স্বামীর মৃত্যু বদলে দিয়েছিল জীবন, আজ এশিয়ার ধনীতম মহিলা সাবিত্রী জিন্দাল

চিনের ইয়াং হুইয়ানকে টপকে বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মহিলা সাবিত্রী জিন্দাল। শুক্রবার ব্লুমবার্গের প্রকাশিত ইনডেক্স অনুযায়ী সাবিত্রী জিন্দাল এশিয়া তথা ভারতের ধনীতম মহিলা এবং দেশের ধনকুবেরদের তালিকায় দশ নম্বরে রয়েছ...

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর খবর চিরতরে বদলে দিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব সাবিত্রীর জীবন। রাতারাতি স্বামীর হাতে তৈরি বিশাল ব্যবসার দায়িত্ব এসে পড়েছিল তাঁর কাঁধে। আজ নতুন পালক যোগ হয়েছে তাঁর সাফল্যে। চিনের ইয়াং হুইয়ানকে টপকে বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মহিলা সাবিত্রী জিন্দাল। শুক্রবার ব্লুমবার্গের প্রকাশিত ইনডেক্স অনুযায়ী সাবিত্রী জিন্দাল এশিয়া তথা ভারতের ধনীতম মহিলা এবং দেশের ধনকুবেরদের তালিকায় দশ নম্বরে রয়েছে তাঁর নাম। এই মুহূর্তে তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য প্রায় ৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। তাঁর জিন্দাল গ্রুপ মূলত ধাতু এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

ইয়াংয়ের পতন ও সাবিত্রীর উত্থান
গত পাঁচ বছর ধরে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মহিলা ছিলেন ইয়াং হুইয়ান। ২০০৫ সালে উত্তরাধিকার সূত্রে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় হাতে খড়ি ইয়াংয়ের। এই ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন পৃথিবীর কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়রদের অন্যতম। ২০১৮ সালে তাঁর কোম্পানি মাত্র চারদিনে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের রেকর্ড গড়ে। কিন্তু সম্প্রতি চিনের সম্পত্তি-সংকটের মুখে পড়েছে ইয়াংয়ের কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংস কোম্পানি। ফলস্বরূপ, চলতি বছরে প্রতিদিন এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাঁর সংস্থা এবং সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আর সেই সুযোগেই ইয়াংকে পিছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে এলেন সাবিত্রী জিন্দাল।

বর্তমানে সাবিত্রী জিন্দালের বয়স ৭২ বছর। তাঁর স্বামী ও জিন্দাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ওমপ্রকাশ জিন্দালের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই কোম্পানির দায়িত্ব নিতে হয় সাবিত্রীকে। তাঁর তত্ত্বাবধানে কোম্পানির আয় প্রায় চারগুণ বেড়েছে। বর্তমানে ভারতের তৃতীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী এবং সিমেন্ট, বিদ্যুৎ শক্তি, পরিকাঠামো বিভাগেও কাজ করে জিন্দাল গ্রুপ। সাম্প্রতিক সময়ে জিন্দাল গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ ব্যাপকভাবে ওঠানামা করেছে। কোভিড অতিমারীর কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলে কোম্পানির সম্পদ কমে দাঁড়ায় ৩.২ বিলিয়ন ডলারে। তারপর, ২০২২ সালের এপ্রিলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তা বেড়ে হয় ১৫.৬ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ কমলেও মাত্র দু'বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার সম্পত্তি বেড়েছে তাঁর।

আরও পড়ুন: জঙ্গলে কাঠ কাটা থেকে শুরু, ভারতকে সোনা জেতানো মীরাবাঈ চানুর যাত্রা কেমন ছিল

সাবিত্রীর জীবন
১৯৫০ সালের ২০ মার্চ অসমের তিনসুকিয়ায় জন্ম হয় সাবিত্রীর। তাঁর স্কুলজীবন এবং বেড়ে ওঠা সবই আসামে। কলেজে পড়াশোনা না করলেও তিনি ডিপ্লোমা পাশ করেছিলেন। ১৯৭০ সালে ওমপ্রকাশ জিন্দালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সাবিত্রী। তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে চার ছেলে পৃথ্বীরাজ, সজ্জন, রতন এবং নবীন জিন্দালও বর্তমানে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ২০০৫ সালে ওপি জিন্দালের মৃত্যুর পরপরই জিন্দাল গ্রুপের চেয়ারপার্সন পদে বসেন তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী জিন্দাল। ২০১০ সালে ফোর্বসের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের পরিবারের মহিলারা মূলত ঘর-সংসার সামলান এবং পুরুষদের ওপর দায়িত্ব থাকত বাইরের কাজের। আমি জীবনে কোনওদিনও ব্যবসায়িক কাজকর্মে মাথা ঘামাইনি। জিন্দাল সাহেব বলতেন যে, বাইরের সকলেই নাকি আমাদের আত্মীয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। আর আমাদের পরিবারের মহিলাদের বাইরের বড় মানুষদের সঙ্গে কথা বলা বারণ ছিল।"

জিন্দাল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের বর্তমান চেয়ারম্যান ওম ও সাবিত্রীর ছেলে নবীন জিন্দাল। তবে শুধু ব্যবসা নয়, রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন সাবিত্রী জিন্দাল। কংগ্রেসের হয়ে হরিয়ানার হিসর কেন্দ্র থেকে ২০০৫ সালে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে ওই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন তাঁর স্বামী।

সাবিত্রীর হাতে জিন্দাল গ্রুপের সাফল্য
১৯৩০ সালে হরিয়ানার কৃষক পরিবারে জন্ম হয় সাবিত্রীর স্বামী ওমপ্রকাশ জিন্দালের। ২২ বছর বয়সে হরিয়ানার হিসরে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন তিনি। লাভের পরিমাণ বাড়লে প্রথম বড় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট তৈরি হয় কলকাতা শহরের বুকে। ২০০৫ সালে ওমপ্রকাশের মৃত্যুর পর সাবিত্রীর হাত ধরেও জিন্দাল গ্রুপের সাফল্য আসতে থাকে। কোম্পানির আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি চিলি, মোজাম্বিকের মতো দেশেও খনি কেনে জিন্দাল গ্রুপ। অন্যরা যেখানে মনে করতেন, সব আশা শেষ হয়ে গেছে, সেখানেও নতুন আশার আলো দেখতে পাওয়া সম্ভব- এমনটাই মনে করতেন ওম প্রকাশ জিন্দাল। স্বামীর এই সাফল্যের বাণীকে সঙ্গী করেই নতুন নতুন অঙ্ক ছুঁয়েছে জিন্দাল গ্রুপ। তাই তো আজ যখন চুলে পাক ধরেছে, তখনও অপরাজেয় সাবিত্রী জিন্দাল।

More Articles