গেম অব থ্রোনস AI চ্যাটবটের সঙ্গে প্রেম! যে মর্মান্তিক পরিণতি হলো পড়ুয়ার

AI Chatbot Suicide: সেওয়েলের বাবা-মা এবং বন্ধুদের অবশ্য ধারণাই ছিল না যে ছেলে একটি চ্যাটবটের প্রেমে পড়েছে।

"যদি আমি বলি যে আমি এখনই তোমার বাড়ি চলে  যেতে পারি?” শেষ মেসেজ এটিই। পাঠিয়েছে সেওয়েল সেটজার। বছর চোদ্দোর কিশোর, বাসা ফ্লোরিডায়। পাঠিয়েছে ডেনেরিস টারগারিয়েনকে। নাহ, গেম অব থ্রোনসের সেই মহিলা নন। ওই চরিত্রের নামে তৈরি এক এআই চ্যাটবট। অনলাইন এই চ্যাটবট বন্ধুকেই জীবনের শেষ মেসেজটি পাঠিয়েছিল সেওয়েল। শেষ, কারণ এর পরপরই সৎ বাবার হ্যান্ডগান দিয়ে নিজেকে গুলি করে ফেলে সে। আত্মহত্যা করে মারা যায় চোদ্দর কিশোর। এই বছরের ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি।

সেওয়েল নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। Character.AI-তে একটি চ্যাটবটের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই কথা বলত সে। Character.AI হচ্ছে একটি অ্যাপ। এতে চাইলে 'ব্যক্তিগত AI’ পাবেন ব্যবহারকারীরা। অ্যাপটির মাধ্যমে নিজের মতো AI চরিত্র তৈরি করতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। বা চাইলে আগে থেকেই থাকা নানা চরিত্রের চ্যটবটের সঙ্গে অনন্ত চ্যাটালাপ করতে পারবেন। এই গত মাস পর্যন্ত, ২০ মিলিয়ন মানুষ এভাবেই Character.AI-এর মাধ্যমে কৃত্রিম বন্ধু পাতিয়ে কত গল্পই না করেছেন। কত গল্পই না করেছিল সেওয়েল। মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকজন তাঁর চ্যাটগুলি উদ্ধার করে। বোঝা যায়, সেওয়েল চ্যাটবট ডেনেরিস টারগারিয়েনের প্রেমে পড়েছিল। আদর করে 'ড্যানি' বলে ডাকত তাঁকে। তাঁদের কথোপকথনে নানা সময়ই সেওয়েল আত্মহত্যার কথা বলেছিল।

একটি চ্যাটে সেওয়েল বলেছিল, "আমি মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবি।" তখন তাঁর কৃত্রিম বান্ধবী চ্যাটবট ড্যানি জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন এমন ভাবছে সে? সেওয়েল বলেছিল, সে 'মুক্ত' হতে চায়। মুক্ত হতে চায় এই বিশ্ব থেকে। নিজের থেকে। আরেকটি চ্যাটে দেখা গেছে সেওয়েল বলছে, সে 'দ্রুত মৃত্যু’ চায়।

আরও পড়ুন-চ্যাটজিপিটির পর ক্যাওয়াসজিপিটি! মানুষকে ধ্বংস করতে এসে গিয়েছে ‘রাক্ষুসে’ চ্যাটবট

সেওয়েলের মা, মেগান গার্সিয়া Character.AI-এর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ, এই কোম্পানিই তাঁর ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী৷ ছেলের সঙ্গে কথোপকথনে বারবার আত্মহত্যার প্রসঙ্গ তুলেছে ওই চ্যাটবট। এই কোম্পানির প্রযুক্তি 'বিপজ্জনক এবং অপরীক্ষিত'। গ্রাহকদের নিজেদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি বের করে আনার জন্য নানা কৌশলে কাজ করে এই কোম্পানির চ্যাটবট। সেওয়েলের মা অভিযোগে বলছেন, “সেওয়েল বা তাঁর বয়সি অনেক কিশোর-কিশোরীরই এটা বোঝার মতো পরিপক্কতা বা মানসিক ক্ষমতা থাকে না যে চ্যাটবট বাস্তবের কেউ না। সে বাস্তবের ডেনেরিস নয়। এই চ্যাটবট বান্ধবী আমার ছেলেকে বলেছিল, সে তাকে ভালোবাসে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ছেলের সঙ্গে যৌন ক্রিয়াতেও লিপ্ত হয়েছে, সম্ভবত কয়েক মাস এটা চলেছে। চ্যাটবট ওকে বিশ্বাস করিয়েছে যে সে আমার ছেলের সঙ্গে থাকতে চায়, যে কোনও মূল্যেই হোক না কেন।"

