৫০ বছর পর প্রকাশ্যে মুজিবের হত্যাকারী মেজর ডালিম! ফিরবেন বাংলাদেশে?

Bangladesh Major Dalim: মেজর ডালিম এখন কোথায়? কোন দেশে? তা জানা যায়নি। শুধু সমাজমাধ্যমে দেখা গেছে জামাত সমর্থক এক সংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তিনি।

৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। পদ্মা দিয়ে বয়ে গেছে রক্ত, নতুন সূর্যের আলো, অভ্যুত্থানের টগবগে উত্তেজনা। বাংলাদেশ বলতেই যে মুক্তিযুদ্ধ, যে মুজিব, যে মুজিব হত্যার কথা মনে পড়েছে এতকাল, তার সমান্তরালে আরেক ইতিহাসকে সামনে আনার চেষ্টা করছে হাসিনাপরবর্তী বাংলাদেশ। মুজিব পরিবারের হাতে কুক্ষিগত বাংলাদেশের 'প্রকৃত স্বাধীনতা' নাকি এসেছে গত ৫ অগাস্ট, ছাত্র জনতার আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর। তারপর থেকেই বাংলাদেশের অস্থিরতা, ভারতের সঙ্গে খারাপ হওয়া সম্পর্ক, হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি ও নৃশংসতা, সংখ্যালঘুদের হত্যা—নানা ইস্যুতে টলমলে অবস্থায় আছে পড়শি দেশ। তবে, ৫০ বছর পর একজনের প্রকাশ্যে আসা অন্যতম বড় বিতর্ককে আবারও জাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে। অর্ধ শতাব্দী পর প্রকাশ্যে এলেন মেজর ডালিম। শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম হত্যাকারী মেজর শরিফুল হক ডালিম।

গত রবিবার রাতে প্রবাসী এক সাংবাদিকের নিজস্ব সমাজমাধ্যমে লাইভে উপস্থিত হন মেজর ডালিম। ২ ঘণ্টার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে আসে মুজিব হত্যা, বাকশাল গঠন থেকে শুরু করে হাসিনার পতন সবটুকুই। মেজর ডালিম এখন কোথায়? কোন দেশে? তা জানা যায়নি। শুধু সমাজমাধ্যমে দেখা গেছে জামাত সমর্থক এক সংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তিনি, হাসিনা-বিরোধী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

ওই সাক্ষাৎকারে ডালিম বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের আগের মুজিব আর মুক্তিযুদ্ধের পরের মুজিব ছিলেন আলাদা। মারধর, চোরাচালান, ভারত থেকে নকল টাকা ছাপানো— মুজিবের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ তুলেছেন ডালিম। যে মানুষ মুজিবকে এককালে ত্রাতা ভেবেছিলেন, তাঁরাই নাকি পরবর্তীতে মুজিবের হাত থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, সাক্ষাৎকারে বলেছেন মেজর ডালিম। ডালিম বলছেন, মুজিব একদলীয়, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরশাসন বাকশাল শুরু করেন। তারপরেই ক্ষমতার দম্ভে তাঁর স্বরূপ পরিবর্তন হয়। একা মেজর ডালিম নন, আরও বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মেজর ডালিম (ডানদিক থেকে চতুর্থ)

আরও পড়ুন- পঞ্চাশ বছর আগে হারিয়েছিলেন পরিবার, আর এক গণঅভ্যুত্থানে দেশ হারালেন মুজিব-কন্যারা

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কিছু অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন ও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ মনে করত যে, তাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। ঠিক এই সময়ই, সমস্ত বিরোধীদলের অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেন। বাকশাল গঠনকে অনেকে শেষের শুরু মনে করেন। এই ঘটনা সামরিক এবং রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল।

মুজিবের শাসনে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ মনে করত, দেশের নেতৃত্ব পরিবর্তন করা প্রয়োজন। মেজর শরিফুল হক ডালিম ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান হোতা হিসেবে পরিচিত তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ডালিম ও তাঁর সহযোগীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পালাবদল হলে ডালিমসহ অন্যান্য অভ্যুত্থানকারীরা বিদেশে চলে যান।জানা যায়, শরিফুল হক ডালিম দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান, লিবিয়া, জিম্বাবুয়ের মতো বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আবারও শুরু হয়। মেজর ডালিমসহ অন্য অভিযুক্তদের আদালত দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে ডালিম পলাতক থাকায় মৃত্যুদণ্ড এখনও কার্যকর করা যায়নি।

