তামান বাকান পেলাঙ্গি: জেলেদের গ্রামে রূপকথা বুনেছে যে আশ্চর্য লাইব্রেরি
Rainbow Reading Gardens Indonesia: ছোটদের পড়ার জন্য সরবরাহ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ৯৬২টি বই, সে সব বই নিয়মিত পড়তে পারছে ৪২ হাজার ১৮৯ জন শিশু
সাল ২০০৯, পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দ্বীপ অঞ্চল ফ্লোরসের রোয়ি নামের অখ্যাত একটা গ্রামে শুরু হয় ‘তামান বাকান পেলাঙ্গি’ নামের এক আশ্চর্য উদ্যোগ।সমুদ্রে মাছ ধরে দু-পয়সা রোজগার করা গরিব পরিবারগুলোর কাছে দিন গুজরান করাই বড় লড়াই। এলেবেলে ভাবে বয়ে চলা জীবনে শিশুদের স্কুলে পড়াশোনা করানোটাই যেখানে কঠিন সেখানে তাদের জন্য গল্প, ছড়া বা অনান্য মজার বই কেনা কল্পনারও অতীত। কিন্তু কী আশ্চর্য! এলাকার শিশুদের ফ্যাকাশে জীবনেই নিলা তানজিল নামের এক তরুণী হাজির হলেন একমুঠো রোদ্দুর নিয়ে। তিনি শিশুদের পড়ার জন্য এক মৎস্যজীবীরই বাড়ির বারান্দায় খুলে ফেললেন মিনি লাইব্রেরি।মাত্র ২০০টা বই নিয়ে গড়ে উঠল শিশুদের স্বপ্ন দেখানোর সেই ছোট্ট গ্রন্থাগার। ছোটদের সামনে খুলে গেল রামধনুর জগৎ। পথ চলা শুরু করল ‘তামান বাকান পেলাঙ্গি’ বা রেনবো রিডিং গার্ডেন। এরপর বসে থাকেননি নিলা তানজিল। গল্প, ছড়া, ছবির বই পড়তে ছোটদের আগ্রহ দেখে তিনি ছুটে গেছেন বিভিন্ন এলাকার মৎসজীবী বাবা-মায়েদের কাছে। বলেছেন এলাকার শিশুদের জন্য লাইব্রেরি গড়তে শুধু একটু সহযোগিতা করুন। সহযোগিতা বলতে, বই রাখার জন্য একটা র্যাক বা বাক্স আর পড়ার জন্য এক চিলতে ঘর। কেউ যদি তাঁর দালানেও এমন ব্যবস্থা করে দেন তাতেই অনেক। যেমন রিনকা দ্বীপের কোনওমতে দিন গুজরান করা মৎসজীবী বাকো লাইব্রেরির জন্য ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর ছিটেবেড়া দেওয়া একটা বসার ঘরই। দুটো কাঠের র্যাক বসিয়ে তা এখন ছোটদের আলোকময় পড়ার জায়গা। এভাবেই পথ চলা শুরু।
কিন্তু কে এই নিলা তানজিল? নিজের ওয়েবপেজে নিলা লিখেছেন, বেড়াতে, স্কুবা-ডাইভিং করতে, পড়তে এবং ছবি তুলতে পছন্দ করেন তিনি। আসলে নিলা একজন সোলো ট্রাভেলার। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করেছেন ‘ট্রাভেল স্পার্কস’ যার মূল ভাবনা হলো ‘ট্রাভেল উইদ আ কজ’ বা যে সফর আপনাকে সদর্থক বার্তা পেতে সাহায্য করবে। তিনি লিখেছেন, "আমি একাই ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। বৌদ্ধ মন্দিরে হোক বা রাস্তার ধারে গাছের নীচে, আমি যেকোনও জায়গায় চারপাশ ঘুরে দেখে স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারি।" ইতিমধ্যে তানজিল বিশ্বের ৩৪টি দেশ ঘুরে ফেলেছেন। একসময় ব্লেজার আর হাই হিল পরে ক্লায়েন্ট মিট করা কঠোর পরিশ্রমের চাকরি করতেন নিলা। তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমি কর্পোরেট দাস ছিলাম”। কিন্তু রোজগারের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে অন্যরকম কিছু করার তাগিদেই পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য শিশু গ্রন্থাগার ‘তামান বাকান পেলাঙ্গি’ (রেনবো রিডিং গার্ডেন) নামে একটি অলাভজনক সংস্থা তৈরি করে ফেলেন। সেই লাইব্রেরিই আজ পথ দেখাচ্ছে