বাজার করা একটা আর্ট! কাঁচা সবজির বাজারে যেভাবে মিলে যায় বঙ্গ-ফরাসি মন
French Vegetable Market: পাড়ার বাজারগুলি উঠে গেলে সামাজিক আদানপ্রদানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু আমরা হারিয়ে ফেলব। কলকাতায়, মার্সেই-তে, প্যারিসে, মুম্বইয়ে, সর্বত্র।
সবজি বাজার বেড়ানো আমাদের পারিবারিক নেশা। বিশেষত শীতবাজার। পিঁয়াজকলি, লাল গাজর, কুট্টি ফুলকপি, মুলোশাক, কচি পালং। মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করে। কাজলদির হাত নিশপিশ করে। কিছু কেনার না থাকলেও আমরা মাঝেমধ্যে এমনি বাজারে হেঁটে আসতাম। মন ভালো হতো। দু’একজনের সঙ্গে কথা হতো।
ফ্রান্সের মার্সেই শহরে এসে দেখি, সব পাড়ায় জমজমাট বাজার। খোদ বাজারের মধ্যেই আমার বাড়ি। জানলা থেকে নীচে দেখা যায় সওদাগরের পসরা। খোলা বাজার। টাটকা ফল-সবজি, কাঁচা মাছ, ঝুলন্ত মাংসের রকমারি, কাজু পিস্তা। ছিপ ছুঁড়ে ধরা যায় তরতাজা লাল-হলুদ-কমলা ক্যাপসিকাম। গল্ফকার্ট করে লেবু আসে। বোঁটায় সবজে পাতা সুপারমার্কেট থেকে কিছুটা দূরে আর প্রকৃতির খানিক কাছাকাছি যাপনের ইলিউশন সৃষ্টি করে। এই শহরে উত্তর আফ্রিকা আর আরব্য প্রভাব ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান। বাজারের গঠনও খানিকটা সেরকম, খোলা চত্ত্বরে ঢালাও বিক্রি। হাঁক পেড়ে খদ্দের ডাকছে দোকানি। ‘হরেক মাল দশ টাকা’, ‘ফ্রেশ, ফ্রেশ, সব ফ্রেশ’। ভাষা বদলায়, পাড়া বদলায়, দোকানির সুর বদলায় না।
একার সংসারে সামান্যই বাজার। তাও অফিস ফেরার পথে রোজ যাই। ছুটির দিনে সক্কাল সক্কাল। মন ভালো নেই, বাজার চলো। শরীর ফিট নেই, বাজারে কী এল? মেজাজ ফুরফুরে, দেখে আসি কী পাওয়া যায়! কর্পোরেট ষড়যন্ত্র এড়িয়ে দিব্যি একটা রসুন, দুটো আপেল, তিনটে লঙ্কা, একমুঠি শিম কিনে দোকানির সঙ্গে গল্প করে ফেরা যায়। ফ্রেশ হার্ব বাস্কেটে হাত ডুবিয়ে দেখি থাইম আছে, রোসমেরি, মিন্ট, পার্সলে, সেজ। সব চেয়ে আছে। কিনব না কোনওটাই, সামান্য ভাব বিনিময়ে আকাশ-বাতাস এসেনশিয়াল অ্যারোম্যাটিক অয়েলের সুবাসে আটখানা করে বাড়ি ফিরি।
এই ধরনের বাজার ঘুরলে আমার বারাসাতের বড়বাজারের কথা মনে পড়ে। চেনা দোকান ছাড়া বাড়ির আনাজ আসে না, চেনা দোকানির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে হাঁক পাড়ে, কী দিদি, আজ কিছু কিনলে না যে! এখানেও চেনাশোনা সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে। শনিবারের বাজার দু’সপ্তাহ বাদ পড়লে দোকানি চিন্তিত প্রশ্ন করে, "আসনি কেন? শরীর খারাপ না দেশে গিয়েছিলে?"
আরও পড়ুন- রেডিওর সুরে এক হয়ে যায় আজও ফরাসি আর বাঙালিরা?
