মেরে ফেলা হল কয়েক হাজার এম্পেরার পেঙ্গুইন, কেন এই নির্বিচার হত্যা?
Climate change: এমনিতেই বিলুপ্তপ্রায় এই এম্পেরার পেঙ্গুইনরা। ইতিমধ্যেই ইন্টারন্যাশনান ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN)-র তরফে 'নিয়ার থ্রেটেন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এদের।
প্রায় এক হাজারটির কাছাকাছি পেঙ্গুইনকে মেরে ফেলা হল ষড়যন্ত্র করে। সলিল সমাধি হল গোটা কলোনি। গণহত্যা ছাড়া কী বলবেন একে! কিন্তু তাদের জন্য কোনও আইন-আদালত নেই। নেই বাঁচানোর আশ্বাসও। কারণ বিশ্বের তাবড় নেতারা বিশ্বাসই করেন না জলবায়ু বদলাচ্ছে। উষ্ণায়ন বাড়ছে। 'ক্লাইমেট চেঞ্জ'-এর মতো বিষয়কে তাঁরা গুজব বলে উড়িয়ে দেন। পরিবেশবিদদের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আমল পায় না তেমন। বরং বড় দেশ হওয়ার লড়াইয়ে পৃথিবী ছোট পড়ে যায়।
আরও পড়ুন: প্রথম বাবা হল সমলিঙ্গের প্রাণী! সমকামী পেঙ্গুইন যেভাবে সাড়া ফেলেছে বিশ্বে…
কিন্তু চোখ বন্ধ করে নিলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। খুব দ্রুত হচ্ছে। ক্রমশ বাড়ছে উষ্ণায়ন। গলে যাচ্ছে সমস্ত হিমবাহ। তার ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্রের জলস্তর। কিন্তু আমরা ভাবছি, পৃথিবীর বিলয় বহু দূরের পথ। ততদিনে প্রাণভরে শুষে নিই যেটুকু যা পাওয়া যায়। নিঃশেষিত করে দিই পৃথিবীর সমস্ত ভাণ্ডার। কিন্তু ততই কাছে এগিয়ে আসছে প্রলয়, বিলয়ের পটভূমি ক্রমাগত রচনা করে চলেছি আমরা।
বায়ুদূষণ, জলদূষণ ও ভূমিদূষণের মারাত্মক প্রভাব ক্রমাগত পড়ছে পরিবেশের উপর। বারবার আইন করেও বন্ধ করা যায়নি প্লাস্টিকের ব্যবহার। আর এই প্লাস্টিক দূষণের ফলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীদের। নদী-নালা হয়ে এই প্লাস্টিক বর্জ্য সোজা পৌঁছচ্ছে সমুদ্রের জলে। এই প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায় অবিনশ্বর। দূষণ ছাড়া পরিবেশে আর কোনও ভূমিকা নেই এর। সেই প্লাস্টিক শরীরে ঢুকছে সামুদ্রিক প্রাণীদের। আর ক্রমশ বিলুপ্তির পথে হেঁটে চলেছে তারা। এই সমস্ত কথাই আমরা জানি, পড়ি বিভিন্ন মাধ্যমে। তবু ব্যাপারটাকে ব্যবহারিক জীবনস্তরে নিয়ে আসি না আমরা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরাট প্রভাব যে পড়ছে জীবজগতে, তার প্রমাণ হাজার হাজার রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালে অন্তত এক হাজার পেঙ্গুইন মারা গিয়েছে। আর তার জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন।
আন্টার্কটিক মহাসাগরে সমুদ্রের তলার বরফ ভেঙে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ওই সব পেঙ্গুইন শাবকগুলির। ২০২২ সালের শেষের দিকে আন্টার্কটিকার পশ্চিমে বেলিংশাউসেন সমুদ্রের সমস্ত বরফ গলে যেতে থাকে। যা কার্যত পেঙ্গুইন শাবকদের জন্য পেতে রেখেছিল মৃত্য়ুফাঁদ। দক্ষিণ গোলার্ধে শীত আসতে আসতে মার্চ মাস। সে সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক পেঙ্গুইনরা মিলিত হয়। তার জন্য ঝাঁপ দেয় সমুদ্রের বরফে। সেখানেই মিলিত হয় তারা, এবং সেই বরফের মধ্যেই ডিম পাড়ে তারা। পুরুষ পেঙ্গুইনের শরীরে উষ্ণ একটি থলি থাকে, সেখানেই ডিম সুরক্ষিত থাকে, তার পর তা থেকে বাচ্চা জন্মায়। মা পেঙ্গুইন বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার সংগ্রহ করে আনে, তাদের খাইয়ে শিখিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য করে তোলে। এরপর আস্তে আস্তে ডানা গজায় সেইসব পেঙ্গুইন শাবকদের। জলরোধী পালক গজাতে থাকে শরীরে। যা দিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটার যোগ্য হয়ে উঠবে তারা।
