মহাকাশ দখলের লড়াইয়ে বিপদ পৃথিবীরই? পরিবেশের যে ক্ষতি ডেকে আনছে রাশি রাশি উৎক্ষেপণ

Environmental Emergency: মহাকাশে পরীক্ষানিরিক্ষার জন্য যত মহাকাশযান, রকেট বা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাড়বে, ততই বিপদ বাড়বে পৃথিবীর পরিবেশের, এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

যেদিন থেকে মানুষ বুঝতে শিখেছে, শুধু রাজনীতি বা কূটনীতি দিয়েই একটা দেশের উন্নতি সম্ভব নয়, বিজ্ঞানসাধনাই কার্যত একটি দেশকে বিশ্বমঞ্চে এগিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আর তার পর থেকেই বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে মানুষ নেমেছে মহাকাশ দখলের লড়াইয়ে। আর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই লড়াই বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।  কার্যত সেই লড়াইয়ে এগোতে এগোতে এতদূর এগিয়েছে মানুষ, যে আর কয়েক বছরের মাথায় মহাকাশে রীতিমতো বসতি বানানোর কথাও ভেবে ফেলতে পারে তারা। গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানে যত উন্নতি করেছে সে, ততই মহাকাশ নিয়ে পরীক্ষানিরিক্ষা বেড়েছে তাঁর। মহাকাশকে জানার, বোঝার, হাতের তালুর মতো চেনার প্রচেষ্টায় প্রায় ফি দিনই কোনও না কোনও দেশ পাঠাচ্ছে মহাকাশযান। কোনওটি আন্তর্জাতিক স্পেস সেন্টারের উদ্দেশ্যে, তো কোনওটা চাঁদ, মঙ্গল বা অন্য কোনও গ্রহের উদ্দেশ্যে। এমনকী বাদ যাচ্ছে না সূর্যও।

কিন্তু এই যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মহাকাশযান, উপগ্রহ পৃথিবী থেকে পাড়ি দিচ্ছে মহাকাশের উদ্দেশ্যে, কোনওটা পৌঁছেছে, কোনওটা বা মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়ছে, সেই সব ধ্বংসাবশেষ যাচ্ছেটা কোথায়? সেগুলি লক্ষ কোটি বছর ধরে মহাকাশেই ঘুরে ঘুরে মরছে এমনটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। বরং তারা দিক পরিবর্তন করে ফিরে আসছে সেই পৃথিবীর দিকেই।

পরিসংখ্য়ান বলছে, গত ১৫ বছরে আমাদের গ্রহকে প্রদক্ষিণকারী উপগ্রহের সংখ্যা দশ গুণ বেড়েছে। যার ফলে বেড়ে গিয়েছে মহাকাশে ধ্বংসাবশেষের পরিমাণও। গত এক দশকে সেই সব উপগ্রহ ও উৎক্ষেপিত মহাকাশযান জাত আবর্জনাও পৃথিবীকে ফিরে এসেছে দ্বিগুণ পরিমাণ। যা আসলে পৃথিবীর পরিবেশের জন্য বেশ বিপজ্জনক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

আরও পড়ুন: মহাকাশে যদি স্পেসস্যুট না পরেন, কী ঘটবে আপনার দেহের সঙ্গে? চমকে উঠবেন এই উত্তরে

আর এ কেবল সূচনা মাত্র। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন দাবি করেছে, স্যাটেলাইট স্পেকট্রামের জন্য অ্যাপ্লিকেশন ইতিমধ্যেই দশ লক্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। যদিও এই সমস্ত উৎক্ষেপণ সফল না-ও হতে পারে। তা সত্ত্বেও আমাদের গ্রহকে ঘিরে থাকা মহাকাশযানের সংখ্যা ১ লক্ষ ছুঁয়ে ফেলতে পারে। স্পেস.কম মনে করছে, এই সমস্ত উৎক্ষেপণগুলির বেশিরভাগের নেপথ্যেই রয়েছে স্পেসএক্স ও স্টারলিঙ্কের মতো মহাকাশ পরিবহন সংস্থাগুলি।

মনে রাখতে হবে, বেশিরভাগ আধুনিক রকেট জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহার করে। যা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ভুসো-কালির মতো অশুদ্ধ কার্বনের এক ধরনের কণা নির্গত করে। যা সাধারণত তাপ বেশি পরিমাণে শোষণ করে এবং শেষমেশ তা পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডলের তাপবৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের সঙ্গে মিশে পৃথিবীর আবহাওয়ার তাপীয় ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয় তা। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং ভুষোকালির মতো ওই কার্বনকণা (soot), দুই-ই কিন্তু বাতাসের ওজন স্তরের ক্ষতি করার জন্য বিখ্যাত। বিশেষত প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি যে ওজন গ্যাস অতিবেগুনী রশ্মির হাত থেকে আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে, সেটিকেই নষ্ট করে দেয় এই দুই পদার্থ।

সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারে। সেখানে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে মেসোস্ফিয়ার ও স্ট্র্রাটোস্ফিয়ারে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের ঘনত্ব, ট্রপোস্ফিয়ারের সবচেয়ে নীচের স্তরে ৬৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। যার ফলে ওজোন স্তর হ্রাস পেতে পারে আগামী কয়েক দশকে। আমেরিকার ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA)-র গত বছর প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল, ক্ষতিকর ওই কার্বন-কণা উৎপন্ন করা রকেটের বাড়বাড়ন্ত ওজন স্তরে ক্ষতি বাড়াবেই আগামী দিনে।

এখানেই শেষ নয়। ভয়ের বিষয় আরও রয়েছে। এই স্যাটেলাইট থেকে তৈরি হওয়া ধাতব ছাই, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে তৈরি হচ্ছে, তা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে দুর্বল করে দিতে পারে। যার ফলে মহাজাগতিক বিকিরণ আরও বেশি পরিমাণে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছবে, এবং পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্টের কারণ হবে।

আরও পড়ুন: মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?

এমনিতেই জলবায়ুর পরিবর্তন দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের বিষয়। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন আটকাতে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত কয়েক দশকে মাত্রা ছাড়িয়ে বেড়েছে পৃথিবীর উষ্ণতা। নির্মম ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন, জলাভূমি বুজিয়ে সভ্যতা গড়ে তোলার ফল হাড়ে হাড়ে বুঝছে মানুষ। পৃথিবীর সম্পদ যে হারে খরচ করে ফেলেছে মানুষ, তাতে অচিরেই যে সেই ভাঁড়ারেও টান পড়তে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তার বিকল্প হিসেবে মানুষ খুঁজছে অন্য কোনও গ্রহ, যা মানুষের বসবাসযোগ্য হতে পারে। কিন্তু সেই খোঁজাখুঁজিতেও তো বিস্তর ফাঁড়া। মহাকাশে পরীক্ষানিরিক্ষার জন্য যত মহাকাশযান, রকেট বা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাড়বে, ততই বিপদ বাড়বে পৃথিবীর পরিবেশের। এবং এ নিয়ে এখনই সতর্ক না হলে, আগামী ৫ বছরে যে বড়সড় বিপদের মুখে পড়তে চলেছে পৃথিবীবাসী, তা নিয়েও সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।

More Articles