আগে ভাবতাম কেবল মার্সেইতেই এরকম আতিথেয়তা-আত্মীয়তা সম্ভব। দক্ষিণের শহর, ভূমধ্যসাগরীয় গন্ধ, লোকজন অনেক হালকা চালে জীবন কাটায়, এদের হাতে অঢেল সময়, অকাজের কথা বলে আড্ডা দিতে এরা ভালোবাসে। উত্তরের দিকে সব কেজো হিসেব-নিকেশ! এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে ফ্রান্সের নানা শহর-গ্রাম ঘুরে দেখলাম, খাদ্য-পানীয় বদলায়, কথার সুর বদলায়, পোশাক আশাক খানিক বদলায়, ভাষার ব্যবহার অন্যরকম হয়, কিন্তু ফরাসি বাজারের চেহারা মোটামুটি এক। সপ্তাহের কোনও একদিন, কোথাও প্রতিদিন, শহর বা গ্রামের রাজপথ জুড়ে কাঁচা বাজার বসে। আশেপাশের কৃষক পরিবার তাদের ফসল নিয়ে আসে। কেবল কাঁচা বাজার নয়, আঞ্চলিক বেকারি, মিষ্টির দোকান, রেস্তোরাঁ সবাই তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। যেন বাজার নয়, মেলা!
গরম গরম জলখাবার বিক্রি হচ্ছে, টুকটাক খেতে খেতে সপ্তাহের কেনাকাটা সেরে পরিবার মিলে ঢুকে পড়বে রেস্তোরাঁয়। সেখানে দেখা হবে প্রতিবেশীর সঙ্গে বা বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে, অথবা পাশের গ্রামে থাকা অনেক দিন দেখা না হওয়া আত্মীয়র সঙ্গে। জমে উঠবে আড্ডা, বাজার বিনিময়। কে কী কিনল, কার থেকে কিনল, কোথায় কম দামে একই জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, এসব আলোচনা।
বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ফ্রান্সে কৃষকরা ছিল বৃহত্তম সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। আজকের দিনে ফ্রান্সে কৃষকদের আর আলাদা করে অর্থনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না, যদিও এই ঐতিহ্যবাহী জীবনধারাকে সংরক্ষণ করার জন্য বহু প্রচেষ্টা চলছে।
ফরাসি বিপ্লবের আগে একদল ধনী কৃষক ও ব্যবসায়ীর রোজগার বাড়ে কারণ তারা কৃষিক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারে। এর ফলে দরিদ্র কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং উৎপাদনে পতন ঘটে। কৃষকদের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকে। তার ওপর যুক্ত হয় দেশের অর্থনৈতিক সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফসল উৎপাদনে ব্যর্থতা এবং বাড়তি কর। সব মিলে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে করে, শেষ পর্যন্ত ফিউডাল সিস্টেম ভেঙে নিজের জমি এবং ফসল উৎপাদনের অধিকারের দখল নেয়। শিল্পায়ন পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজের আধুনিকীকরণের ফলে গ্রামীণ অঞ্চলগুলি একটি আধুনিক ফরাসি আইডেন্টিটি তৈরি করে। Peasants into Frenchmen (১৯৭৬) বইতে ইতিহাসবিদ ইউজিন ওয়েবার লিখেছেন, উনিশ থেকে বিশ শতকের শুরুর দিকে গ্রামীণ ফ্রান্স পিছিয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে আধুনিক এক ফরাসি জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি অর্জনের দিকে এগিয়ে চলে। যদিও কিছু সমালোচক মনে করেন যে, এর অনেক আগেই আঞ্চলিক পরিচিতির গর্ব ফ্রান্সে ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর যান্ত্রিকীকরণ, সার এবং আধুনিক প্রযুক্তি কৃষি আউটপুট বাড়ালেও, কৃষকদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। ১৯৪৬ সালে ৭.