বিজেপিকেই বেছে নিলেন রাজস্থানের মেয়েরা, কেন ভোটে মুখ পুড়ল কংগ্রেসের?
Assembly Election Result 2023 Rajasthan: যে যে ভোটকেন্দ্রে মহিলা ভোটার বেশি, সেই ভোটকেন্দ্রগুলিতে গো-হারান হেরেছে কংগ্রেস। রাজস্থানের মেয়েদের নিরঙ্কুশ সমর্থন গিয়েছে মোদি-ম্যাজিকের দিকেই।
রাজস্থানে গো-হারান হেরেছে কংগ্রেস। কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে অশোক গেহলট সরকার। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসতে চলেছে বিজেপি। এর আগে অবশ্য ভাঙতে ভাঙতে বেঁচেছিল রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার। ২০২০ সাল নাগাদ বিক্ষুব্ধ উপ-মুখ্যমন্ত্রী শচীন পাইলটের হাত ধরে বিজেপি ফাল হয়ে বেরোনোর চেষ্টা করেছে। তবে সে যাত্রায় গদি বেঁচে গিয়েছিল গেহলটের। তবে সেই টলমলে নৌকা ডুবল ২০২৩-র বিধানসভা ভোটে এসে। গত ২৫ নভেম্বর ভোটগ্রহণ হয়েছে রাজস্থানের ৩৩টি জেলার মোট ৪১,০০৬টি ভোটকেন্দ্রে। দেখা গিয়েছে ১৯টি জেলায় পুরুষের থেকে মহিলা ভোটার সংখ্যা বেশি। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, যে যে ভোটকেন্দ্রে মহিলা ভোটার বেশি ছিল, সেই সব ভোটকেন্দ্রগুলিতে গো-হারান হেরেছে কংগ্রেস। রাজস্থানের মেয়েদের নিরঙ্কুশ সমর্থন গিয়েছে মোদি-ম্যাজিকের দিকেই।
গোড়া থেকেই রাজস্থানে ভোটগ্রহণ নিয়ে নানা সমস্যা দেখা গিয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে ভোটগ্রহণের দিন ঠিক হয়েছিল ২৩ নভেম্বর। সেদিন সবচেয়ে বেশি বিয়ের তারিখ পড়ায় ভোটগ্রহণ পিছোয়। ২৩-র বদলে ভোটগ্রহণ হয় গত ২৫ নভেম্বর। এবং বলাই বাহুল্য ভোট হয়েছে স্বতস্ফূর্ত ব্যাপার। মজার ব্যাপার, এবারের ভোটে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় অন্তত ৭৪.৬৭ শতাংশ ভোট বেশি পড়েছে রাজস্থানে মহিলাদের তরফে। এমনটা বললে খুব ভুল হবে না, রাজস্থানে কংগ্রেসের ভাগ্যনির্ধারণে বড় ব্যাপার ছিলেন সেই মহিলা ভোটাররাই।
আরও পড়ুন: মোদীকে অপয়া বলে ভোটে জেতা যায়?
এদিকে গত পাঁচ বছরে রাজ্যের মহিলাদের জন্য তো কম কল্যাণমূলক প্রকল্প নেননি অশোক গেহলট সরকার। গত কয়েক মাসে ভোটপ্রচার চলাকালীন বারবার সেইসব প্রকল্পের উপর জোর দিয়েছে কংগ্রেস। প্রতিটি সভা, জনসভা থেকে বোঝানো হয়েছে সেই সব প্রকল্পের সুফল নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, মূল লক্ষ্য ছিল মহিলা ভোটারদের নিজেদের দিকে টানা। ভোটের দিকে নজর রেখে চালু করা হয়েছিল আর দশটি নয়া প্রকল্প। পাশাপাশি ৩৪টি পুরোনো প্রকল্প তো ছিলই, যা মহিলাদের সুবিধা দিতেই তৈরি। এত সব কিছুর বিপরীতে বিজেপির আস্তিনের গুটি ছিল কেবলমাত্র নারী নিরাপত্তার ইস্যু। আর সেই ইস্যুতে পাখির চোখে তির মেরে ফেলল বিজেপি।
কংগ্রেসের নতুন-পুরনো মিলে এতগুলো প্রকল্প, নারী কল্যাণমূলক কাজ সবই কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি-ঝড়ে। সেসব ছেড়ে নারী সুরক্ষার অবক্ষয়ের দিকেই কি বেশি ঝুঁকল রাজস্থানের মেয়েরা! আর তার কারণ সম্ভবত রাজস্থানে বাড়তে থাকা মহিলাদের প্রতি অপরাধ। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রাজ্যে মেয়েদের প্রতি অপরাধ। চলতি বছরে একাধিক বিজেপি নেতাকে রাজস্থানে বেড়ে চলা মহিলাদের প্রতি সুরক্ষা নিয়ে মুখ খুলেছেন। চলতি বছরের মাঝামাধি কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছিলেন, রাজস্থানে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এনসিআরবি-র অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে তিনি দাবি করেছিবেন ২০২১ সালে দেশে নথিভুক্ত ৩০ হাজার ধর্ষণ মামলায় এক পঞ্চমাংশই নাকি রাজস্থানের ঘটনা। গেহলটের শাসে রাজস্থানের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে বলেও দাবি করেছিল বিজেপি। একের পর এক নারীহেনস্থার ঘটনা তার প্রমাণ। বিকানেরের সাংসদও অভিযোগ করেন,কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজস্থানে প্রতিদিন ধর্ষণ এবং বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা সামনে আসছে। আর এই ধরনের ঘটনার সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও শিশুরাই। রিপোর্ট করা হয় না, এমন ঘটনাও কম নেই রাজস্থানে।
