ক্রমে বুদ্ধি বাড়ছে যন্ত্রের! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাপিয়ে যাবে মানুষকে?

Artificial Intelligence: যন্ত্র কি এবার পারবে বুদ্ধিতে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে?
আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী,

জন হেনরি বলে বুক ঠুকে।

স্টীম-ড্রিলের সাথে চলে হাতুড়ির পাল্লা,
কে আর বলো তাকে রোখে।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই গানের মূল উপজীব্য যন্ত্র ও মানুষের দ্বন্দ্ব। সভ্যতার বিকাশে আদিম মানুষ তৈরি করেছিল চাকা, হাতুড়ি-র মতো কিছু যন্ত্র। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সমাজে সেই যন্ত্র যত জটিল হয়েছে, মানব-শ্রমের উন্নততর বিকল্প হিসেবে ক্রমশই তারা নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে এই দুনিয়ায়। পাশাপাশি, মানুষের দৈহিক শ্রমের ক্ষমতার সঙ্গে যন্ত্রের প্রতিযোগিতাও চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই যন্ত্র আর কেবল শ্রমের বিকল্প নয়, মানব-বুদ্ধিকেও নকল করতে শিখেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যন্ত্রমানবের কথা। কোনও যন্ত্রের মানুষের মতো আচরণ করার প্রধান শর্তই হলো তার বুদ্ধিমত্তার বিকাশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে মানুষ যন্ত্রকে গণনার কাজে ব্যবহার করতে শিখেছিল। যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির কাজটি শুরু হয়েছিল গত শতকের চারের দশকেই, কিন্তু বর্তমান শতাব্দীতে তা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। এখন আমাদের অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, কারখানার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, এমনকী, রোবোটিক্স- সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হলো কীভাবে?
একটি যন্ত্র কীভাবে মানুষের মতো বস্তু চিনতে, বা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? এই ভাবনা থেকেই বিংশ শতাব্দীতে শুরু হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা। মানুষের শিক্ষা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া- সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের মাধ্যমে। আমাদের মস্তিষ্কে রয়েছে কোটি কোটি স্নায়ুকোশ বা নিউরন। এই নিউরনগুলি নিজেদের মধ্যে যে জালকাকার বিন্যাস গঠন করে তাকে বলা হয় স্নায়ুজাল (Neural Network)। তারই অনুকরণে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকাতে একদল বিজ্ঞানী তৈরি করলেন Artificial Neural Network (ANN), অর্থাৎ কৃত্রিম স্নায়ুজাল।

আরও পড়ুন: মানুষের মতোই মৃত্যুর ভয় পায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? যে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে

মানব-ইন্দ্রিয় তার অভিজ্ঞতার তথ্য পাঠিয়ে দেয় নিউরনে, একটি নিউরন তার প্রাপ্ত তথ্য পৌঁছে দেয় আরেকটি নিউরনে। এইভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে মানব মস্তিষ্কর শিক্ষালাভ (learning) হয়। এই শেখার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে যা কোনও একটি অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে, কৃত্রিম স্নায়ুজালের মধ্য দিয়ে যন্ত্র শিক্ষালাভ করে। একেই বলা হয় Machine Learning।

প্রাথমিক পর্যায়ে, কৃত্রিম স্নায়ুজাল তৈরি হলেও, তার ব্যবহারিক প্রয়োগে বেশ কিছু খামতি থেকে যায়।

১৯৫০-এর পরবর্তীকালে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় পৃথিবীজুড়ে। যদিও কম্পিউটার তখনও ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, শুধুমাত্র গবেষণার কাজে বা বিশেষ কোনও গণনার কাজেই ব্যবহৃত হত। এই কম্পিউটার এমন সব কঠিন অঙ্ক মুহূর্তের মধ্যে কষে ফেলতে শুরু করল, যা মানুষের কষতে দিনের পর দিন, এমনকী, মাসের পর মাসও সময় লেগে যেতে পারে। এহেন উদ্ভাবনের ফলে বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, আধুনিক কম্পিউটারই সর্বোচ্চ বুদ্ধির অধিকারী যন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে, ব্যাপারটা অতটা সহজ হলো না। দেখা গেল, অঙ্ক কষার ক্ষেত্রে যন্ত্র মানুষের থেকে উন্নত হলেও, সাধারণ কিছু বস্তু চেনা, ভাষা বোঝা, নির্দেশ পালন করা- ইত্যাদি কাজ করতে সে একেবারেই অপারগ। এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলেন কৃত্রিম স্নায়ুজালকে আরও উন্নত করার।