৪ মিলিয়ন থেকে ১৯৭৫ সালে ২ মিলিয়নে নেমে আসে ফরাসি কৃষক সম্প্রদায়। আর সব জায়গার মতোই গ্রামের মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে শহরমুখী হয়, অন্যান্য জীবিকা বেছে নেয়। জনশূন্য খামারগুলি শহরের শ্রমিকদের ছুটির বাড়িতে পরিণত হয়। গ্রামীণ জীবনের নস্টালজিয়ায় মাঝেমাঝে এরা ফিরে আসে। এই গ্রামীণ পশ্চাদপসরণ রুখতে এবং কৃষকদের সাহায্যার্থে, মূলত সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ১৯৩০ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে, যা কথায় পরে আসছি।
ভারতের কৃষিব্যবস্থার দিকে তাকালে ঘটনার খুঁটিনাটি না মিললেও গল্পের শেষটা খানিক মিলে যায়। জীবিকানির্ভর স্থানীয় কৃষিকাজ থেকে জমিদারি প্রথা পেরিয়ে ঔপনিবেশিক শোষণের থেকে একপ্রকার বিপ্লবী উত্তরণ হয়তো হয়েছিল ভারতীয় কৃষকদের। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী হলো? বাণিজ্যিক কৃষির প্রভাব কৃষকদের আর্থিকভাবে দুর্বল করে। ভূমি সংস্কার শুরু হয়। এই পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে কৃষকদের জন্য সুবিধাজনক মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা সবসময় কার্যকর হয়নি। সবুজ বিপ্লবের ফলে বড় কৃষকরা উপকৃত হলেও, ছোট কৃষকরা আর্থিক চাপে পড়ে। প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে চাষের কাজ ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে, তাদের ঋণগ্রস্ত করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতীয় কৃষকদের ৮৫%-এর বেশি পরিবার ঋণগ্রস্ত। কৃষির অবদান ভারতের জিডিপিতে ১৯৫০-এর দশকে ৫০% থেকে বর্তমানে প্রায় ১৮-২০%-এ নেমেছে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে কৃষিকাজ অলাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে, বিশেষত ছোট জমির মালিকদের জন্য। এর ফলে কী হয়েছে তা নিয়ে বিস্তৃত লেখার কথা আমার নয়, প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই জানা যায়।
কৃষিতে আয়ের অভাব এবং ঋণের চাপে প্রতি বছর বহু কৃষক আত্মহত্যা করছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (NCRB) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রায় ১০,০০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন দেশে। কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য দেশে সাম্প্রতিককালে কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে তবে এই পদক্ষেপগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ঋণ নির্ভরতা কমানোর জন্য যে সরকারি ভাতা বরাদ্দ তা যথেষ্ট কি? কৃষিকাজ বিমুখ ফরাসিকে লাভজনক জীবিকায় ফিরিয়ে আনতে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ফ্রান্সে উৎপাদিত যা পণ্যসামগ্রীকে মানচিত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে ১৯১৯ সালের উৎপত্তি চিহ্ন সংক্রান্ত আইনের মাধ্যমে। ফ্রান্সের রান্না এবং রেসিপি যেমন জগদ্বিখ্যাত, ফ্রান্সে উৎপাদিত সামগ্রীর কদরও জগত জোড়া। ফ্রান্সের সব পণ্য অঞ্চলভিত্তিক নামে চালু। এখানে যে কোনও বাজারে ঢুকলে শোনা যায় বিক্রেতার হাঁক— স্বাদে অতুলনীয় মেইন্সের হ্যাম দেখুন, নেভার্সের তিতির, ট্যুরের প্রুনস, প্রোভঁসের অলিভ নিয়ে যান! ইসিনির বিখ্যাত মাখন চাই? শ্যাম্পেনের ওয়াইন, লঁজের মেলন, এরকম আরও কত কত গ্রামগঞ্জের নাম চেনা যায় যে কোনও বাজারে ঢুকলে।
