মোবাইল ছেড়ে হাতে হাতে পেজার! কেন সেকেলে যোগাযোগ মাধ্যমেই ভরসা লেবাননের?
Pager Blast in Lebanon: কিন্তু গোটা বিশ্ব যখন চব্বিশ ঘণ্টা মোবাইলে মজে, তখন লেবাননে এখনও কেন হাতজোড়া পেজার? সেই প্রশ্ন ওঠে বৈকি।
যুদ্ধের নয়া ভাষা বেছে নিয়েছে এখনকার যুদ্ধবাজ দেশগুলি। ফলে শুধু গুলি, বোমা, বন্দুকই নয়। আপনার, আমার আশপাশে থাকা যে কোনও ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটই যে হয়ে উঠতে পারে যে কোনও সময় একটি পোটেনশিয়াল বোম, সে কথাই প্রমাণ করে দিয়েছে লেবানন, সিরিয়া ও বেইরুটের সাম্প্রতিক এই পেজার বিস্ফোরণ। দু-তিন দিনে গোটা দেশের অসংখ্য পেজার ফেটে গিয়েছে একে একে। যাতে জখম হয়েছেন দেশের অসংখ্য মানুষ। এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩২। শুধু পেজার নয়, ফেটেছে ওয়াকিটকি এমনকী হোম সোলার এনার্জি সিস্টেমেও।
ইরানের মদতপুষ্ট লেবাননের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এই হামলার দায় ঠেলেছে ইজরায়েলের দিকে। ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ কিংবা তাদের গুপ্ত ইন্টালিজেন্স শাখা ইউনিট-৮২০০ রয়েছে এই হামলার পিছনে, এমনটাই দাবি করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। আমেরিকাও হামলার দায় ঠেলেছে ইজরায়েলের দিকেই। ইজরায়েলের দিক থেকে এ সংক্রান্ত কোনও বিবৃতি না মিললেও ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট যেভাবে ঘোষণা করেছেন— যুদ্ধের একটি নতুন পর্বের শুরুতে রয়েছেন বলে, তাতে উস্কে উঠেছে জল্পনা।
আরও পড়ুন: ফের নতুন করে হামলা বেইরুটে, পেজার বিস্ফোরণে কেন জড়াচ্ছে ইজরায়েলের Unit 8200-র নাম?
কিন্তু গোটা বিশ্ব যখন চব্বিশ ঘণ্টা মোবাইলে মজে, তখন লেবাননে এখনও কেন হাতজোড়া পেজার? সেই প্রশ্ন ওঠে বৈকি। পেজার যার অন্য নাম ব্লিপার কিংবা বিপার, কী এই যন্ত্র আসলে। ওয়ারিবহাল মহলের মতে, একটি ওয়্যারলেস টেলিকমিউনিকেশন ডিভাইস এটি, যেখানে আলফানিউম্যারিক বা ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ সারতে পারেন ব্যবহারকারীরা। ওয়ান ওয়ে পেজারের ক্ষেত্রে তাতে শুধুমাত্র মেসেজ গ্রহণ করা সম্ভব। দুদিকের যোগাযোগের জন্য প্রয়োজন টু-ওয়ে পেজারের। ১৯৫০-১৯৬০, মোটামুটি এই সময়ে তৈরি হয়েছিল যন্ত্রটি। ১৯৪৯ সালে পেজার তৈরির পেটেন্টটি নেন এই যন্ত্রের আবিষ্কারক আলফ্রেড গস। তখনও অবশ্য পেজার পেজার হয়নি। ১৯৫৯ সালে মটোরোলা সংস্থা তার নাম দেয় পেজার। মটোরোলার তৈরি প্রথম পেজারটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ১৯৮০-র দিকে ব্যাপক জনপ্রিয় হতে থাকে যন্ত্রটি। নব্বই দশক পর্যন্ত জারি ছিল তার জনপ্রিয়তা। লোকের হাতে হাতে ঘুরত পেজার। তবে পরবর্তীকালে মোবাইল এসে তার জায়গা দখল করে নেয়।
ক্রমে স্মার্টফোন এসেছে। আরও উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জিপিআরএসের মতো আরও হাজারও ট্র্যাকার। যা থেকে মানুষের খোঁজ রাখা কোনও বড় ব্যাপার নয়। যদিও এখনও হাসপাতালের মতো বেশ কিছু সেক্টরে এখনও পেজার ব্যবহার হয়। বিশেষত আমেরিকায় তো বটেই। সাম্প্রতিক কালে যেভাবে সাইবার হামলার বাড়বাড়ন্ত বেড়েছে, তাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের যে বেশ কিছু ভয়ের দিক রয়েছে, তা তো সকলেই মানবেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইজরায়েলে হামাস হামলার পর থেকেই মোবাইল ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীতে। যাতে ইজরায়েল সরকার কোনও ভাবেই তাদের অবস্থান ট্র্যাক করতে না পারে। পেজার যেহেতু নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে, ফলে তা মোবাইলের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলেই মনে করা হয়।
হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ সংগঠনের বাকিদের নির্দেশ দেন, মোবাইলের বদলে পেজার ব্যবহারের। একটি টেলিভিশন ভাষণে তিনি জনগণের উদ্দেশে জানান, আপনাদের হাতের ওই মোবাইলই আসলে ইজরায়েলের এজেন্ট। সেটিকে কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হিজবুল্লাহ নেতা। তার পরেই শুরু হয় লেবাননে পেজারের ব্যাপক ব্যবহার। শুধু হিজবুল্লাহ জঙ্গিরাই নয়, সাধারণ মানুষের হাতেও উঠে আসতে থাকে পেজার।
তার আগে থেকেই অবশ্য হিজবুল্লাহের মধ্যে পেজার ব্যবহারের রমরমা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবং তক্কে তক্কে ছিল ইজরায়েলও। বিশেষ সূত্রের খবর, নাসরোল্লাহের ওই ঘোষণার আগে থেকেই পেজারের মাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর হামলার ছক কষছিল ইজরায়েল। প্রাথমিক ভাবে জানা যায়, লেবাননে হিজবুল্লাহ দ্বারা ব্যবহৃত পেজারগুলি বানিয়েছে তাইওয়ানের একটি সংস্থা। যদিও তারা সে কথা অস্বীকার করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস সূত্রের খবর, নাসরোল্লাহের সিদ্ধান্তের আগেই ইজরায়েল একটি হাঙ্গেরি ভিত্তিক শেল সংস্থা বিএসি কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠা করে, যারা ওই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পেজার উৎপাদন ও সরবরাহ করে। অনুমান করা হচ্ছে, সেখানেই কলকাঠি নাড়ার সুযোগ পেয়েছিল ইজরায়েল। শুধু একটি নয়, আরও দু'টি এমন শেল সংস্থা তৈরি করেছিল ইজরায়েল, যাতে এই মিশন সফল ভাবে কার্যকর করা যায়।
আরও পড়ুন: বিস্ফোরক লুকানো ছিল পেজারেই, লেবাননে বিধ্বংসী হামলার নেপথ্যে ‘ধুরন্ধর’ মোসাদ?
২০২২ সালে বেশ কিছু সংখ্যক পেজার লেবাননে সরবরাহ করা হয়েছিল। তার পর থেকে পেজারের চাহিদা আরও বাড়তে থাকে। বোঝাই যায়, শুধু হিজবুল্লাহ জঙ্গিরাই নয়, ওই সব এলাকার বহু সাধারণ মানুষও ভরসা করতে শুরু করেছিল পেজার ব্যবহারেই। আর সেই পেজারকেই মারাত্মক হামলার হাতিয়ার বানিয়ে তোলে ইজরায়েল। ওই সব পেজারের মধ্যে তৈরির সময়েই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বেশ খানিকটা করে বিস্ফোরক। প্রায় ৩ গ্রাম। আর সেই সম্ভাব্য বোমা হিসেবে হাতে হাতে ঘোরা পেজারগুলি একদিন হঠাৎ করে ফেটে যায় শত্রুপক্ষের কলকাঠিতে। মৃত্যু হয় ৩২ জনের। জখম হন প্রায় ৩-৪ হাজার মানুষ। গত কয়েকদিনে তিল ধারণের জায়গা নেই লেবাননের হাসপাতালগুলিতে। পেজার বিস্ফোরণে কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউ হারিয়েছেন পা। কারওর শরীর ক্ষতবিক্ষত। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়েছে উদ্বেগ। ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘাত আজকের নয়। হামাস বা হিজবুল্লাহ, এই দুই জঙ্গিসংগঠনকেই মদত জুগিয়ে আসছে ইরান। যেভাবে হিজবুল্লাহকে নিশানা করা হয়েছে এই পেজার হামলায়, তাতে ইরান যে ছেড়ে কথা বলার বান্দা নয়, তা বুঝতে পেরে প্রমাদ গুনেছে আন্তর্জাতিক মহলের বড় অংশ।