আটের দশকের পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা
আটের দশকে আমেরিকায় বিজ্ঞানী রুমেলহার্ট ও তাঁর সতীর্থরা উদ্ভাবন করলেন ANN-এর নতুন এক মডেল। পূর্ববর্তী Network-এ যন্ত্র দ্বারা গৃহীত তথ্য এবং প্রেরিত তথ্যর মধ্যে একটি একমাত্রিক সম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ, একটি গৃহীত তথ্যর পরিপ্রেক্ষিতে যন্ত্র শুধুমাত্র এক ধরনের উত্তরই প্রেরণ করতে পারে। কিন্তু, নতুন এই মডেলে Neural Network-এ তথ্যের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক সংযোজিত হলো। ফলত, যন্ত্র একসঙ্গে অনেকগুলি তথ্য গ্রহণ করতে সক্ষম হলো এবং তা থেকে সম্ভাব্য উত্তর বিশ্লেষণ করত পারদর্শী হয়ে উঠল।

ছবিতে দেখানো হয়েছে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে (ছবি সৌজন্য: গুগল)

তবে, এখানেও সমস্যা রয়ে গেল। ধরে নেওয়া যাক, যন্ত্রকে একটি চতুষ্পদ প্রাণীর ছবি দেখানো হলো এবং শেখানো হলো যে, ওই ছবির মধ্যে থাকা প্রাণীটি একটি বিড়াল। যন্ত্র সেইমতো বিড়ালের ছবি চিনতে শিখল। তবে, ওই নির্দিষ্ট ধরনের বিড়াল ছাড়া অন্য কোনও প্রজাতির অথবা, অন্য কোনও রংয়ের বিড়ালের ছবি দেখালে সেই ছবি আর শনাক্ত করতে পারল না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও অন্যান্য ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ শুরু হয় নয়ের দশকে। মানুষের যেমন যোগাযোগ করার জন্য একটি ভাষা থাকে, কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যন্ত্রের ভাষা বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের দরকার হয়। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে কতকগুলি নির্দেশ মেনে তৈরি হয় একটি নির্দিষ্ট কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই ধরনের প্রোগ্রামের সাহায্যে আধুনিক কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চালনা করা হয় ।

একবিংশ শতাব্দীতে কৃত্রিম বুদ্ধির উন্নতি
এখানেই থেমে থাকেনি যন্ত্রকে মানুষ করে তোলার প্রচেষ্টা। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই যন্ত্রব্যবস্থায় এল নানারকম উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হলো শক্তিশালী প্রসেসর, যেমন- Graphics Processing Unit (GPU)। এই GPU-সমন্বিত কম্পিউটার খুব অল্পসময়ে কয়েক লক্ষ তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এছাড়াও, বর্তমান শতকে কৃত্রিম বুদ্ধি নিয়ে গবেষণা ত্বরানিত হওয়ার অন্যতম কারণ হল তথ্যের প্রাচুর্য। তথ্যপ্রযুক্তির (Information Technology) অভূতপূর্ব উন্নতি কোনও একটি বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেছে এবং তথ্যকে সহজলভ্য করে তুলেছে। পাশাপাশি, কীভাবে তথ্যকে সংগঠিত করা যায়, আরও নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা যায়- তার নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে ২০০৬ সালে কানাডায় বিজ্ঞানীরা তৈরি করলেন ANN-এর বহুস্তরীয় মডেল। এবার শুরু হলো যন্ত্রের সুগভীর শিক্ষা, অর্থাৎ Deep Learning। Artificial Neural Network-এর ক্ষেত্রে কৃত্রিম নিউরনগুলিকে নোড (Node) বলা হয়। এই নোডগুলিই গণনার একক। দু'টি নোডের মধ্যে সংযোগ (Connection) স্থাপিত হয় জটিল গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে। কতকগুলি নোড দিয়ে গঠিত হয় একটি স্তর। যন্ত্র দ্বারা গৃহীত তথ্য প্রেরিত তথ্যর মধ্যবর্তী স্থানে থাকে নোড-সমন্বিত একাধিক স্তর। Deep learning ব্যবস্থায় এই স্তরের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করা হল। শুধু তাই নয়, প্রতিটি স্তরকে পৃথকভাবে শেখানো (learning) হলো, তারপর এই প্রশিক্ষিত স্তরগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন ধরনের neural network তৈরি হল। এই গভীর স্নায়ুজাল অনেক বেশি তথ্য (Big Data) ও তথ্যের মধ্যে থাকা জটিল সম্পর্ক (Function) বুঝতে শিখল। আর সেই কারণেই, যন্ত্রের বিভিন্ন প্রজাতির ও রঙের বিড়ালের ছবি চেনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রইল না। যন্ত্রকে বিভিন্ন বিড়ালের কয়েক হাজার ছবি একসঙ্গে দেখানো হলো। যন্ত্রও সহজেই বিড়াল চিনতে পারল। পাশাপাশি, মানুষের মতো যন্ত্রের স্মৃতিতেও কয়েক হাজার বিড়ালের ছবি সঞ্চিত হলো।