অন্যদের। এশিয়ার এক কোণে এমন দ্বীপরাষ্ট্রে বসে এমন অন্যপথে হেঁটে নিলা তানজিল আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের পাশাপাশি পেয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার আইটি এবং মহিলা ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের ‘কারটিনি নেক্সট জেনারেশন ২০১৩’ পুরস্কার, ‘১০ আইকনিক উইমেন ২০১৬’ পুরস্কার, ফোর্বস ইন্দোনেশিয়ার ১০ অনুপ্রেরণামূলক মহিলা ২০১৫ সম্মান।
কিন্তু এরপর কী? বাচ্চাদের রামধুনর হদিশ দেবেন বলে যে ‘রেনবো রিডিং গার্ডেন’ তানজিল তৈরি করলেন তার কী হলো? সে উত্তরণও কম গল্পময় নয়। একটা বাড়ির বারান্দায় বা বাতিল ঘরে শুরু হওয়া হাতে গোনা গুটিকয় বই নিয়ে শুরু হওয়া সেই সব লাইব্রেরির ডানায় তখন স্বপ্নের উড়ান। সেই ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের কাছে বই পৌঁছে দিতে গড়া হয় ফাউন্ডেশন। আজ সেই লাইব্রেরি কোমোডো, রিনকা, মেসা, স্পাইস, মালুকু সহ বিভিন্ন দ্বীপের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে। পড়াশোনার বাইরে হাতে রঙিন বই পেয়ে খুব খুশি শিশুরা। ইন্দোনেশিয়ার পিছিয়ে থাকা অংশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের, কল্পনার ডানা মেলার সুযোগ করে দিতে এ পর্যন্ত ২০৭টি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে এই ফাউন্ডেশন। তাদের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, ছোটদের পড়ার জন্য সরবরাহ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ৯৬২টি বই, সে সব বই নিয়মিত পড়তে পারছে ৪২ হাজার ১৮৯ জন শিশু আর এই সব লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৫৮৯২ শিক্ষাকর্মীকে।
আরও পড়ুন- লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে সম্বল বই, সাইকেল লাইব্রেরির হাত ধরে দিনবদলের স্বপ্ন এমবিএ যুবকের
এই মুহূর্তে পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার গড়ার এক অনন্য উদ্যোগে পরিণত হয়েছে রেনবো রিডিং গার্ডেন ফাউন্ডেশন। শিশু গ্রন্থাগার স্থাপন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ওয়ার্কশপ, বেসিক লিটারেসি কোর্স এই তিনধাপে কাজ করে এই ফাউন্ডেশন। যেমন স্থানীয় স্কুলগুলোর সঙ্গে একত্রে কাজ করে তাদের লাইব্রেরিটিকে একটি শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশে রূপান্তরিত করা। পাশাপাশি খুদে শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে এবং বই পড়ার মজাটা বোঝাতে শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মশালার আয়োজন করা। এর পরে থাকে এমন কার্যক্রম যার মাধ্যমে শিশুরা ধীরে ধীরে পড়ার প্রতি একটা ভালোবাসার টান অনুভব করে।
