অরবিন্দ কেজরিওয়াল: আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত না কি ষড়যন্ত্রের শিকার?

Arvind Kejriwal Lok Sabha Polls 2024: ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের 'দিল্লির দাঙ্গা'য় মুখ্যমন্ত্রীর অক্ষমতা রাজ্যবাসী অনেকই ভুলতে পারেননি। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, তিনিও সাম্প্রদায়িক কথা বলে থাকেন।

শেষমেশ ২১ দিন পর, ৫০ দিনের জন্য জামিন পেয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আপ প্রধানকে অন্তর্বর্তী জামিন দেয় সুপ্রিম কোর্ট। গত ২১ মার্চ থেকে তিহার জেলে বন্দি ছিলেন তিনি। আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ইডি আরও দাবি করে, দুর্নীতির টাকা গোয়ার নির্বাচনে কাজে লাগিয়েছিল আপ। সেই দিন ঘণ্টা দুই ধরে তল্লাশির পর বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাঁর মোবাইল ফোন। আপ প্রধান কেজরিওয়ালের বাড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। ১ জুন, ভোট শেষ হওয়া অবধি জেলের বাইরে থাকার অনুমতি পেয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। ২ জুন আবার কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

২০২৪ সালের দিল্লির পরিস্থিতিকে বোঝার জন্য আমাদের চলে যেতে হবে বারাণসী। একটা সময় বারাণসীর লঙ্কা শহরে কেজরিওয়াল এবং মণীশ সিসোদিয়াকে একটি ছোট ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেই সময় ওঁরা ছিলেন আনকোরা রাজনীতিবিদ, দলও তেমন শক্তপোক্ত হয়নি। রাজনীতির শুরুতেই তাঁর ধারণা তৈরি হয়েছিল, সাংবাদিকরা সুবিধে বুঝে খবর করেন। সংবাদমাধ্যম তাঁর শত্রু। বর্তমানে তাঁর গ্রেফতারি এবং দেশের আরও গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলির ভূমিকার পর সত্যি ভাবতে হয়, তিনি সত্যিই কথাটা ভেবেচিন্তে বলেছিলেন নাকি সেটা তার রাজনৈতিক কৌশল ছিল।

আরও পড়ুন- কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির নেপথ্যেও নির্বাচনী বন্ড! কীভাবে?

১০ বছর আগে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ২০১৩ সালে শীলা দীক্ষিতকে তাঁর কেন্দ্র থেকে হারিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে বারাণসী কেন্দ্র থেকে প্রকাশ্যে মোদিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর রাজনীতিতে আসা, একদিকে মানুষ যেমন প্রবল উৎসাহে মেনে নিয়েছিলেন, অন্যদিকে একই ঘটনা অনেককে হতচকিতও করেছিল, ঘাবড়ে দিয়েছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনের সময়, দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত বলেছিলেন, "অরবিন্দ কেজরিওয়াল কে?" কিছুদিন বাদে নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর সেই উত্তর তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপরের বছরে লোকসভা নির্বাচনে বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদির বিরোধী প্রার্থী হয়ে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। আপ প্রধান হেরে গেলেও টক্কর হয়েছিল জোরদার। ২০০৯ সালে বিজেপির প্রধান বিরোধী প্রার্থী মুরলিমনোহর জোশীর থেকেও বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের সেই নির্বাচনে আপ প্রধান পেয়েছিলেন মোট ২০৯,২৩৮ ভোট। ২০০৯ সালে বারাণসীর কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রায় পেয়েছিলেন ১.২৫ লক্ষ ভোট এবং বিএসপি-র প্রার্থী মুখতার আনসারি পেয়েছিলেন ১.৮৭ লক্ষ ভোট। আনসারি জেলে বন্দি থেকেও কেজরিওয়ালকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এরপর আন্দাজ করা যায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কেমন প্রতিযোগী ছিলেন। 'The Wire'-এর এক সাংবাদিক তাঁর প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, মুখতার আনসারির দাদা আফজাল আনসারি সেই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, " ও (কেজরিওয়াল) ভীষণ উদ্ধত। আমি গুন্ডাদের থেকে সমর্থন নেব না।"

২০১৫ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রেকর্ড ভোট পেয়েছিল আম আদমি পার্টি। সেই বছর নির্বাচনের সময় জ্বর নিয়েও দিল্লির বস্তিগুলিতে দেখা গিয়েছিল আপ প্রধানকে। নরেন্দ্র মোদির হাত থেকে দিল্লির ৭০ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৭ টি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন দিল্লির প্রধানমন্ত্রী। তারপর থেকেই দিল্লির রাজনীতির জমি শক্ত করে ধরে রেখেছেন তিনি। সম্প্রতি বলেছিলেন, "২০২৯ সালের লোকসভা ভোটে আপ বিজেপিমুক্ত ভারত গঠন করার ক্ষমতা রাখে।" বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কথাটা নেহাত হওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, একজন বহিরাগত এসে এক দশকে ৪০ বছরের পুরনো একটি দলকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করছে, তা মুখের কথা নয়। বলা ভালো, জনগণও তা ভোট বাক্সে বুঝিয়েছিলেন। কেবল দিল্লি নয়, পঞ্জাব, গুজরাতের খাসতালুকেও আম আদমি পার্টি টক্কর দিয়েছে বিজেপিকে।

আরও পড়ুন- অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত কেজরিওয়াল, সুপ্রিম কোর্টের এক সিদ্ধান্তে বদলে যাবে দিল্লি ভোটের ফলাফল?

অন্যদিকে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের 'দিল্লির দাঙ্গা'য় মুখ্যমন্ত্রীর অক্ষমতা রাজ্যবাসী অনেকই ভুলতে পারেননি। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, তিনিও সাম্প্রদায়িক কথা বলে থাকেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এবং আপ জোট করেছিল। সেই জোট ভোট পেয়েছিল ৪০%, যেখানে বিজেপি পেয়েছিল ৫৭%। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আপ পেয়েছিল ৪৮% এবং বিজেপি পেয়েছিল ৪৬.৪%। কেজরিওয়াল একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি এখনও বিধানসভা ভোটে জিতেও লোকসভায় আসন পাননি।

প্রসঙ্গত, কেজরিওয়াল যখন রাজনীতির ময়দানে আসেন, একজন দুর্নীতি বিরোধী নেতা হিসেবেই তাঁর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠেছে, বিরোধীদের দুর্বল করতে তারা নানা কৌশল করেছে। তার মধ্যে একটি কৌশল, কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সেই ঐতিহাসিক উক্তি: "আপ ক্রোনোলজি সামঝিয়ে" মতোই যদি 'ক্রোনোলজি' অর্থাৎ ঘটনার পরম্পরা বুঝতে হয়, তাহলে আঙুল কেন্দ্র সরকারের দিকেই যায়। যদিও এখন নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ পেয়েছেন কেজরিওয়াল। মুক্তি পেতেই প্রচারে নেমে পড়েছেন তিনি। প্রশ্ন উঠছে, দিল্লির জনগণ কি 'ক্রোনোলজি' বুঝে ভোট দেবে? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কি সত্যিই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার না কি একজন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা? শেষ পর্যন্ত দিল্লির জনগণ তাঁকে কীভাবে মনে রাখবে তাই এখন দেখার।

More Articles