অর্থাৎ গোটা প্রজনন প্রক্রিয়ার জন্যই পেঙ্গুইনদের নির্ভর করতে হয় সমুদ্রের বরফের উপর। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়ন যত বাড়ছে, তত গলছে হিমবাহ। গলে যাচ্ছে সামুদ্রিক বরফও। যার ফলে বিপদে পড়েছে পেঙ্গুইন প্রজাতি। যে প্ল্যাটফর্মের উপরে পরবর্তী প্রজন্মকে পৃথিবীর আলো দেখাবে তারা, সেই প্ল্যাটফর্মই তো জলবায়ু পরিবতর্নের ফলে গলে জল। গত বছর আন্টার্কটিক মহাসাগরের বরফ গলতে শুরু করে নভেম্বর থেকেই। তখনও বড় হয়নি পেঙ্গুইন সন্তানেরা। সমুদ্রের জলে বেঁচে থাকতে পারে, সেই ক্ষমতা তাদের কোথায়! ফলে জলে ডুবে মৃত্যু হয় গোটা একটা প্রজন্মের। আর এটা শুধু এক বছরের ব্যাপার নয়।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে অন্তত বার তিনেক এমন ঘটনা ঘটেছে। বারবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে এম্পেরার পেঙ্গুইনদের কলোনি। এই ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই পৃথিবী থেকে নাম মুছে যাবে এই আশ্চর্যতম পাখিটির। ডায়নোসরের মতো তারাও নাম লেখাবে বিলুপ্ত প্রাণীর তালিকায়। পেঙ্গুইন প্রজাতির মধ্যে সবথেকে লম্বা ও ভারী প্রজাতির পেঙ্গুইন হল এম্পেরাররা। পেঙ্গুইন সমাজের রাজা এরা। মূলত আন্টার্কটিকাতেই বাস এই প্রজাতিটির। এই প্রজাতিটি একমাত্র শীতকালেই বংশবৃদ্ধি করে। এই সময় বরফে উপর ধরে প্রায় ৫০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রজনন উপনিবেশে পৌঁছয় তারা। সেখানে কয়েক হাজার পেঙ্গুইনের সঙ্গেই ওই কয়েকটা মাস থাকে তারা।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিরপরাধ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি
এমনিতেই বিলুপ্তপ্রায় এই এম্পেরার পেঙ্গুইনরা। ইতিমধ্যেই ইন্টারন্যাশনান ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN)-র তরফে 'নিয়ার থ্রেটেন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এদের। অর্থাৎ এখন থেকে সাবধান না হলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এই পেঙ্গুইন প্রজাতি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই প্রাণীটিই। অথচ পরিবেশ দূষণ নিয়ে এখনও টনক নড়ছে না আমাদের। এখনও দোকানে বাজারে দেদার চলছে প্লাস্টিক, নদীতে, খালে-বিলে নর্দমায় মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। সেসব গিয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে। রাসায়নিক বিষে বিষাক্ত হচ্ছে সমুদ্রের জল। গাছ কেটে পুকুর বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে সুউচ্চ বহুতল। প্রচন্ড গরমের দিনে এসির হাওয়ায় আমরা সুশীতল করছি শরীর। কিন্তু এই ভাবে পৃথিবীর আর কদ্দিন! চাঁদে মঙ্গলে নতুন বসতি বানানোর কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু পৃথিবীকে আদৌ বাঁচানো যাবে তো! কোন উপায়ে বাঁচবে শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা। সেই উত্তর নেই কারওর কাছেই।