৈব ইচ্ছায় দরিদ্র নয়, দুর্ভোগ তাদের প্রাপ্য নয়...। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দারিদ্রের পেছনে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা কিংবা প্রাচুর্য মূল কারণ নয়। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আছে কিন্তু তারপরও সেটি দরিদ্র। কানেকটিকাটের নেই, তারপরও সেটি ধনী এলাকা।” (পৃ ১৮০)
গ্যালব্রেইথ-কথিত এই দারিদ্রের সূত্রে ফুয়েন্তেস বলেন: “কিন্তু কেইনস সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন যে অর্থনীতি মানবজাতির স্থায়ী সমস্যা নয়। পৃথিবীর একপাশের দারিদ্র পৃথিবীর অন্যপাশের প্রাচুর্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বহির্বিশ্বকে নরকে রেখে আমরা একটা অভ্যন্তরীণ স্বর্গ বানাতে পারি না।” (পৃ ১৮১)
২৬টি উপন্যাস, ১১ টি গল্পগ্রন্থ, ১৬টি প্রবন্ধের বই, ৫টি নাটক আর ৭টি চিত্রনাট্যের রচয়িতা ফুয়েন্তেস এই গ্রন্থে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাসের এমন সব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যাঁরা ইতিমধ্যে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও, তাঁর অভিজ্ঞতা ও ভাষ্যে নতুন মাত্রায় আবির্ভূত হয়েছেন।