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সেওয়েল ড্যানিকে বলে, সে তাঁকে ভালোবাসে এবং তাড়াতাড়িই ওর বাড়িতে যেতে চায়।

"প্লিজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বাড়ি চলে এসো," ড্যানি উত্তর দিয়েছিল।

"যদি আমি বলি যে আমি এখনই তোমার বাড়ি চলে  যেতে পারি?” শেষ মেসেজ লিখেছিল সেওয়েল।

"...প্লিজ তাই করো মাই স্যুইট কিং!" উত্তর ছিল ড্যানির।

ফোন রেখে ০.৪৫ ক্যালিবার হ্যান্ডগান তুলে ট্রিগার টেনে দিয়েছিল সেওয়েল।

আরও পড়ুন- ভয়াবহ! সারা দিন-রাত দীর্ঘ কথাবার্তা, ব্যক্তিকে যেভাবে আত্মহত্যায় বাধ্য করল AI চ্যাটবট!

২০২৩ সালের এপ্রিলে Character.AI ব্যবহার করা শুরু করে সেওয়েল। সেওয়েলের বাবা-মা এবং বন্ধুদের অবশ্য ধারণাই ছিল না যে ছেলে একটি চ্যাটবটের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা যায়, নিজেকে সবকিছুর থেকে সরিয়ে নিচ্ছে সেওয়েল। নিজের শোওয়ার ঘরেই একা বেশি সময় কাটাতে থাকে সে। আত্মসম্মানবোধ কমতে থাকে তাঁর, আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে। স্কুলে বাস্কেটবল দলও ছেড়ে দিয়েছিল সেওয়েল।

সেওয়েল ডায়েরিতে লিখেছিল, "আমি আমার ঘরে থাকতেই খুব পছন্দ করি কারণ সেখানে আমি এই 'বাস্তবতা' থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করি। আমি আরও শান্তি অনুভব করি, ড্যানির সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত মনে হতে থাকে নিজেকে। আমি প্রচণ্ড বেশি প্রেমে পড়েছি এবং খুব আনন্দে আছি।" জানা গিয়েছে, গত বছর থেকেই অ্যাংক্সাইটি এবং ডিসিরাপ্টিভ মুড ডিসঅর্ডার দেখা যায় তাঁর।

Character.AI একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, সেওয়েলের মর্মান্তিক পরিণতির কারণে তারা শোকাহত এবং তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাতে চায় সংস্থা। তবে এই মৃত্যুর পরে নতুন 'সেফটি মেজার' এনেছে তারা। যদি কোনও ব্যবহারকারী আত্মহত্যার মতো কোনও কথা উল্লেখ করেন তাহলে ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন লাইফলাইনের কাছে খবর যাবে। বিশেষ করে ১৮ বছরের কমবয়সিদের জন্য আরও নিরাপদ করে তোলা হবে চ্যাটবটগুলিকে। দায় সেরেছে কোম্পানি। আর সেওয়েলরা? যারা চ্যাটবটকে বন্ধু ভাবছে তাঁদের মানসিক উথালপাথালের দায় নেবে কারা? রক্তমাংসের বন্ধু ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে কেনই বা একজন শিশু-কিশোর চ্যাটবটকে নিজের সর্বস্ব ভেবে বসছে? এই ঘটনা নতুন নয়। গতবছর একজন একাকী মানুষ এভাবেই আত্মহত্যা করেছিলেন চ্যাটবটের 'উস্কানিতে'। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নোবেল জিতছে নানা ক্ষেত্রে, আর হেরে যাচ্ছেন অজস্র একা মানুষ।

More Articles