কিন্তু হঠাৎ কেন রেনবো রিডিং গার্ডেনের প্রসঙ্গ? কারণ শিশুমনকে ডিজিটাল দুনিয়ার আগ্রাসী প্রভাব থেকে দূরে রাখা। এই মুহূর্তে প্রায় বিশ্বব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের কাছে, সময় কাটানোর বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও কিশোর মন। একাকিত্ব ও মন খারাপ ভুলতে টিভি, মোবাইল গেম ও কম্পিউটারের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে বিরাট ছাত্রসমাজ। আর যারা গেম খেলছে না তাঁদের সহজে গ্রাস করছে বিচিত্র কার্টুনধর্মী অ্যানিমেটেড ভিডিওর সবপেয়েছির ইউটিউব দুনিয়া। কী নেই সেখানে? বিচিত্র বিনোদন থেকে শিশু কাহিনির নানা অপেশাদার নির্মাণ - সবকিছুই হাজির এক ক্লিকে। কিছু পড়তে হয় না, কিছু কল্পনাও করতে হয় না শুধু দেখে গেলেই হলো। আমাদের হয়ে সব কল্পনাই আগাম করে রাখা আছে সেখানে। অর্থাৎ আমরা কী চাই, আমাদের কী পছন্দ, কী দেখলে আমাদের মন হাঁকপাঁক করে উঠবে পরের এপিসোড দেখার জন্য— সব বন্দোবস্ত আছে। এর সঙ্গে রয়েছে ডিজিটাল গেমের হাতছানি। ২০১৮ সালেই ভিডিয়ো গেম কিংবা ডিজিটাল গেমের প্রতি আসক্তিকে ‘মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা’ তকমা দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
বিশ্বজুড়ে স্মার্ট ডিভাইসের বাড়বাড়ন্তের জেরে গোটা পৃথিবী যখন ডিজিটাল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল ঠিক তখনই সব হিসেব অদলবদল করে দেয় করোনা ভাইরাস। করোনাকালে ঘর বন্দি শৈশব ও কৈশোরের অনেকটাই দখল করে নেয় ডিজিটাল স্ক্রিন টাইম। কিছুটা বাধ্য হয়েই ছোটদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়েছেন পরিবারের লোকজন। সরাসরি বই পড়া বা লেখালিখির জগত থেকে ছোটরা ঢুকে পড়েছে ভার্চুয়াল মিডিয়ায়।
আরও পড়ুন- একটি গ্রন্থাগারের জন্ম, অনেক গ্রন্থাগারের মৃত্যু
সবকিছু ছেড়ে কেন ‘তামান বাকান পেলাঙ্গি’র মতো এমন ফ্রি লাইব্রেরি তৈরির কথা ভাবলেন তানজিল? নিলা লিখেছেন,
“আমি বিশ্বাস করি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা এক অপরিহার্য চাবিকাঠি।আমি মনে করি প্রত্যেক শিশুরই বই পড়ার অধিকার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যারা পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, তাদের জন্য বইয়ের অ্যাক্সেসও বিলাসিতা।আমি বই ছাড়া আমার শৈশব কল্পনা করতে পারি না। যখন এই বাচ্চাদের দেখি যারা কখনও কোনও রঙিন গল্পের বই দেখতে পায় না, সত্যিই আমার মন ভেঙে যায়। আমি চাই তারা বইয়ের প্রেমে পড়ুক, কারণ আমি বিশ্বাস করি বই তাদের বড় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করবে!”
ইন্দোনেশিয়ার ‘তামান বাকান পেলাঙ্গি’ র মতো রঙিন, অভিনব মুক্ত লাইব্রেরি নিয়ে এই দেশেও কাজ কম হচ্ছে না, তবে তার ব্যাপ্তি অত্যন্ত কম এবং তার জন্য সহযোগিতার অভাবও আকাশচুম্বী। আগের মতো পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরির দিন আর ফিরতে পারবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর অজানা। ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক পাঠাগার। এমনকী স্কুলগুলিতেও লাইব্রেরি বিষয়টি ক্রমেই অপাংক্তেয়। মিড-ডে মিল খাইয়ে স্কুলে শিশুদের আনা হয় ঠিকই কিন্তু সেখানে শিশুমন ডানা পায় না। অথচ ‘অ্যালিস’স অ্যাডভেঞ্চার ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর লেখক ল্যুইস ক্যারল কবেই বলে গেছেন – বাস্তবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে কল্পনার জগৎই হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র।