বীভৎসতম দাবানলে তারকাদের বাড়ি পুড়ে ছাই! কীভাবে আগুন লাগল লস অ্যাঞ্জেলেসে?

LA Fire: শয়ে শয়ে চোখ ধাঁধানো বাড়ি পুড়ে গেছে, যার অধিকাংশটাই তারকাদের বাড়ি এবং প্রায় ১,৮০,০০০ বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে জমকালো এই বিলাসী শহর থেকে।

বিধ্বংসী বললেও বোধহয় ভয়াবহতা বোঝানো অসম্ভব! লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো ঝাঁ চকচকে শহর ছারখার হয়ে গিয়েছে আগুনে, দাবানলে! আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। সাম্প্রতিকতম খবরে জানা গিয়েছে, অন্তত দশজনের মৃত্যু হয়েছে, শয়ে শয়ে চোখ ধাঁধানো বাড়ি পুড়ে গেছে, যার অধিকাংশটাই তারকাদের বাড়ি এবং প্রায় ১,৮০,০০০ বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে জমকালো এই বিলাসী শহর থেকে। লাখো চেষ্টা করেও আগুঙ্কে থামানো যায়নি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, আবহাওয়ার পরিস্থিতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত প্রভাবের কারণে আগামী আরও কয়েকদিন এই আগুন জ্বলতে থাকবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে প্যাসিফিক প্যালিসেডস এবং আলতাদেনা, যেখানে বহু মিলিয়ন ডলারের বাড়ি সব ছাই হয়ে গেছে। প্যারিস হিলটন, অ্যান্থনি হপকিন্স এবং বিলি ক্রিস্টালের মতো তারকাদের বাড়ি পুড়ে গিয়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলেসে কাছাকাছি দু' লক্ষ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় লাখ দুয়েক মানুষকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে। কোনওক্রমে যেটুকু সঙ্গে না নিলেই নয়, তা নিয়েই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মানুষ। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শেরিফ রবার্ট লুনা জানাচ্ছেন, খালি হয়ে যাওয়া বাড়ির আশেপাশে লুটপাট এবং চুরি বেড়েছে, যার ফলে ২০ জন গ্রেফতারও করা হয়েছে৷ হলিউড তারকাদের চোখ ধাঁধানো সব বাড়ি পুড়ে ছাই! বীমা কোম্পানিগুলির আশঙ্কা, মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দাবানল হতে চলেছে এটি। দাবানলের যে পথে ছড়িয়েছে সেখানে সম্পত্তির দাম প্রচুর! ফলে ক্ষতি হতে পারে কাছাকাছি ৮ বিলিয়ন ডলারের! কিন্তু কীভাবে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল? দাবানন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল শহরে?

আরও পড়ুন- আগুন-ধোঁয়ার কুণ্ডলী ও দুই ফুটবলার! কীভাবে জন্ম নিল পৃথিবী বিখ্যাত এই ছবি?

লস অ্যাঞ্জেলেসের আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, অন্তত আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৃষ্টির কোনও পূর্বাভাসই নেই, অর্থাৎ আগুন ছড়ানোর উপযুক্ত পরিস্থিতি রয়েছে। শহরের বিভিন্ন অংশ এখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, রাস্তায় প্রবল যানজট। বেশ কয়েকটি স্কুল এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিনির্বাপকদের জলের সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার আদৌ যোগ্য কিনা সেই সওয়ালও উঠতে শুরু করেছে। আর এই সবের নেপথ্যে দাবানল।

লস অ্যাঞ্জেলেসের মূলত পাঁচটি জায়গায় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে - সানসেট, হার্স্ট এবং লিডিয়া। আর সবচেয়ে বড় দু'টি হলো পালিসেডস এবং ইটন অগ্নিকাণ্ড।

পালিসেডস: মঙ্গলবার প্রথম আগুন লাগে এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আগুন এটি যা এই রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আগুনে পরিণত হতে পারে। এই আগুন প্রায় ২০,০০০ একর জমির একটি বড় অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে।

ইটন: লস অ্যাঞ্জেলেসের উত্তর অংশে এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আলতাদেনার মতো শহরগুলি পুড়ে ছাই। এটি এলাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম আগুন, প্রায় ১৪,০০০ একর জমি পুড়ে গেছে।

হার্স্ট: সান ফার্নান্দোর ঠিক উত্তরে অবস্থিত, মঙ্গলবার রাতে শুরু হওয়া আগুনে ৬৭০ একর পর্যন্ত জমি পুড়ে গেছে।

লিডিয়া: বুধবার বিকেলে লস অ্যাঞ্জেলেসের উত্তরে পার্বত্য অ্যাক্টন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন, প্রায় ৩৫০ একর পুড়ে গিয়েছে।
কেনেথ: লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ভেনচুরা কাউন্টির সীমান্তে বৃহস্পতিবার নতুন করে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ একর জমি পুড়ে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রয়েছে এই দাবানলের নেপথ্যে। প্রবল হাওয়া এবং বৃষ্টির অভাব এই দাবানলকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের দাবানলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দশকের খরা, তারপরে দু'টি ব্যতিক্রমী আর্দ্র বছর, প্রচুর পরিমাণে শুকনো গাছপালার ফলে এউ দাবানল ব্যাপক জ্বালানি পেয়ে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। গত আট মাসে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ভারী বৃষ্টিপাতের অভাব সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করেছেন যে পরিস্থিতি সঙ্কটজনকই থাকছে আপাতত।

আরও পড়ুন- ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাজন, চার দশকে যেভাবে কুঠার চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিঅরণ্যে

ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানাচ্ছে, "বর্ধিত তাপ, বর্ধিত খরা এবং বায়ুমণ্ডলে জলের অভাব সহ জলবায়ু পরিবর্তন পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের ঝুঁকি এবং মাত্রা বৃদ্ধির মূল চালক হয়ে দাঁড়িয়েছে।” দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দাবানলের মরশুম ধরা হয় সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। তবে ইদানীংকালে দাবানল বর্ষব্যাপী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস জানাচ্ছে বেশিরভাগ এলাকায় কম আর্দ্রতা রয়েছে। ফলে গাছপালা এমনিতেই শুষ্ক। পাশাপাশি ১০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে হাওয়াতে আগুন হু-হু করে ছড়িয়ে যায়।

ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস জানিয়েছে, সান্তা আনা বায়ু, যা শরত্কালে এবং শীতকালে দেখা দেয় তা ক্যালিফোর্নিয়ার অভ্যন্তরীণ মরুভূমি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে শুষ্ক বাতাসকে উপকূলের দিকে ঠেলে দেয়। যেহেতু সান্তা আনা পর্বতমালার উপর দিয়ে উচ্চচাপ পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যায়, বাতাসকে জোর করে ঠেলে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়। নীচে এই বাতাস উষ্ণ হয়। সান্তা মনিকা এবং সান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালায় গিরিখাত এবং উপত্যকাও রয়েছে, যা সান্তা আনা বায়ুর জন্য ফানেল হিসাবে কাজ করতে পারে এবং এই পাহাড়ি এলাকায় দাবানল ছড়িয়ে পড়াকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, লস এঞ্জেলেসের ৮৩% এরও বেশি খরা আক্রান্ত ছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসে গত এপ্রিল থেকে এক ইঞ্চি বৃষ্টিও হয়নি। ফলে প্রচুর পরিমাণে শুষ্ক জ্বালানি রয়েছে এই অঞ্চলে।

More Articles