ডালিম ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের পর তিনি বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে স্থানান্তরিত হন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ডালিম পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই মেজর ডালিমই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশ বেতারে ঘোষণা করেন:

"আমি মেজর ডালিম বলছি, খন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। শেখ মুজিব ও তার খুনী-দুর্নীতিবাজ সরকারকে উৎখাত করা হইয়াছে। এখন থেকে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হলো। আপনারা সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনও অসুবিধা আপনাদের হইবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!"

আরও পড়ুন-৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ! যে ভয়াবহ অভিযোগ উঠছে হাসিনা ও পরিবারের বিরুদ্ধে

ডালিম ও তাঁর স্ত্রী নিম্মি

৫০ বছর পরে আবার প্রকাশ্যে তিনি। আওয়ামী লীগের পতন আর হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়ন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুজিব-ইতিহাসে এক বড় ঘটনা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী, সেদিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। এরই মধ্যে মেজর ডালিমের প্রকাশ্যে আসা নিঃসন্দেহে এক বড় ঘটনা। মেজর ডালিম অবশ্য নিজেকে ‘হত্যাকারী’ মনে করেন না। এই সাক্ষাৎকারেই তিনি বলেছেন, “মুজিব মারা যাননি। সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। স্বৈরাচারী শেখ মুজিব তাঁর জুলুমের মাত্রা এতটাই তীব্র করেছিলেন, মানুষ তাঁর হাত থেকে মুক্তি চাইছিল।” মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিমের দাবি, শেখ মুজিবের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের চট্টগ্রাম সেক্টরের কমান্ডার হিসাবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। সেই ডাক শুনে উদ্বেল হয়ে ডালিম ও আরও ৫ সেনা আধিকারিক পাকিস্তানি বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দিল্লিতে তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। তবে ডালিম জানাচ্ছেন, অচিরেই তিনি বুঝতে পেরে যান ভারত আসলে বাংলাদেশকে সাহায্যের নামে নিজের অধীন করতে চাইছে।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলেন, মুজিব হত্যার নেপথ্যে ডালিমের ব্যক্তিগত আক্রোশও রয়েছে। ১৯৭৪ সালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গাজী গোলাম মোস্তফা ও মেজর শরিফুল হক ডালিমকে ঘিরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকার লেডিজ ক্লাবে মেজর ডালিমের আত্মীয় তাহমিনার সঙ্গে ছিল কর্নেল রেজার বিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানে কথা কাটাকাটির জের ধরে গোলাম মোস্তফা, মেজর ডালিম, তাঁর স্ত্রী নিম্মি, ও কর্নেল রেজার মা-কে অপহরণ করে শেখ মুজিবের বাসভবনে নিয়ে আসেন বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধানকে ডেকে শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি মীমাংসা করেন ঠিকই কিন্তু ডালিম এই অপমান ভোলেননি। সেদিনই মধ্যরাতে ডালিম সেনানিবাস থেকে এক ট্রাক সৈন্য এনে গাজীর বাড়ি ভাংচুর করেন বলে অভিযোগ। তদন্তের পর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ডালিমকে বরখাস্ত করা হয়। বেঙ্গল ল্যান্সারস এবং মেজর শরিফুল হক ডালিম সহ জড়িত ক্ষুব্ধ আধিকারিকদের অনেকেই পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন।

তবে হাসিনার পদচ্যুতির পর কি বাংলাদেশেই ফিরবেন ডালিম? বাংলাদেশের মানুষের মনে 'মুজিব হত্যাকারী' হিসেবে যে ছাপ রয়ে গিয়েছে, তা কি মুছতে পারবেন ডালিম? ইউনূসের সঙ্গেই বা তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ কী হতে চলেছে? অজস্র প্রশ্নই ভাবাচ্ছে নয়া বাংলাদেশকে। 

More Articles