সব মিলিয়ে গোড়া থেকেই বিজেপি পাখির চোখ ঠিক করে রেখেছিল। আর সেই তাস পকেটে ঢুকিয়েই ভোটমুখী রাজস্থানে প্রচারে নেমেছিল বিজেপি। আর সেই চালে যে ভুল হয়নি, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বিধানসভা ভোটের ফলাফলেই। রাজস্থানের বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকাতেই মোট ভোটারের মধ্যে ৭৬.১১ শতাংশ ভোট এসেছে মহিলাদের দিক থেকে। পুরুষদের ভোট ছিল ৭৫.২৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ৭০.২৮ শতাংশ ভোট এসেছে মহিলা ভোটারদের কাছ থেকে। পুরুষদের থেকে এসেছে ৭২.১৩ শতাংশ ভোট। তেমনটাই জানাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অলওয়ার, শওয়াড়া, বারমের, ভরতপুর, ভিলওয়াড়া, চুরু, দৌসা, ধোলপুর, ডুঙ্গারপুর, জয়সালমের, জালোর, ঝুনঝুনু, নাগৌর, পালি, প্রতাপগড়, রাজসামন্দ, সিকর, সিরোহি এবং উদয়পুরের গ্রামীণ ভোটকেন্দ্রগুলিতে প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা ভোটারই নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। আর ভোটের ফলাফল বলে দিচ্ছে, সেই পছন্দ পুরুষদের সঙ্গে মেলেনি মোটেই। সিকর, পালি, ঝুনঝুনু, রাজসামন্দ এবং দুঙ্গারপুর- এই পাঁচ জেলায় মহিলা ভোটারদের সংখ্যা পুরুষের চাইতে অনেকটাই বেশি।
এদিকে, ৬টি জেলার শহুরে ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটার সংখ্যা বেশি বলে জানা গিয়েছে। বাঁশওয়াড়া, চুরু, ডুঙ্গারপুর, নাগৌর, ঝুনঝুনু এবং সিকরের শহুরে বুথে ২৫ নভেম্বর প্রায় ৭৩% মহিলা ভোট দিয়েছেন, যা পুরুষদের ভোটের শতাংশের তুলনায় প্রায় ২.৫% বেশি৷ সিকারের আটটি আসনের মধ্যে প্রায় পাঁচটিতে, চুরুতে ছয়টির মধ্যে চারটিতে, ঝুনঝুনুর চারটির মধ্যে তিনটি এবং নাগৌরে দশটি আসনের মধ্যে তিনটিতে জিতেছে কংগ্রেস। এই কেন্দ্রগুলিতে যেটুকু ভোট কংগ্রেস পেয়েছে, তার কৃতিত্ব যায় রাজ্য সরকারের ওই সব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুসিক জন্য। সেগুলি না থাকলে যে আরও বাজে ভাবে রাজ্য ভোটে মুখ পুড়ত গেহলট সরকারের, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না।
আরও পড়ুন: নয়া ভারতে বেড়েছে নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ, এই কি তবে মোদিজির ‘অচ্ছে দিন’?
তবে মোদি যে এমনি মোদি নন, তা ফের প্রমাণিত হয়ে গেছে এই ভোটে। পাঁচ রাজ্যের মধ্যে চারটিই ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। তেলঙ্গানায় কোনওমতে মুখ বাঁচিয়েছে কংগ্রেস। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, ভাবনাচিন্তা করেই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদি। এই যে প্রচারের শেষ কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি বক্তৃতায় যে ভাবে রামমন্দিরের প্রসঙ্গ বারবার এনেছেন, তা সম্ভবত ওই মহিলা ভোটের দিকে তাকিয়েই। রামমন্দিরের ধারণা যে রাজস্থানের মহিলাদের আকৃষ্ট করবেই, তা ভালোমতেই বুঝেছিলেন অভিজ্ঞ মোদি। আর রাজস্থানে সেই তাসটাই ব্যবহার করেছে বিজেপি। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রাজস্থানের মহিলা ভোটাররা যে কংগ্রেস সরকারের সিলিন্ডারে ভর্তুকি, বিন্য়ামূল্যে স্মার্টৎফোন ও অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রকল্পকে পছন্দ করেননি, তা নয়। তবে রাজস্থানের মহিলা ভোটারদের জন্য যে ধর্মের চেয়ে বড় আকর্ষণ আর কিছুই নয়, তা বুঝেই মেপে মেপে মরুরাজ্যে পা ফেলেছে বিজেপি। আর তার ফল মিলেছে হাতেনাতে।