আরও পড়ুন-সর্ষের ভিতর ভূত না, সর্ষের মধ্যে সুখ পেয়েছে ভোজনবিলাসী বাঙালি ও ফরাসি
উনিশ শতকের ফরাসি আঞ্চলিক খাদ্য-সংস্কৃতির ইতিহাসবিদ ফিলিপ মেজি বলেন,
"১৮ শতকে দেখা যায় (ফরাসি) দক্ষতার বিশাল এক প্রদর্শনী। এখানে উৎপাদিত পণ্যগুলো অতীতের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং তারা পরিবর্তন, উদ্ভাবন এবং কৃষি বিশেষায়নের প্রতীক, যা ঘটছে নির্দিষ্ট গ্রামীণ এলাকায়।"
এই নির্দিষ্ট গ্রামীণ আইডেন্টিটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, কৃষিপণ্যের গুণমান এবং প্রামাণিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৩৫ সালে AOC (Appellation d'Origine Contrôlée) ব্যবস্থার সূচনা হয়। নিশ্চিত করা হয় যে, নির্দিষ্ট পণ্য নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে নির্ধারিত পদ্ধতিতে উৎপন্ন হবে। ১৯৯২ সালে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এই ধারণাটিকে আরও বিস্তৃত করে এবং AOP (Appellation d'Origine Protégée) ব্যবস্থা চালু করে। AOP এবং AOC লেবেল অর্থাৎ পণ্যটি উচ্চ মানসম্পন্ন এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হবে। এর ফলে কৃষকরাও ন্যায্য মূল্যে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন রক্ষা করতে পারে। রোকফ চিজ, বার্গান্ডি ওয়াইন, ডিজঁ মস্টার্ড (যা নিয়ে আগের পর্বে লিখেছি), এমন নানা ফরাসি সামগ্রী এই লেবেলের অধীনে রক্ষিত— অঞ্চলের ঐতিহ্য এবং অর্থনীতিও রক্ষা করছে। অঞ্চল ভিত্তিক সামগ্রীর প্রচলনের পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতাও বাড়ছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলি পরিবহন দূরত্ব কমায়, যা কার্বন এমিশন হ্রাসে সহায়ক। মানুষ সুস্থ, স্থানীয় খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে। আঞ্চলিক এবং জাতীয় টেলিভিশনে ঘোষণা করা হয়, স্কুলে বাচ্চাদের শেখানো হয়, বছরে কোন সময়ে কোন ফল-সবজি মরশুমি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে কোনগুলি। অর্থনীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য সব মিলিয়ে ব্যক্তি এবং সামাজিক স্তরে সচেতন হচ্ছে ফ্রান্সের মানুষ। Peasants into Frenchmen-এ যে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়ে জাতিগত গরিমার কথা বলা হয়েছিল, সেই নিয়ম খাটিয়ে ফ্রান্স পেরেছে তার কৃষক পরিবারদের জীবিকায় ফিরিয়ে আনতে। অনেক তরুণ তরুণী পারিবারিক কৃষিকাজের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগে আমাদের জয়নগরের মোয়া বা রাধাতিলক চাল বা সুন্দরবনের মধু নিয়ে এরকম ব্যবস্থা করা যায় কিনা, এই আলোচনা তর্কের। হয়তো কিছুটা হয়েছেও এধরনের কাজ। কিন্তু সামাজিক স্তরে মানুষকে কি কাঁচা বাজারমুখী করা যাচ্ছে? না কি চিরন্তন বাজারপ্রীতি থেকে মুখ ফিরিয়েছে বাঙালি?
