কেন ইসকন থেকে বহিষ্কৃত হন চিন্ময় কৃষ্ণ? কী কী অভিযোগ আশ্রমিকদের?

Chinmoy Krishna Das: আশ্রমিকদের অনেকেই জানিয়েছেন, ব্রহ্মচারী হয়েও নিজের ঘরে নাবালক আশ্রমিকদের ডেকে নিয়ে গিয়ে 'ম্যাসাজ' করে দিতে বলতেন তিনি।

তাঁর গ্রেফতারির পর থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যু এবং তা ঘিরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে ওঠে। তাঁকে গ্রেফতারের পর থেকেই ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবর্গ সীমান্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘু (এক্ষেত্রে অবশ্যই হিন্দু) ইস্যুর ঘোলাজলে ভোটের মাছ তোলার কাজে নেমে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে নিয়ে যে যৌন হেনস্থার, তাও আবার ইসকনের মতো প্রতিষ্ঠানের নাবালক আশ্রমিকদের, অভিযোগগুলি রয়েছে তা ধামাচাপাই থেকে যায়। কী কী অভিযোগ?

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আসল নাম চন্দন কুমার ধর। বাংলাদেশের বৈষ্ণবদের জন্য এক অন্যতম মূল কেন্দ্র হচ্ছে চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধাম। তিনি এই পুণ্ডরীক ধামেরই একজন সন্ন্যাসী। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট নামক এক সংগঠনের মুখপাত্র। তবে তারও আগে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ছিলেন ইসকনের সদস্য। তবে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় সেখান থেকে।

বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুগামীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। নিয়মিতভাবে সেই দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করে আসছেন চিন্ময়। তবে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই প্রচারের আলোয় আসেন তিনি। তারপর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান জানাতে থাকেন চিন্ময়। তিনি অভিযোগ করেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মহম্মদ ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সেই দেশে হিন্দুদের উপর অন্তত ৩,০০০ হামলার ঘটনার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আরও পড়ুন-  কেন চিন্ময় দাসের আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন অর্জুন সিং, কার্তিক মহারাজরা?

বাংলাদেশের হিন্দুদের আট দফা দাবির বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলেছেন চিন্ময় যার মধ্যে রয়েছে— সংখ্যালঘু নিপীড়নের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক গঠন, মন্দিরের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা আইন এবং অর্পিত সম্পত্তি আইন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের আধুনিকীকরণ এবং দুর্গাপুজোর জন্য পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি।

ইসকন থেকে বিতাড়িত হলেও, মনে রাখতে হবে পুণ্ডরীক ধাম বাংলাদেশও ইসকনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই। ইসকনের সঙ্গে বিভিন্ন বিতর্ক বহুকাল থেকেই জড়িয়ে আছে। যার মধ্যে রয়েছে অশ্লীলতা, যৌন নির্যাতন এবং হেনস্থা এমনকী হত্যার চক্রান্তের মতো অভিযোগও। কিছুকাল আগেই ভারতের এক ইসকন নেতা অমোঘ লীলা দাস স্বামী বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এবার বাংলাদেশের ইসকন চলে আসে আলোচনায় কারণ সেই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তবে, এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের ঢের আগে, তাঁর বিরুদ্ধে নাবালকদের যৌন হেনস্থার মতো ভয়াবহ অভিযোগ ঘটে। অভিযোগ ওঠে আশ্রমেরই নাবালকদের দিয়ে যৌনআকাঙ্খা পূরণ করেন তিনি। বহু আশ্রমিকের সাক্ষ্য ও বয়ান খতিয়ে দেখার পরে ইস্কন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে বহিষ্কার করে। ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়,

১। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ২.০৬.২০২৪ তারিখ থেকে ইসকন শ্রী শ্রী পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ পদ ও ইসকন বাংলাদেশের কার্যনির্বাহী সদস্যের পদ থেকে তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

২। এই তিন মাসের সময়কালে তিনি কোনওপ্রকার প্রচারকার্য, পাঠদান, অনুদান সংগ্রহ বা কীর্তনে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজও করতে পারবেন না।

৩। এই তিন মাসের সময়কালে পুণ্ডরীক ধাম ও চট্টগ্রাম বিভাগে ইসকনের অন্য কোনও মন্দির ছাড়া অন্যত্র ইসকনের মন্দির বা ইসকন অনুমোদিত কেন্দ্রে অবস্থা করে তাঁকে প্রগতি সাধনের চেষ্টা করতে হবে।

৪। এই সিদ্ধান্তগুলির লঙ্ঘন হলে ইসকন বাংলাদেশের কার্যনির্বাহী কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।

আরও পড়ুন- গণঅভ্যুত্থানের আহত যোদ্ধদের জন্য যে বিশেষ পদক্ষেপ মহম্মদ ইউনূসের

সেই সময়েই নির্দেশ দেওয়া হয়, ১৮ বছরের নীচে কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে পারবেন না চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। আশ্রমের মধ্যে ঠিক কী কী অশালীনতার অভিযোগ ছিল চিন্ময় কৃষ্ণের বিরুদ্ধে? আশ্রমিকদের অনেকেই জানিয়েছেন, ব্রহ্মচারী হয়েও নিজের ঘরে নাবালক আশ্রমিকদের ডেকে নিয়ে গিয়ে 'ম্যাসাজ' করে দিতে বলতেন তিনি। অভিযোগ, রাতে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাতেন তিনি, হাত পা 'ম্যাসাজ' করে দেওয়ার পরে কবচ ধরে শপথ করতে বলতেন যাতে এই ঘটনাগুলির কথা ওই নাবালক আশ্রমিক কাউকেই না বলেন। অভিযোগ, এরপর যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। এই ঘটনা বহুজনের সঙ্গেই ঘটেছে। পুণ্ডরীক ধামের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও তা প্রাথমিকভাবে এড়িয়েই গিয়েছিলেন তারা। পরে একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে অবশেষে কড়া পদক্ষেপ করে ইসকন।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসকনের আন্তর্জাতিক শিশু সুরক্ষা কার্যালয় (ইসকন ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড প্রোটেকশন অফিস-সিপিটি) সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই চিঠিতেই স্পষ্ট বলা হয়, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রকাশ্যে শ্রীল প্রভুপদের কোনও পূজার্চনায় অংশ নিতে পারবেন না। ১৮ বছর বয়সের নীচে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারবেন না। বাংলাদেশের ইসকনের কোর কমিটি এবং সিপিটির কোনো পদধারী ব্যক্তি ছাড়া ইসকনের কোনও সম্পত্তিতে রাত যাপনও করতে পারবেন না।

তারপর হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বাংলাদেশের পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণকে নিয়ে শোরগোল পড়ে গেলেও, সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে না বিতর্ক হলেও এই যৌন হেনস্থার অভিযোগগুলি বিষয়ে কিন্তু যতখানি আলোচনা হওয়া কাম্য ছিল, বিন্দুমাত্রও হয়নি।

More Articles