জঙ্গলে কাঠ কাটা থেকে শুরু, ভারতকে সোনা জেতানো মীরাবাঈ চানুর যাত্রা কেমন ছিল

মীরাবাঈ চানুর এই বিশ্ব-বিজয়ের রাস্তাটা খুব একটা সহজ ছিল না। ভারতের মতো ক্রিকেটনির্ভর দেশে থেকে ভারোত্তোলনের মতো একটি খেলাকে নিয়ে এগোনো সহজ না।

তিনি টোকিও অলিম্পিকের রৌপ্যপদকজয়ী তারকা। মহিলাদের ৪৯ কেজি বিভাগে দ্বিতীয় স্থান ছিনিয়ে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে ভারতকে গৌরবান্বিত করেছিলেন তিনি। তাই স্বাভাবিক কারণেই বার্মিংহামের কমনওয়েলথ গেমসেও সকলের নজর ছিল তাঁর দিকে। সেই সাইখম মীরাবাঈ চানু কমনওয়েলথ গেমসের ময়দানে করলেন নতুন রেকর্ড। জিতলেন সোনা। চানুর হাত ধরেই চলতি কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম সোনা পেল ভারত। মহিলাদের ৪৯ কেজি বিভাগে স্ন্যাচে ৮৮ কিলোগ্রাম ওজন তুলে বিশ্বরেকর্ড তৈরি করলেন মীরাবাঈ চানু। এখনও পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত সেরা পারফরম‍্যান্সও এটাই। তার সঙ্গেই হলো নতুন জাতীয় রেকর্ড, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বার্মিংহামে জিতল ভারত।

তবে শুধুমাত্র স্ন্যাচ নয়, এরপরে ক্লিন অ্যান্ড জার্কেও চলল চানু রাজ। ১০৯ কেজি ওজন তুললেন মীরাবাঈ চানু। সব মিলিয়ে তাঁর তোলা ওজন দাঁড়াল ১৯৭ কিলোগ্রাম। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আরও ৪ কেজি বেশি ওজন তুললেন, অর্থাৎ ১১৩ কেজি ওজন তুললেন চানু। দু'টি বিভাগ মিলিয়ে তাঁর তোলা সর্বমোট ওজনের পরিমাণ হলো ২০১ কিলোগ্রাম। ভারতের কমনওয়েলথ গেমসের ইতিহাসে এটা একটা বিপুল বড় রেকর্ড। ক্লিন অ্যান্ড জার্কের তৃতীয় প্রচেষ্টায় ১১৫ কেজি ওজন তোলার চেষ্টা সফল হননি তিনি।

তবে এই তৃতীয় ওজনের প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। আগেই মীরাবাঈ চানুর জয় হয়ে গিয়েছিল। মহিলাদের ৪৯ কেজি বিভাগে চানু শুরু করেছিলেন ৮৪ কেজি ওজন তুলে। প্রথম প্রচেষ্টায় ৮৪ কেজি ওজন তুলে সকলকে তাক লাগিয়ে দিলেন তিনি। তার সঙ্গেই যেন তিনি বুঝিয়ে দিলেন, অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার মেয়ে তিনি নন। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ৮৮ কেজি ওজন তুললেন তিনি। এটাই তাঁর ব্যক্তিগত সেরা পারফরম্যান্স। পাশাপাশি ভারতের প্রথম মহিলা ভারোত্তলোক হিসেবে ৪৯ কেজি বিভাগ থেকে ৮৮ কেজি ওজন তুললেন কেউ। পুরো কমনওয়েলথ গেমসের ইতিহাসেও এটা সবথেকে বড় রেকর্ড। তৃতীয় প্রচেষ্টায় ৯০ কেজি ওজন তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তবে ৮৮ কেজি ওজন তুলেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে ১২ কেজিতে এগিয়েছিলেন তিনি। ফলে তাঁর স্বর্ণপদক জয় ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা।

আরও পড়ুন: কোর্টে যত ঝড় তুলেছেন বিতর্ক ততই পিছু নিয়েছে, আজও সানিয়া মির্জা মানেই তরজা

তবে মীরাবাঈ চানুর এই বিশ্ব-বিজয়ের রাস্তাটা খুব একটা সহজ ছিল না। ভারতের মতো ক্রিকেটনির্ভর দেশে থেকে ভারোত্তোলনের মতো একটি খেলাকে নিয়ে এগোনো সহজ না। আর তাঁর নিজের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না সেই সময়ে। একটা সময় এমন ছিল, যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এক কিলোমিটার দূর থেকে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসতে হতো জলের ড্রাম। ১২ বছর বয়সে জঙ্গলে গিয়ে কাটতে হতো কাঠ। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রত্যেকদিন অনুশীলন করতে যেতে হতো ছোটবেলার কোচ অনিতা চানুর কাছে। মনিপুরের সেই জেদি মেয়ে সাইখম মীরাবাঈ চানু আজ বিশ্বের মঞ্চে জয় করলেন সোনা।

মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের থেকে কিছুটা দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম নংপোক কাকচিংয়ে ১৯৯৪ সালে জন্ম হয়েছিল মীরাবাঈ চানুর। পাহাড়ি মেয়ে। তাই প্রকৃতির কোলেই তাঁর বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই রীতিমতো ডাকাবুকো মেয়ে হিসেবে তাঁর পরিচয় ছিল। তবে ছোটবেলা থেকেই ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি ভারী ওজন তুলতে পারতেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি যখন তাঁর দাদাদের সঙ্গে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেতেন, তখন একটা আস্ত কাঠের গুঁড়ি তুলে নিয়ে আসতে পারতেন তিনি একাই। তারপরেই তাঁর বাবা-মা বুঝতে পারেন, তাঁদের মেয়ে সাধারণ নন। শুরু হয় ভারোত্তোলনের প্রশিক্ষণ।

ধাপে ধাপে রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় স্তরে উঠে আসলেন মীরাবাঈ চানু। ২০১৪ গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসের ময়দানে রূপো জয়ের পরে যখন ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে তিনি ডাক পান, তখন সকলের আশা ছিল, মীরাবাঈ হয়তো কোনও না কোনও একটি পদক জয় করবেন ভারতের জন্য। কিন্তু রিও অলিম্পিকে নিজের সঠিক পারফরম্যান্স দিতে পারেননি চানু। তবে সেই রিও অলিম্পিকের স্কোরবোর্ডটা তাঁর জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। রিও অলিম্পিকে ব্যর্থ হবার পর তাঁর বিরুদ্ধে ধেয়ে আসে কটাক্ষের তীর, একের পর এক প্রশ্নবাণ। প্রশ্ন তোলা হয় তাঁর দক্ষতা নিয়ে। এত কটাক্ষের শিকার হতে হতে একটা সময় বিষন্নতা তাঁকে গ্রাস করে।

পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, তাঁকে জীবনের মূল স্রোতে ফেরার জন্য নিতে হয়েছিল কাউন্সেলিং ট্রিটমেন্ট। ২০১৬ ও ২০১৭- এই দু'টি বছর ছিল তাঁর জীবনের সবথেকে খারাপ সময়। ২০১৭ সালের প্রথমদিক নাগাদ ভারোত্তোলনের সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চানু। কিন্তু তাঁকে নতুন করে খেলার ময়দানে ফিরিয়ে আনেন তাঁর কাউন্সেলিং কোচ। আবারও নতুন উদ্যম নিয়ে খেলা শুরু করেন মীরাবাঈ চানু। ২০১৭ সালে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ওয়েট লিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ফিরে আসে তাঁর পুরনো ফর্ম। অন্যান্য সমস্ত প্রতিযোগীদের হারিয়ে সোনা জয় করেন চানু।

ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকে সাফল্য না পেলেও থমকে যাননি মীরা। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান, চিন, স্কটল্যান্ড-সহ একাধিক দেশে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছেন মীরা। তবে বড় মঞ্চে সোনা পাওয়া যেন অধরাই ছিল এতদিন। সেই স্বপ্নটাও পূরণ হয় ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়া কমনওয়েলথ গেমসে। মহিলাদের ৪৮ কেজি বিভাগে ১৯৬ কেজি ওজন তুলে স্বর্ণপদক জয় করেন মীরাবাঈ চানু।

সেই সাফল্যের ধারা বজায় থাকে টোকিও অলিম্পিকেও। সেই অলিম্পিকে ভারতে হয়ে প্রথম পদক জয় করেছিলেন মীরাবাঈ চানু। চিনের প্রতিযোগীকে হারাতে না পারলেও দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি। রৌপ্যপদক জয় করেছিলেন মণিপুরের কন্যা। তবে সেই আক্ষেপ আজ পুষিয়ে দিয়েছে ২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস। বার্মিংহামের ময়দানে স্বর্ণপদক জয়ের খুশিতে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সারা দেশে তাকে নিয়ে জয়জয়কার। মীরা যখন পারফর্ম করতে নামছেন, সেই সময়ে ক্যামেরার ফোকাস গিয়ে পড়ল গ্যালারির একটি ব্যানারের দিকে, তাতে লেখা, ' মীরা তুম হো ইন্ডিয়া কা হীরা'। এভাবেই যেন মীরাবাঈরা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন, শুধুমাত্র ক্রিকেটেই নয়, ভারোত্তোলন বা জ্যাভলিনের থ্রোয়ের মতো খেলাগুলিতেও ভারত বিশ্বসেরা।

More Articles