আমার পরিবারে বাজার যাওয়ার নেশা রয়েছে, আগেই লিখেছি। সব বাঙালি পরিবারেই এককালে এরকম ছিল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি-র আবেগপ্রবণ বাজারপ্রেমী চরিত্র ভজহরিবাবু বাংলার এক প্রতিষ্ঠান। ভজহরিবাবু নিজের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে বাজার যেতেন, বলতেন, “বাজার করাটাও একটা আর্ট"।
এহেন ভজহরিবাবুর কলকাতা থেকে বর্তমানে কলকাতার চেহারা বদলেছে স্বাভাবিকভাবেই। বিশ্ব, এমনকী কলকাতাও ভাগ হয়ে গেছে। একদল বাজার যায়, আরেকদল রিটেইল স্টোরে যায়, যেখানে তাক থেকে সবজি এবং মুদিখানার জিনিস কিনে নেওয়া হয়। নতুন প্রজন্মের কলকাতাবাসী পছন্দ করে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে। প্যান্টালুন রিটেলের ফুড বাজার ২০০২ সালে ভিআইপি রোডে প্রথম খোলা হয়। এরপরে সাত বছরের মধ্যে শহরে আরও ১২টি ফুড বাজার চালু হয়। কিছু পরিবার সপ্তাহের বাজার একবারেই করে নেয়। এইসব আধুনিক ক্যাপিটালিস্ট জীবনের দান, কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে, এই নতুন অভ্যাসের ফলে কতখানি কার্বন ফুটপ্রিন্ট পড়ছে, কতখানি লোকসান হচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতির, নতুন প্রজন্মকে সেই পাঠ দেওয়ার লোক কোথায়? ফ্রান্সের এত গল্প না হয় বললাম, এখানেও সময়াভাবে কাঁচা বাজারে যেতে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যা প্রচুর। তার উপর হয়েছে ডিকন্টেক্সচুয়ালাইজড স্বাস্থ্য সচেতনতা। চারটে রিল আর দশটা ওয়েবপেজে পড়লাম কিনোয়া খাওয়া ভালো, তাই কাল থেকে আমি কিনোয়া খেতে শুরু করলাম। সেই ফসল কোথায় হচ্ছে, কতদূর পেরিয়ে আসছে, তার জন্য পরিবেশের কতখানি ক্ষতি, বাজারে চাহিদা বাড়ার ফলে যে দেশটিতে ফসল চাষ হচ্ছে সেখানে কী প্রভাব পড়ল, আমার শরীর এই বিদেশি খাবারকে আদৌ সহ্য করবে কিনা, এত চিন্তা করতে কেউ শেখাচ্ছে না। স্কুলেও না, বড় হয়েও না। (কিনোয়ার গল্পটা কেবল উদাহরণ হিসেবে নিলাম। পেরুর পর ভারত কিনোয়া উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, যদিও এটি নতুন ফসল, বাজারভিত্তিক চাহিদার ফসল। এর ফলে পরিবেশে, মাটির উর্বরতায় কতখানি প্রভাব পড়ছে তা ভবিষ্যৎ বলবে।)
আসল কথা হচ্ছে, বাজার ঘুরে বাজার করার একটা বড় দিক আমরা ভুলে যাচ্ছি— সামাজিক যোগাযোগ। আমার ঠাকুরদা বা শ্বশুরমশাইকে দেখেছি, আড্ডা মারার নেশায় বাজার যেতেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর দিনে বহুবার বাজার যেতেন, জিনিস কেনার জন্য নয়, আরও দুটো লোকের সঙ্গে কথা হবে বলে। এই মানুষগুলি বুড়ো হতেন কিন্তু এদের বন্ধুর অভাব হতো না। সমবয়স্ক আলাপ-আলোচনার অভাব হতো না। একাকীত্বের ভাগ কিছুটা হলেও বার্ধক্য থেকে বাদ পড়ত, যে একাকীত্ব এবং বার্ধক্যজনিত মানসিক অবসাদ আজ পৃথিবীব্যাপী মারণরোগে পরিণত হয়েছে। পাড়ার বাজারগুলি উঠে গেলে সামাজিক আদানপ্রদানের এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুটি আমরা হারিয়ে ফেলব। কলকাতায়, মার্সেই-তে, প্যারিসে, মুম্বইয়ে, সর্বত্র। মূলত, একটি আরবান ভয়েড সৃষ্টি করবে বিলুপ্তির পথে স্থানীয় বাজার। যদিও ফালতু হা-হুতাশ করে লাভ নেই, বাজার কখনই উঠে যাবে না, ভোল বদলাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কতখানি বদলাবে এবং কত দ্রুত বদলাবে।