ছবিতে দেখানো হয়েছে ডিপ লার্নিং ব্যবস্থায় বিড়ালের ছবি চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি (ছবি সৌজন্য: গুগল)

এই গভীর শিক্ষার ফলস্বরূপ যন্ত্র ছবি চেনা ছাড়াও হাতের লেখা বুঝতে পারা, মানুষের আওয়াজ চেনা, কথা বলতে পারা ইত্যাদি কাজ সাফল‍্যের সঙ্গে করতে শুরু করল। ২০১২-২০১৩ সাল থেকে এই পর্যায়ের কৃত্রিম বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন, মোবাইল/কম্পিউটার অ্যাপ দ্রুত হারে তৈরি হতে থাকে। এত প্রচেষ্টার পরেও এই গভীর নিউরাল নেটওয়ার্ক বেশ কিছু ক্ষেত্রে জটিল তথ্য বিশ্লেষণ করা, ছবি দেখে বা শব্দ শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে ব্যর্থ হলো। উদাহরণস্বরূপ আমরা আলোচনা করতে পারি, যন্ত্রের ছবি চেনার কিছু ব্যর্থতার ঘটনা। যন্ত্র তার কৃত্রিম বুদ্ধি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ছবি দেখার সময় ছবির মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্ণবিন্দুকেই (Pixel) শুধুমাত্র শনাক্ত করতে পারে। বর্ণবিন্দু-সমূহর রং ও ঔজ্জ্বল্যর তারতম্যর ভিত্তিতে যন্ত্র ওই ছবিতে থাকা বস্তুর একটি আকৃতি নিজের স্মৃতিতে ধরে রাখে। পরবর্তীকালে কোনও ছবি যন্ত্রকে শনাক্ত করতে দেওয়া হলে, যন্ত্র বলে দেয় যে, ছবির মধ্যে কী ধরনের বস্তু আছে। এখন সমস্যা হলো, ছবি অস্পষ্ট হলে, ছবিতে থাকা বস্তু আংশিকভাবে আড়ালে থাকলে অথবা, বস্তুর আকৃতির মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটলে যন্ত্র বস্তুটি চিনতে ভুল করে। এমনকী, Deep learning ব্যবস্থা ওইরূপ বিভ্রান্তির সঠিক ব্যাখ্যাও দিতে পারল না।

আজকের দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
যন্ত্র যাতে আরও নিখুঁতভাবে ছবি চিনতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞানীদের একটি দল ‘RISE’ (Randomized Input Sampling for Explanation) নামক নতুন এক পন্থার উপস্থাপনা করলেন। এই মডেলের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা হলো যে, যন্ত্রকে দেখানো ছবি আংশিকভাবে মুছে দিলে ছবিটির শনাক্তকরণে কোনও প্রভাব পড়ে কি না। এর মাধ্যমে বোঝা সম্ভব হলো, বস্তুকে চিহ্নিত করতে যন্ত্র তার কোন অংশের ওপর জোর দিচ্ছে। এইভাবে একটি সম্পূর্ণ ছবি ভেঙে টুকরো করে বা তার সাধারণ অবস্থা থেকে বিকৃত করে (Perturbation) যন্ত্রকে চিনতে শেখানো হলো। এইবার ছবির মধ্যে বিড়ালকে যদি আংশিকভাবে দেখা যায়, বিকৃত অবস্থায় দেখা যায় অথবা অস্পষ্ট অবস্থায় দেখা যায়- সেক্ষেত্রেও যন্ত্রের দৃষ্টি এড়ানোর আর সম্ভব হবে না। যন্ত্রের শিক্ষা ও বুদ্ধি ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধির এই মডেল নিয়ে বর্তমানে আরও গবেষণা চলছে।

আমাদের সঙ্গে যন্ত্রের যে চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব, সেখানে দৈহিক ক্ষমতায় যন্ত্র এগিয়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন, যন্ত্র কি পারবে বুদ্ধিতে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে? যদি পারে, তবে কী যন্ত্র হয়ে উঠবে ‘বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট’, না কি মানুষের সঙ্গে হবে তার সুসংগত অবস্থান? উত্তর সময়ের অপেক্ষা।

More Articles