আরও পড়ুন-সালঁ, সেলুন আর খুর-কাঁচির কিসসা
একটি ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে শেষ করব।
আজকাল দোকান-বাজারে রাস্তাঘাটে অনেক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, তারা এগিয়ে আসেন, বুঝি দু’কথা আদানপ্রদান করতে চান। বেশিরভাগ আলাপের বিষয় দোকানের বা হাতের স্মার্টফোনের অত্যাধুনিক ব্যাপারস্যাপার ব্যবহার করে জিনিসের দাম জানা বা ট্রামবাসের টিকিট কাটা সংক্রান্ত। একদিন সুপারমার্কেটে তরিতরকারি কিনে অটোমেটিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন মাপছি, বুঝতে পারছি কাঁধের উপর যেন পরবর্তী ক্রেতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বয়স্কা দুই চোখ। সাহায্য চান না, শুধু দেখতে চান কীভাবে ওই যন্ত্রে ওজন মাপা হয়। যতবার নতুন মেশিনটার ব্যবহার শিখতে চেয়েছেন ততবার কেউ না কেউ ওঁর হয়ে কাজটা করে দিয়েছে, ফলে অন্যের দয়ায় ওঁর কাজ মিটেছে তাড়াতাড়ি কিন্তু কোনওদিন নিজে হাতে শেখা হয়নি। খুবই বিব্রত হয়ে জানালেন, এই কারণেই লুকিয়ে শেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু মেশিনে তরুণ আঙুল এত দ্রুত কাজ করে যে তাল মিলিয়ে উঠতে পারেন না। এ কথা শুনে আমার শ্রদ্ধা হয়। মহিলার বয়স আশি পেরিয়ে অনেক দূর। রোজ বাজার করেন নিজেই, কনফিডেন্স দেখেই বোঝা যায়। অন্যের সাহায্য নিয়ে কাজ চলে যাচ্ছে দিব্যি, তবু ওঁর বয়সে নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা দেখে আমি মুগ্ধ হই। হাতে ধরে দেখিয়ে দিই ডিজিটাল দাঁড়িপাল্লা। এতে আমার একদিনের বাজার-রুটিনে ১০ মিনিট বাড়তি খরচ হয় কিন্তু ভদ্রমহিলার বিদায়ী হাসিতে যে নিশ্চিন্তি আর কৃতজ্ঞতা আমি দেখেছিলাম, তা দুর্লভ।
আধুনিক সভ্যতায় বিজ্ঞানের কল্যাণে চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতিতে সারা পৃথিবীতে মানুষ অনেক বেশি বয়স অবধি বাঁচছেন। বেশিভাগ দেশের ডেমোগ্রাফিতে বৃদ্ধের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকছেন অনেকেই কিন্তু তাদের মানসিকভাবে সুস্থ এবং সবল রাখার দায়িত্ব কি আমরা নিতে পারছি? প্রাচ্যের সমস্যা, সে দুই নৌকাতে পা রেখে কী করবে বুঝতে না পেরে সনাতনী মতে মা-বাবার সেবা করা উচিত এবং ক্যাপিটালিস্টিক মতে টাকা কামানো উচিতের দোলাচলে ভুগছে। ভারতীয় আর্বান বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সচল অবস্থায় অচল জীবনে দিশাহীন করে রাখছে। পাশ্চাত্য সমাজে ছেলেমেয়েরা এটুকু বুঝেছে যে, বয়স হলেও দৈনন্দিন কাজ নিজে চালিয়ে গেলে সুস্থতা দীর্ঘতর হয়। ভালোভাবে, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তাই কম বয়স থেকে সবাই স্বাস্থ্য সচেতন, যতদিন নিজের কাজ নিজে করা যায় ততই ভালো। কিন্তু প্রযুক্তির নেশায় আধুনিক সমাজে সবকিছু ডিজিটাল হতে থাকা স্মার্ট শহরে স্মার্ট ফোনে টিকিটবিহীন যানবাহনে মানুষবিহীন ব্যাঙ্ক, শপিং মলের চাকচিক্যে, আধুনিক সমাজের বৃহত্তম ডেমোগ্রাফির কথা ভাবতে আমরা ভুলেই যাচ্ছি। এখানে নব্বই পার করে নিয়ে নিজের কাজ করার সামর্থ্য থাকলেও টেকনোলজির বেড়াজালে তারা নাজেহাল। সমাজ তাদের রিজেক্ট করছে। নিরুপায়, জীবনের নেশায়, নতুন কিছু শেখার চোরা ইচ্ছায় অন্যের কাঁধের উপর উঁকি দিয়ে তারা লুকিয়ে দেখে নিচ্ছে বেঁচে থাকার দুরূহ কৌশল। এই সমস্যার সঠিক সমাধান কী?